অন্তহীন আকাশের নীচে/১৭
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ১৭
দেবপ্রিয়া সরকার
------------------------------
-কোথায় থাকিস বল তো আজকাল? তোর পাত্তাই পাওয়া যায় না? আমার অ্যাবসেন্সে নতুন কোনও গার্ল ফ্রেন্ড জোটালি নাকি?
-আমার আবার গার্ল ফ্রেন্ড! না আছে বাইসেপস্, না আছে আমার নামীদামী বাইক। বাবার ব্যাঙ্কে লাখ লাখ টাকাও নেই। কী দেখিয়ে পটাব মেয়েদের?
-ধুর পাগল! প্রেম করতে গেলে ওসব লাগে নাকি? কাউকে ভালবাসার জন্যে শুধু একটা প্রেমিক মন থাকতে হয়।বুঝলি হাঁদা রাম?
সশব্দে হেসে উঠল ভিক্টর। হাসির দমক কমলে বলল, এই জোকটা দারুণ ছিল। প্রেমিক মন টন সব বাজে কথা। যদি সেটাই সত্যি হতো তবে বুক ভর্তি ভালবাসা নিয়ে এতো তো ঘুর ঘুর করলাম তোর পেছনে, তবুও কি তোকে পটাতে পারলাম? আজ পর্যন্ত সিরিয়াসলি নিলিই না আমাকে।
ভিক্টরের কথা শুনে হকচকিয়ে গেল স্বয়ংদ্যুতি। এমন অকপটে ভিক্টরকে মনের কথা প্রকাশ করতে সে আগে কখনও দেখেনি। নিজেকে সামলে নিয়ে স্বয়ংদ্যুতি বলল, আরে বোকা, তুই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। খামোখা তোর সঙ্গে প্রেম করতে যাব কেন? বেস্ট ফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রেম করে আমি আমাদের এই সুন্দর সম্পর্কটাকে নষ্ট করার একেবারে পক্ষপাতি নই। তুই যে আমার কত বড় আশ্রয় সেটা তোকে বলে বোঝাতে পারব না। এর মাঝে প্রেম, বিয়ে, সংসার এসব এনে রিলেশনটাকে বিষিয়ে দিস না, প্লিজ। আমাদের কেমিস্ট্রিটা আজীবন এমনই থাকতে দে।
স্বয়ংদ্যুতিকে গম্ভীর হতে দেখে প্রসঙ্গ বদলাল ভিক্টর, আচ্ছা ছাড় এসব। তোর কাজ কেমন চলছে সেটা বল। এখনও পর্যন্ত যে ক’টা ভ্লগ আপলোড করেছিস, সবগুলোই খুব ইম্প্রেসিভ লেগেছে। ভিউয়ারসের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন।
গলায় একরাশ খুশি নিয়ে স্বয়ংদ্যুতি বলল, কাজ খুব ভাল এগুচ্ছে। কোচ-কামতা রাজ ইতিহাসের বহু অজানা তথ্য আমি পেয়েছি। আজ পর্যন্ত কেউ এই সাবজপক্ট নিয়ে ডিটেইলসে কাজ করেনি। ইন্দ্রায়ুধ অনেক ইনফো দিয়েছে। বহু কিছু জানা বাকি আছে এখনও। আজ যাব রাজবাড়িতে ভিডিও শ্যুট করতে। তারপর আরও কয়েকটা জায়গায় যাবার প্ল্যান আছে আমাদের। এই প্রজেক্টটা নিয়ে ভীষন এক্সাইটেড আমি।
-বাহ! খুব ভাল। কিন্তু খেয়াল রাখিস শুধু কনটেন্টে ঠাসা ভিডিও বানালেই হবে না, এডিটিংটাও মন দিয়ে করতে হবে। দর্শককে কেবল রসকষহীন ইতিহাস গেলালে বোরিং লাগতে পারে, তাই মাঝে মাঝে অফটপিকও কিছু পুট করার চেষ্টা করিস।
-একদম। এই জন্যেই তো আজ চিলাপাতা ফরেস্টে একটা ছোট্ট ট্রিপ প্ল্যান করেছি। ইতিহাসের পাশাপাশি ভিউয়ারদের ডুয়ার্সের জঙ্গল থেকেও ঘুরিয়ে আনব এই ফাঁকে। চেষ্টার কোথাও খামতি রাখব না বস, বাকিটা ডেস্টিনি।
-গ্রেট! চালিয়ে যা। সঙ্গে কে যাচ্ছে? তোর ওই গবেষক?
-হুম। আর কে যাবে? আমি তো কোনও কিছুই চিনি না সেভাবে।
-বান্দাটি কেমন? রিল্যায়েবল তো?
-হান্ড্রেড পারসেন্ট। জানিস? ইন্দ্রর বাবা আর আমার বাবা ছেলেবেলার বন্ধু। ইন্দ্র কে খুব পছন্দ করে বাবা। একদিনেই ও বাড়ির সকলের মন জয় করে ফেলেছে।
স্বয়ংদ্যুতির বলা কথাগুলো ভিক্টরের বুকে কাঁটার মতো বিঁধল। অনেক কষ্টে মুখে হাসি ধরে রেখে সে বলল, নিজের ফোকাস ঠিক রেখে টার্গেটের দিকে এগিয়ে যা। সাবস্ক্রাইবার বাড়ানোই তোর এখন মূল উদ্দেশ্য, মনে রাখিস। যত বেশি পপুলারিটি পাবি তত নতুন নতুন অ্যাড আসবে আর সঙ্গে টাকাও। গোল্ডেন প্লে বটন আর বেশি দূরে নেই। কোচবিহারের আনটোল্ড স্টোরি নিয়ে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ভ্লগ বানাতে পারলে আর তোকে পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। জনপ্রিয়তা, সম্মান, অর্থ সব আসবে একে একে।
স্বয়ংদ্যুতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম স্বরে বলল, বিষয়টা ঠিক তা নয় রে ভিক্টর। আগে আমিও তোর মতই ভাবতাম। ইন্টারেস্টিং স্টোরি, আনকমন কনটেন্ট দেখিয়ে চ্যানেলের পপুলারিটি বাড়ানোই ছিল আমার প্রাইম টার্গেট। কিন্তু ইন্দ্রায়ুধকে দেখার পর আমার সব ধারণা পাল্টে গিয়েছে। শুধু জনপ্রিয়তা বা টাকা রোজগারই বোধহয় জীবনে সব নয়। জন্মভূমির প্রতিও আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে। কোচবিহারের ইতিহাস নিয়ে কী ভীষণ আবেগ ইন্দ্রর! যেকোনো মূল্যে এই ইতিহাসকে ও মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায়। ওর পরিশ্রমের ফসল, রাত জেগে তৈরি করা রিসার্চ ওয়ার্ক তাই নির্দ্বিধায় তুলে দিয়েছে আমার হাতে। ঠিক কতটা ভালবাসা নিজের দেশ বা শহরের প্রতি থাকলে কেউ এতটা নিঃস্বার্থ হতে পারে, বলতে পারিস?
একটা শ্বাস গোপন করল ভিক্টর। মনে মনে অনেক কিছু বলল কিন্তু মুখে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। একটু থেমে স্বয়ংদ্যুতি আবার বলল, আমাকে জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান পাঠ পড়িয়েছে ইন্দ্রায়ুধ। ওর সঙ্গে থেকে জীবনকে আমি নতুন অ্যাঙ্গেলে দেখতে শিখেছি। সব ভাবনা ওলোট পালট হয়ে গিয়েছে আমার। এ্যাদ্দিন বাদে সত্যি সত্যি খুঁজে পেয়েছি নিজের বিবেককে। তাই নিছক লাভের কড়ি ঘরে তোলার জন্য আর এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করব না ঠিক করেছি। এখন থেকে যতটুকু কাজ করব সবটাই করব ভালবেসে, নিখাদ সততা দিয়ে। তাতে ভিউয়ারস্ বাড়লে বাড়বে ,না বাড়লে নয়।
স্বয়ংদ্যুতির কথা শেষ হলে ভিক্টর একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, এই ক’দিনেই বেশ পাকা পাকা কথা বলতে শিখে গিয়েছিস দেখছি! যাক্ গে, জোকস্ অ্যাপার্ট, তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতি। যা করবি আমি নিশ্চিত ভালই করবি। এখন তবে রাখি একটু শপিংয়ে যাব।
-হঠাৎ শপিং?
-টুকটাক কেনাকাটা আছে। অনেক দিন পর বাইরে যাচ্ছি তো, তাই।
-কোথায় যাবি?
-ও, তোকে বলিনি না? এক সপ্তাহের জন্যে সুন্দরবন যাচ্ছি ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফির ওপর ওয়ার্কশপ করতে। তুই তো জানিস ছবি তোলা আমার হবি। আচমকা সুযোগটা পেয়ে গেলাম। তাই আর হাতছাড়া করছি না।
-ওয়াও! দারুণ ব্যাপার। যা যা, খুব এনজয় করিস। একাই যাবি?
-না অন্বেষা যাচ্ছে সঙ্গে।
-অন্বেষা কে?
-আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র। চিনিস না?
-ও হ্যাঁ, অন্বেষাদি। চিনব না কেন? তুই অন্বেষা বললি তাই বুঝতে পারিনি। ঠিক আছে চল পরে কথা হবে।
ফোনটা কেটে ভিক্টর কিছুক্ষণ চুপচাপ কলাভবনের সামনের ফাঁকা মাঠটায় বসে থাকল। ছাত্রছাত্রীরা এখনও তেমন কেউ আসেনি। মাথার ওপর ঘন নীল আকাশ। সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে গায়ে। কোনও একটা গাছের ডালে বসে ঘু ঘু ডাকছে একভাবে। নিজের ভাবনার ভেতর এতটাই ডুবে ছিল ভিক্টর যে টের পায়নি কখন পেছনে অন্বেষা এসে দাঁড়িয়েছে। ভিক্টরের কাঁধে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে অন্বেষা বলল, তুই এখানে? আর আমি কখন থেকে তোকে হস্টেলে খুঁজছি। ফোনটাও বিজি আসছিল।
অন্বেষার গলা শুনে মুখ তুলে তাকাল ভিক্টর। তার দু’চোখ জলে ভরা। অন্বেষা হাঁটু গেড়ে বসে দুহাত দিয়ে ওর মুখটা তুলে ধরে বলল, কী হয়েছে তোর? চোখে জল কেন?
ভিক্টরের বুকের ভেতর যেন একটা বাঁধ ভাঙল। এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা কষ্টটা এবার প্রবল উচ্ছ্বাসে বেরিয়ে এল বাইরে। অন্বেষাও পরম মমতায় তাকে বুকে টেনে নিল। একটা অপূর্ণ প্রেমের গল্প শুনতে শুনতে কবে যেন সেও জড়িয়ে গিয়েছে প্রেমের জালে। ভিক্টরের দুঃখ সামাল দিতো দিতে বেসামাল হয়ে গিয়েছে সে নিজেও। বছর দুয়েকের ছোট ভিক্টরকে সে মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসে ফেলেছে। ভরিয়ে দিয়েছে আদরে সোহাগে। মনে মনে অন্বেষা শপথ করেছে, স্বয়ংদ্যুতির কারণে যত কষ্ট ভিক্টর পেয়েছে সব সে ভালবাসা দিয়ে দূর করবে। হাজার সমস্যা এলেও ভিক্টরের হাত সে ছাড়বে না কখনও।
অন্বেষার মতো এমন ব্যতিক্রমী মনের মানুষকে পেয়ে অবাক হয়েছে ভিক্টর। আর পাঁচটা মেয়ের থেকে সে একেবারে আলাদা। তার বাইরেটা যতটা কঠিন ভেতরটা ঠিক ততটাই কোমল। ভিক্টরকে ছায়ার মতো আগলে রাখে অন্বেষা। যখনই স্বয়ংদ্যুতির কথা ভেবে ভিক্টরের মনখারাপ হয় তখনই তাকে ভালবাসার আলিঙ্গনে আঁকড়ে ধরে। পরম মমতায় চুমু এঁকে দেয় কপালে, ঠোঁটে, গালে। আর ভিক্টরও এমন স্নেহের আশ্রয়ের কাছে নতজানু হয় বারবার।
আগামীকাল ভোর ভোর বেরিয়ে পড়বে তারা। ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপের পাশাপাশি সুন্দরবনের উদ্দাম বন্য জীবনকে উপভোগ করবে চুটিয়ে। পরিচিতির গন্ডি ছাড়িয়ে এক অচেনা জগতে একে অপরকে জড়িয়ে কাটাবে কয়েকটা দিন। নতুন প্রাপ্তির আনন্দে ভুলে যাবে এতদিনের অজস্র না-পাওয়াকে। মাতলার জলে বিসর্জন দেবে যত রাগ-দুঃখ-অভিমান। স্থবিরতা ভুলে পা বাড়াবে এক নির্ভার, নিঃসীম, বর্ণিল স্বপ্নের পথে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴