শালসিঁড়ি-১৬/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-১৬
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^^
দুই দুটি বছর ভিভিআইপি প্রশিক্ষণের পর গ্রামের আলপথে সাইকেল যাত্রা। সারারাত্রির রেলযাত্রা তারপর বাসযাত্রা - তাও ঠিক ছিল। বাস থেকে নামার পর যিনি সাইকেলসহ সাদর আমন্ত্রণ জানালেন তাকে দেখে বোঝা গেল না সাইকেলকে উনি ধরে আছেন; নাকি সাইকেল ওনাকে ধরে আছে। মানুষটি বয়স্ক এবং রুগ্ন। তারপর মনে হল সকালেই এনার্জি বুস্টার খেয়েছেন।
মনে হল জেলা সদর থেকে রেঞ্জ দপ্তরে বাসের নাম ধরে বিকাশের শারীরিক ও মালপত্রের বর্ণনা আগাম দেওয়া ছিল। নাম জিজ্ঞাসা করাতে কা- নাকাইলা বলল বিকাশ বুঝতে পারেনি। সেই বোঝাবুঝির ব্যাপারে না গিয়ে হোল্ডলটা সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে নিল। তারপর আকারে-ইঙ্গিতে যা বুঝতে পারল - বাঁদিকে কিছুটা গেলে রেঞ্জদপ্তর।
- আপনি এসে গেছেন।
- বড়বাবু কোথায় আছেন।
- ভিতরে। আসুন।
- নমস্কার, স্যার।
- পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো।
একজন মহিলা কর্মী চিনামাটির ফিল্টার থেকে এক গ্লাস জল, চা,বেকারি বিস্কুট দিল।
- শোন, যেখানে বাসে নেমেছ সেখান থেকে যে কাঁচারাস্তাটি পুবদিকে ধানখেতের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে সেটা ধরে প্রায় সাত কিলোমিটার যাবার পর চাবাগান আসবে। চাবাগান দিয়ে প্রায় দুই কিলোমটার যাবার পর বন আসবে। বনের ভিতর দিয়ে পাঁচশ মিটার গেলে তোমার থাকার ও কাজের জায়গা। সময় বেশি নেই - তারপর কালবৈশাখীর সময়; কখন ঝড়বৃষ্টি আসবে বলা যায় না।
- স্যার।
বিকাশ জানে সুরঞ্জনস্যার ওর থেকে পাঁচবছর আগে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এই চাকরিতে জুনিয়র-সিনিয়ার প্রশিক্ষণের সাল ধরে হয়। অবশ্য এমনিতে বয়সে বিকাশ সুরঞ্জনের থেকে অনেকটা ছোট। তাই মনে মনে একটা আশা ছিল এতটা পথ জার্নি করার পর রেঞ্জসদরে আজ রাতটা থাকতে পারবে। কিন্তু সেটা হবার নয়; আবার নয়-দশ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হবে। স্নেহ কী এত বায়বীয়!এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল বিকাশের মনে - লটকাফলের স্বাদের মতো। না টক না মিষ্টি। কোথায় কারশিয়াং দেরাদুন তাজ জুহু দিল্লি আর কোথায় মুহুরিজোতের একফসলি মাঠ।আলপথের দুইধারে মাঠ দেখে মনে হচ্ছিল- প্রেম ও প্রেমিকহীন এক নারী। সেই কবে হাতের স্পর্শে কেটে নিয়েছে বুকের ফসল-শরতে। তারপর কতদিন বুক ক্ষতবিক্ষত হয়েছে গৃহপালিতের খুরে হেমন্তবসন্তশীতগ্রীষ্মকালে। জমির আলগুলো যেন মাহুতের গলার গামছা - যা বুকে চেপে মাহুতের বৌ কাঁদে কবে আবার মাহুত আসবে ফিরে। মাহুতের স্ত্রী আর সেচহীন জমি তো এক; যাপনে ও স্বপনে। চারদিকের হালকা সবুজ মাঠ যেন ফিসফিস করে বলে - কালবৈশাখীর বৃষ্টি যেন মাহুতের আগমনের পূর্বানুমানে নিঃসৃত পূর্ব-রাগরস; ফুলের মধুর মতো। এদিকসেদিক চরে বেড়ানো গরুর গলার ঘন্টার ধ্বনি যেন তার আগমনবার্তা। তবুও কোথাও কোথাও দীর্ঘ বিরহবেদনা যেন ফুটে আছে অনুজ্জ্বল ভাটফুলে। কতদিন কেউ কর্ষণ করেনি এই জমি।
একটি গরুকে ধাক্কা দিতে গিয়ে বিকাশ কোনোরকমে সাইকেলের টাল সামলায় মাঠের আলপথে। বিকাশ নিজেকে নিজে মনে মনে প্রশ্ন করে - দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রার পরও মনে সাহিত্য আসে। তাহলে কী দুবছরের কঠিন প্রশিক্ষণ শুষে নিতে পারেনি স্কুলকলেজের দেয়ালপত্রিকা লেখার অভ্যাস। ক্ষুধায় অবসন্ন মন যেন ভাটফুলের মতো হাসে। পিছনের সূর্য ক্রমশ আলো কমাতে কমাতে হয়ে উঠছে রঙিন। বিকাশ পিছনে ফিরে দ্যাখে। সূর্য আলোকের গোলক থেকে বেরিয়ে এসে নিজের রূপ নিয়েছে। কী সুন্দর সোনার থালার মতো- নিজের হাতে লাগানো প্রথম ফোটা গোলাপ ফুলের মতো- প্রথম যেদিন অপরূপাকে কলেজের মাঠে গ্রীষ্মের তাপদাহে একলা দুপুরে অগ্নিবর্ষী কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় বলেছিল : “আমি কিন্তু তোকে ভালোবেসে ফেলেছি অপরূপা”- সেদিনের অপরূপার কপালের টিপের মতো। মাথা থেকে ছড়িয়ে থাকা চুলের মতো মাঠের চারদিক থেকে ক্রমশ কমে আসা গৃহপালিতের খুর-রেখা ধরে গৃহপালিতেরা ফিরছে পশ্চিমের দূরে ঐ গ্রামে। বিকাশ ভাবে - আচ্ছা, গৃহপালিতেরা কী তাদের খুর-রেখা চেনে; তারা কী নিজের নিজের খুর-রেখা ধরে প্রতিদিন ঘরে ফেরে; গন্ডার গাউরের মতো। কত কী অজানা; কত কী জানতে হবে জীবনে। কতগুলো একবস্ত্রধারী সিলুয়েট নারী মাথায় বড় বড় কাঠের বোঝা নিয়ে ফিরছে ঘরে পশ্চিমের ঐ গ্রামে। বিকাশের সাইকেল থেমে যায়- দাঁড়িয়ে পড়ে মাঠে। মেয়েরাও এত বড় বোঝা বইতে পারে!
অপরূপার সাথে কলেজ বাঙ্ক করলে তো বইয়ের ব্যাগ বইতে হতো সবসময়।বইয়ের ব্যাগকে কখনো কখনো পুরো শরীরের ভার ছেড়ে দিত বিকাশে উপরে। ভালোবাসায় কত আস্থা- ডুমুরের ফুলের মত। এই নারীর বোঝা কিসের বোঝা বিকাশ জানতে চায়। গোধূলিতে কনে দ্যাখার মনোরম আনন্দ বিকাশ পাবে না আর কোনোদিন; বিকাশ জানে সেই আনন্দ চিরতরে চুরি করে নিয়েছে কলেজ মাঠের কৃষ্ণচূড়া গাছ। মেদহীন সিলুয়েট নারীর বুক চুরি করে দেখতে চায় বোঝার চাপে গোধূলির আলোয় কেমন দেখতে হয় এই নারীর মুখ। দেখা যায় না কিছু। দ্যাখে খুর-রেখার ধূলাতে নারীর পায়ের ছাপ আর…
বিকাশ সাইকেল চাপে আবার। প্যাডেল চাপে জোরে আরো জোরে- ওকে যে আলো নেভার আগে পৌঁছাতে হবে জীবনের প্রথম কর্মস্থলে। গোধূলির নরম আলোতেও বিকাশের ঘাম আসে। নরম আলো যে এত ভয়ংকর হতে পারে বিকাশের জানা ছিল না। তবে গোধূলির নরম আলোয় যে রোমাঞ্চ বিকাশ পেয়েছিল তা মনে থাকবে আজীবন। সেই ঘটনা অপরূপাকে বলার পর অপরূপা যেমন জোরে জাপ্টে ধরেছিল - তার নখের দাগ শরীর থেকে মিশে গেলেও মিশে যায়নি মন থেকে…
- …আমাদের ফিল্ড ট্রেইনিং ছিল আসামের মানস অভয়ারণ্যে বা বিশ্ব ঐতিয্য ক্ষেত্রে।ফিল্ডক্লাস ছিল প্রি-লাঞ্চ; পোষ্টলাঞ্চ সেশন ছিল জার্নাল লেখার সময়। আমরা কয়েক বন্ধু জার্নাল লেখা বাদ দিয়ে চললাম মানস নদীর পাড়ে ঘাস,খয়ের গাছের বনে। আমার কাছে ছিল স্টাইপেন্ডের টাকা বাঁচিয়ে কেনা ছোট্ট একটা এ্যানালগ ক্যামেরা।
- তোমাদের বড্ড সাহস তো। শুনেছি সেই বনে বাঘ থাকত।
- থাকত কী; এখনো আছে। আর সাহসের কথা বলছ। সেটা আমাদের কয়েকজনের খুব ছিল।
- তারপর?
- মানস নদীর ডানপাশে খয়ের, ঘাসের বন বাঁদিকে ভুটানের পাহাড়। আমরা পশ্চিম-উত্তর দিক ধরে হাঁটছি। তখন থেকে কিছু কিছু পাখি চিনতে শুরু করেছি। কত পাখি এখনো চিনতে পারি না। হাঁটছি আর কত কি পাখির ডাক শুনছি সবাই চুপচাপ। মনে হল একজোড়া রাজধনেশ উড়ে গেল খয়ের বন থেকে ভুটান পাহাড়ের দিকে। রাজধনেশের ওড়ার সোঁ-সোঁ শব্দ পরিষ্কার শোনা যায় বোঝা যায়। অন্য পাখিরাও উড়ছে কিন্তু ওড়ার শব্দ শোনা যায় না। শুধু নানা পাখির ডাকাডাকির মিষ্টিমন্দ শব্দ কানে আসে।
- পাখিদের ডাক মিষ্টি হয় জানি; মন্দ হয়!
- হয় তো। কিছু পাখির ডাক খুব খারাপ শুনতে হয়। কিছু পাখির ডাক তো রীতিমত রাতে ভয় জাগায় মনে।
- তারপর?
- হাঁটতে হাঁটতে খয়েরবনের মধ্যে একটা অন্যরকম জায়গায় এসে হাজির হই। জায়গাটা একটু সেঁতসেঁতে ; মাটি নরম বিকালের সূর্যের নরম আলোর মতো। মনে হয় এই জায়গা দিয়ে আগে কোন সময় মানসনদীর কোন এক ধারা বয়ে গিয়েছিল। নদী চলে গেলেও নদীকথা জেগে থাকে- বীজের ভিতরের শাঁসের মতো। জল চলে যায় কিন্তু জন্ম দিয়ে যায় কত কী। মাটিতে সবুজ ছোটছোট ঘাস। খয়েরগাছের অনেকটা জায়গা দখল নিয়েছে বড়পাতার অন্য একটা গাছ।
- কী নাম?
- তখন কী গাছের এত নাম জানতাম। তাই গাছটাকে চিনতে পারি নাই। গাছের পাতাগুলো যেন- মা যে হাতা দিয়ে ভাত দিত সেই হাতার মাথার মত। ঠিক গোল নয় কিন্তু গোলের মতো। গাছটির গায়ে উপর থেকে নিচের দিকে অনেক লম্বা চেরা দাগ।কিছু বাসী কিছু টাট্কা।বাকলের গাঢ় বাদামি রঙ যেন চেরা দাগে উঁকি মারছে। হঠাৎ কতগুলো হরিণ ছুটে গেল বাঁদিক থেকে ডান দিকে। মনে হল জল খেতে যাচ্ছে মানস নদীতে। কত সুখী ছিল ঐ সব প্রাণ সেই বিশুদ্ধ বনপ্রান্তে। ঠিক তোমার দুই বাহুর মাঝে শুয়ে থাকার মত।
অপরূপার সেদিন পড়ন্ত বিকালে পাহাড়ে খাদের কিনারে কী হয়েছিল কী জানি। গোধূলির নরম আলো রমণীয় করে তুলেছিল অপরূপার গাল ঠোঁট চোখ। বিকাশকে জড়িয়ে ধরে ছিল শ্বাস বন্ধ করে-জোরে। এতজোরে চেপে ধরেছিল যে অপরূপার নখ বিঁধে যাচ্ছিল বিকাশের পিঠে। অপরূপা বলে ওঠে-
- আর তো একটা মাস। তারপর তোমার কনভোকেশন। তারপর আমরা একসাথে থাকবো। চাকরিটা ছেড়ে দেব বিকাশ।
- আরে সে হবেক্ষণ। এখন তো আমাকে ছাড়। তুমি যে আমাকে মানসের বাঘের মতো চিরে দিচ্ছ।
অপরূপা বিকাশকে ছেড়ে দেয়; যেন পাহাড়ের খাদের ধার দিয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নেয়। উৎকণ্ঠায় বলে ওঠে-
- তোমরা বাঘ দেখেছিলে- রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার!!!
- হ্যাঁ তো।
- কীভাবে।
- আমাদের সেদিন কী হয়েছিল জানিনা। অনেকটা বোকামিই হয়েছিল বলতে পারো। সূর্য ডুবে যাওয়াতে শুধু লাল আভাটা খেলা করছিল আকাশে- হাওয়ায় দোল খাওয়া পলাশবনের মত। আমাদের যে আবার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ফিরতে হবে- সেকথা খেয়াল হয়নি কারো। হঠাৎ আমাদের পেছনে- যেখানে বড়পাতার গাছটা ছিল সেখানে ডেকে উঠল কতগুলো ময়ূর; বিশ্রীভাবে। আমরা সবাই ফিরে তাকালাম সেই গাছটির দিকে।
- কী দেখলে?
- পশ্চিমের বিচ্ছুরিত লালহলুদ আলোতে গাছটির গা দ্যাখা যাচ্ছিল পরিষ্কার। গাছের গায়ে উপর থেকে নিচের দিকে চেরা গাঢ় বাদামি দাগগুলো চিকচিক করছিল। সে সব ছাপিয়ে দ্যাখা যাচ্ছিল হলুদকালো ডোরাকাটা দাগের একটা প্রাণী পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে সামনের দুই পা দিয়ে চিরে দিচ্ছিল সেই গাছটির বাকল। আমাদের সবার চোখ তখন হাঁসের ডিম। সবাই ফ্রিজ হয়ে পড়ি ক্ষণিকের জন্য মানসের চরে পড়ে থাকা বড়বড় পাথরের মত। আমাদের একজন বলে ওঠে - সর্বনাশ; এ-যে বাঘ। আমরা যে ঐ দিক দিয়ে এলাম একটু আগে। ফিরতে হবে ঐ দণ্ডি দিয়ে।
- তারপর?
- তারপর আর কী। অন্ধকার নেমে আসছে। দেখতে পাই বাঘটি গাছটির গায়ে প্রস্রাব করে কোথায় যেন মিশে গেল বনে। আমরা দণ্ডি ধরে ক্যাম্পে ফিরতে হাঁটতে থাকি সাবধানে।
- ভয় লাগেনি?
- ভয় কী। আনন্দ শিহরণে সেই এক অবর্ণনীয় রোমাঞ্চ। একসাথে থাকলে ঘোর বিপদের আশঙ্কায়ও শিহরণ জাগানো রোমাঞ্চ আসে মনে…
আজকে নারীদের পায়ের ছাপের পাশে সামান্য একটা হাতির পায়ের ছাপ দেখে ঘাবড়ে গেল বিকাশ। একা লড়াই করা কত শক্ত – সাক্ষী থাকে না কেউ। একঝাঁক বক যেন অন্ধকার বুকে বয়ে নিয়ে এসে বসে চাবাগানের ছায়াগাছে। সূর্য ঢুকে গেছে গ্রামের বাঁশঝাড়ের পিছনে। অন্ধকার যেন চাগাছের কালোসবুজের পাতায় পা দিয়ে কালো শিরিষগাছের কালো গা বেয়ে উপরে উঠে আসছে আকাশ দখল করতে। আখের মত নিজের সব শক্তি নিংড়ে নিয়ে সাইকেল চালায় বিকাশ। আরো দুই কিলোমিটার পথ যেতে হবে সন্ধ্যার আলো থাকতে থাকতে। বিকাশের মনে হয় অপরূপা যেন পিছন থেকে সাইকেল ঠেলে। বিকাশের ভয় হয় পিছনে দেখতে। বিকাশ শুধু আগে রাস্তা দ্যাখে।
বিকাশের সাইকেল থামল দাড়িভিজা নদীর পারে। ভিজা মাটিতে দাঁড়াতে গিয়ে পা হড়কে যায় বিকাশের। সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে পড়ে গেল হোল্ডল। কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে হোল্ডলটা বেঁধে নিল আবার সাইকেলে। নদীতে কত জল জানেনা বিকাশ; আজ রাতে কী হবে- অনেক কিছুর মত। বন থেকে নদীতে ঝুঁকে পড়া কতগুলো গাছে হাজার হাজার জোনাকিরা শুরু করেছে প্রেমলীলা খেলা। একসাথে নিভছে আর জ্বলছে। ভয়ে মায়াবী পরিবেশকেও ভূতুড়ে মনে হয়। হাতিরা তো এই সময়ে বন থেকে পথ ধরে বেরিয়ে আসে চাবাগানে গ্রামে। বিকাশ তখন ভয়ে অকুতোভয় হয়ে পড়ে। সাইকেলের ওজনে সমতা এনে সাইকেল কাঁধে তুলে নেমে পড়ে নদীর জলে। বনের ভিতর প্রহসন শুরু করেছে নানা পতঙ্গ। ধাতব শব্দে যেন ধমক দিচ্ছে রাতচরা পাখি। বিকাশ ভাবে-সত্যি ভুল করে ফেলেছে অপরূপার চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে সম্মত হয়ে। সদলবলে বনে বাঘ দ্যাখা আর একা বনে থাকা এক নয়। অন্ধকারে রাস্তার কাছাকাছি কোথায় যেন একটা গাছের ডাল মটমট করে ভেঙে পড়ল। বিকাশ জানে হাতিরা এইভাবে বনে গাছ ভাঙে। ভয়ে ক্ষুধায় ক্লান্তিতে বিকাশের যেন বুকের পাঁজর ভেঙে পড়ে। মনে হয় ওর পিছনে কেউ যেন আসছে। বিকাশের সাহস হয় না পিছনে ফিরে দেখার। দ্যাখে দূরে ক্ষীণ আলোবিন্দু। হ্যারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন কর্মী…
- অনেক দেরি করে ফেলেছেন স্যার।
কর্মীটি সাইকেল ধরল। হোল্ডল নামিয়ে নিল। বিকাশের মনে হল শরীরের হাড়মাংস আলাদা। কোনো জোর নেই গায়ে। দীর্ঘ চব্বিশ ঘন্টা কোন ভারী খাওয়ার শরীরে যায়নি। কষ্ট করে গলায় জোর এনে গলা গম্ভীর করার চেষ্টা করে বলে…
- আপনার নাম কি?
- কাবু; কাবু লেপচা।
- আপনি জানতেন আমি আসব।
- হ্যাঁ সার; আর. টি. তে খবর আসছিল।
- আচ্ছা।
- স্যার, আপনি কিন্তু খুব রিস্ক নিয়েছেন। এই বনে এখন অনেক হাতি আছে। গতকাল চাবাগানের একজন মানুষ মাশরুম খুঁজতে বনে এসে হাতির সামনে পড়ে;ভগবানের দয়ায় বেঁচে যায়। চলেন, চলেন, আপনাকে ঘরে নিয়ে যাই।
কাঠের খুঁটির উপর একটা সম্পূর্ণ কাঠের ঘর; চাল ঢেউ খেলানো টিনের। এক রুমের এই ঘরে দক্ষিণের জানালার ধারে একটা তক্তপোষ; পাশে একটা কাঠের টেবিল আর একটা কাঠের চেয়ার। দরজার সামনে কাঠের বারান্দা। কাবু তক্তপোষের উপরে হোল্ডলটা রাখে। হ্যারিকেনটা টেবিলের উপর রেখে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। বিকাশ বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বিকাশের মনে হয়না যে ও বনে আছে। ওর মনেহয় অন্ধকারের কালো সমুদ্রে একা বসে আছে কাঠের একটা নৌকায়। এই নৌকা যেন ভেঙে যাবে সামান্য একটা ঢেউএর ধাক্কায়। কালবৈশাখী কালে ভ্যাপসা গরমে প্রাণ হাঁসফাঁস করছে। স্নান করতে পারলে ভালো হতো। মনে মনে ভাবে – অনেক হয়েছে বনে চাকরি করা। কাল সকালে উঠে পালাতে হবে। অপরূপা চাকরি ছেড়ে দিয়ে থাকলেও জানা যাবে না এখান থেকে। যা হবার হবে…
- স্যার; আপনার রাতের খাওয়া। আমার ঘরে করে রাখছিলাম। ডিমের ঝোলভাত। গরম করেএনেছি; তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। কালকে বাগানে হপ্তার হাট আছে। আপনাকে নিয়ে যাবো বাজার করাতে।
- স্নান করা যাবে?
- যাবে স্যার। তবে জঙ্গলের জল খুব ঠাণ্ডা। আমি আপনার জন্য জল গরম করে আনি।
- ঠাণ্ডা জলেই হবে।
- না স্যার; আপনি কিছু জানেন না। আপনার শরীর খারাপ হতে পারে। আপনিতো এখন ছোট্ট চারাগাছের মত। আপনাকে কত কী শিখতে হবে শালসিঁড়ি থেকে…
বিকাশ স্নান সেরে গরম ডিমেরঝোল দিয়ে ঠাণ্ডা ভাত খায়। সেই এক অপূর্ব স্বাদ। বিকাশের মনে কেমন যেন মায়া জন্মায়…
- স্যার আপনি উঠেন। আমি থালা নিয়ে যাচ্ছি। এটা তো আমার থালা। কালকে থেকে আপনার সবকিছু ব্যবহার করবেন।
- আচ্ছা।
বিকাশ ভাবে – না, মায়ার ছলনায় পড়া যাবে না। মায়া হল ছায়ার মতো ধরা যায় না আবার পিছু ছাড়েও না। কিন্তু ঐ ডিমের ঝোলের স্বাদের যে কোন কথা হবে না…
- বাবা কি ভাবছ? চল বাজারে যাবে না?
- হ্যাঁ হ্যাঁ চল…
(ছবি : ইন্টারনেট)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴