শূন্য আমি পূর্ণ আমি/১৬
শূন্য আমি পূর্ণ আমি
পর্ব : ১৬
অমর চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
কত বছর হয়ে গেল। আমি এক যুবক তবু নদীর সাথে দেখা হল না! কেন এই কথা! কেন এই উপমা! দেখছি কল্লোলিনী যুবতীকে প্রায় কবিরাই নদীর উপমা করেন। কমলদার (কমল চক্রবর্তী) একটি কবিতায় পেয়েছি 'সেই নদী অন্য কারো বুকে নেই'!
রবীন্দ্রনাথ নারীরূপের কাব্য লেখেননি, নারী প্রেমের কাব্য লিখেছেন। সে প্রেম পুরুষের প্রেম। কড়ি ও কোমল-এ কবি যদিও দেহ সুধারসে মগ্ন হয়েছিলেন। রূপচেতনা থেকে একটু সরে এসেছিলেন এবং মহুয়া কাব্যে মদিরময় প্রেমের বাণী লিখেছেন। জয়দেব বা সংস্কৃত কাব্যের রূপচেতনা থেকে সরে এসেছিলেন সার্বভৌম কবি। কিন্ত নারীর রূপ ও রাগে মেতে রইলেন ছোট বড় কবিরা। আমাদের পিতৃপুরুষ মৈমনসিংহের আর শৈশব থেকে মায়ের মুখ থেকে মৈমনসিংহের গীতিকা শুনে শুনে আশ্চর্য সুর ও শব্দের মায়ায় পড়ে গেলাম। 'কোথায় পাইবাম কলসী কন্যা, কোথায় পাইবাম দড়ি/তুমি হও গহীন গাঙ, আমি ডুইবা মরি'। এমন এক নদী এসে গেল আমার জীবনে। কাবেরী নামে এক নদী ছিল অহংকারে টুইটম্বুর! কেননা সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী। তার গানের ভিতর দিয়ে আমিও দেখতে শুরু করলাম ভুবনখানি। কিন্তু দূর থেকে। সবটাই কল্পনায়। কল্পনায় তুষার রায়-এর মতো ভাবতাম 'মৃদু লাস্যের কম্পনে ঝরে যায় গায়ে মাখা শাড়ি'। আমারো অনেক কবিতা লেখা হয়ে কাবেরীকে নিয়ে। রাত জেগে অনেক পত্র। সেই পত্র তো পৌঁছাতে পারিনি। কুদর্শন ছিলাম না কিন্তু আমরা যে অত্যন্ত গরীব! সুতরাং তুমি কল্পনা করো।রিলকের কবিতার মতো লিখতে থাকো 'আর সেখানে, তার নাভির অপরিসর ভান্ডে/জমে উঠল এই প্রাণ-- তিমিরলিপ্ত, উজ্জ্বল।...ঢেউ তুলল ঢেউ তুলল নিরন্তর সেই কটিতটের দিকে, যেখানে মাঝে মাঝে ঝিলিক দিচ্ছে একটি নিঃশব্দ জলরেখা। না আর না! আপন নারীর সৌন্দর্য কল্পনা কবিরা এভাবেই করে থাকেন। আমি রিলকের কবিতার পাতা খুলে কাবেরীকে এই কল্পনায় আনতে চেয়েছি। পারিনি! দারিদ্র্য এমন খেয়াঘাট যেখানে নদীর কল্লোল থাকে না। বরং ভাবতাম কাবেরীর কলেজে যদি অধ্যাপক হয়ে যেতাম। আমার লেকচার ও গালে হাত রেখে শুনছে! ক্লাসের ঘন্টার পর যখন স্টাফরুমে যাচ্ছি কাবেরী এসে দাঁড়ায় বলে, স্যার আমাকে বাড়িতে পড়াবেন? আমিও তো এই চেয়েছি কাবেরীকে একান্ত পেলে খুব বোঝাবো শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের নৌকা খন্ড, বিদ্যাপতি, লোর চন্দ্রানী। বোঝাবো 'প্রেম বিনে ভাব নাহি, ভাব নাহি ভাব বিনে রস/পৃথিবীতে যত দেখো প্রেম হন্তে বশ।
না আমার কলেজে পড়ানো হল না, চিত্রপরিচালক হতে পারলাম না! হয়ে গেলাম স্কুল শিক্ষক। আর এক আনন্দময় জীবন, তৃপ্তির আস্বাদন। এখন ভাবি ঈশ্বরের কি পরম করুণা। আজ যে এত কথা লিখতে পারছি সে ঐ স্কুলে পড়াতে গিয়েছিলাম বলে।যার ঐকান্তিক আমন্ত্রণে এই কলম সেই অমিত কুমার দে আমার কৃতী ছাত্র। এই প্রসঙ্গে পরে আসব।
কাবেরীকে নিয়ে নিরর্থক কল্পনা বেড়েই চলল। লিখতে শুরু করলাম একের পর এক কবিতা। একদিন আগুন ছুঁয়ে ফেলব। তুমি ফুল ফোটাবে তো? দেখো দরোজার বাইরে তোমার প্রিয় পুরুষ। এগুলো একটাও ছাপিনি! যাই লিখি মনে হয় কিচছু হয়নি। শেষ ভয়ংকর লেখা, একটা বড় বন্যা হোক সবাই ডুবে যাক/আমরা দুজন এক দ্বীপে আদম ইভ। না এটাও ঘটেনি। কবিতাটা খুঁজলে এখন হয়তো পান্ডুলিপির ট্রাঙ্কে খুঁজে পাব। খুঁজি না আর। কাবেরী নদী সমুদ্র সেনে মিশে গেছে। নদী ও নারী সমার্থক এভাবেই হয়েছে হয়তো! অনেক প্রতারিত বা বঞ্চিত যুবক বোধহয় ভাবে এভাবেই নারী নদী। দরোজা খোলা পেয়েই সমুদ্রে পাড়ি।
কাবেরী চলে যাবার পর আমার নদী ভাবনায় এলো নদী নারী তবে মাতাই প্রথম। সভ্যতা নদীমাতৃক। তার স্নেহসিঞ্চিত জলেই সৃষ্টি। সে কখনো রাক্ষসী হয়। শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি থাকে না। আমি মাকে হারিয়েছি শৈশবে, যাকে প্রেয়সী ভেবেছি তাকে পাইনি।নদী আমাকে তিনবার গ্রাস করতে চেয়েছে কোনোরকমে হাত ছাড়িয়ে বেঁচে আছি। এক জ্যোতিষী বলেছিলেন তোমার লগ্নে চন্দ্র জলে মৃত্যু। মানে জলে ডুবে? না শরীরে জল হতে পারে। তাই তো ক্লাস সিক্সে নেফ্রাইটিস। এখন ইউরিক এসিড। মাঝে? দুবার তোর্ষা একবার গদাধর নদীতে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়া। আরব সাগরে (মুম্বাই) অজন্তা ইলোরা দেখে ফেরার পথে সমুদ্রের জোয়ার দেখে নীল হয়ে যাওয়া। চিল্কাতে মুক্তো সাম্রাজ্য দেখতে গিয়ে মাতাল নৌকাচালক মোহনায় নিয়ে যায়। এদিকে আকাশ ভেঙে নেমে আসে। কে বাঁচালো? জয় জগন্নাথ। সেদিনের সেই ছেলেটি যে প্রসাদ বললে খেত না! সেই বলে উঠেছিল জয় জগন্নাথ। আমার নদী তোর্ষা তোমার কথা রয়ে গেল। কাবেরী নদীকে স্পর্শ করতে পারিনি কিন্তু প্রিয় কবিতার বই হয়েছিল গৌরাঙ্গ ভৌমিকের 'অন্তর্গত নদী' শৈলেশ্বর ঘোষের 'দরোজা খোলা নদী'। তবে আজো আমি নদীর নামে কোনো নারীকে আপন করি না, প্রণাম করি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴