ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-১৬/মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১৬)
মৈনাক ভট্টাচার্য
শর্বরী রায়চৌধুরীর পোট্রেট ভাস্কর্য : ‘রামকিঙ্কর’-‘বড়ে গোলাম আলী’মাথার স্টাডি
আঁচল ঈষৎ সরে গেছে বুক থেকে-এর নাম বিস্রস্ত,
এ রকম হয়
পেটের মসৃণ ত্বক, ক্ষীণ চাঁদ নাভি, সায়ার দড়ির গিট
উরুতে শাড়ীর ভাঁজ, রেখার বিচিত্র কোলাহল
পদতল-আল্পনার লক্ষ্মীর ছাপের মতো
এই নারী
নারী ও ঘুমন্ত নারী এক নয়
এই নির্বাক চিত্রটি হতে পারে শিল্প, যদি আমি
ব্যবধান টিক রেখে দৃষ্টিকে সন্ন্যাসী করি
হাতে তুলে খুঁজে আনি মন্ত্রের অক্ষর
তখন নারীকে দেখা নয়, নিজেকে দেখাই
বড় হয়ে ওঠে বলে...।
রদ্যাঁ যখন তাঁর স্টুডিওতে কাজ করতেন, নিয়ম করে বেশ কিছু নগ্ন ও নগ্নিকা মডেলকে ঘুরে বেড়াতে হত আশপাশ দিয়ে। তাঁরা সবাই শিল্পীরই ভাড়া করা নয়ত ডেকে নিয়ে আসা মডেল। এই রেওয়াজ নিয়ে সে সময় খোদ ফরাসি সমাজেই অনেক হাসি মস্করা ছিল। কারন সেই সমাজ জানত না শিল্প শরীর নিংরে বের করে আনা মনের এক রস, তাঁরা তো কেউ তখন কবি সুনীল গাঙ্গুলীর ‘নারী ও শিল্প’ পড়েন নি, অবশ্য রদ্যাঁও পড়েননি। সে তো লেখাই হয়নি-তবুও, সময় আর শিল্পের অনুশাসন কোথাও তো এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাই রদ্যাঁর দর্শণ ছিল কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি সেই সব মডেলদের আলোছায়ায় দেহের বিভিন্ন পেশির সঞ্চালন লক্ষ্য করতেন। কোনো বিশেষ ভঙ্গি তাকে আকৃষ্ট করলেই সাথে সাথে তিনি মাটিতে ধরে নিতেন শরীরের সেই নির্দিষ্ট অভিব্যক্তি। এইভাবে শরীরের প্রতিটি পেশী ও তার উপর আলোছায়ার বিচিত্র সেই ভাষা শিল্প নির্মাণের সাথে মিলে মিশে যেত। এভাবেই সৃজনের নিজস্ব ভাষায় দেহের বাস্তবতা ও আত্মার স্বরূপকে এক সমান্তরালে নিয়ে গিয়েছিলেন অগুস্ত রদ্যাঁ। সমসাময়িক সৎ ক্রিটিকের ভাষ্যে তিনি তাই এমন একজন শিল্পী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন যে কিনা দেহের বাস্তবতা দিয়ে চৈতন্যের সমগ্রতাকে ধরতে চাইতেন।
আবার ব্রাঁকুসির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে হেনরি মুর একবার বলেছিলেন গথিক থেকে ইউরোপীয় ভাস্কর্য কেবল আগাছা জড়ো করে কলেবরেই স্ফীত হয়েছে। এই স্ফীতির তলায় শিল্পের শুদ্ধ রূপ সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গিয়েছে। ব্রাঁকুসির ব্রত ছিল ভাস্কর্যকে অনাবশ্যক এই স্থিত অবস্থা থেকে মুক্ত করে রূপের সারকে উন্মোচিত করা। এটা করতে গিয়ে ব্রাকুসি ভাস্কর্যের ধরনকে এক আধুনিক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।
জাগতিক নিয়মেই রামকিঙ্করকে শান্তিনিকেতনের কলাভবন থেকে অবসর নিতে হল ১৯৬৯এ। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও দিনকর কৌশিকের আহ্বানে সেই জায়গায় ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হলেন ছাব্বিশ বছরের তরুন ভাস্কর শর্বরী রায়চৌধুরী। কেননা ওই বয়সেই তাঁর পোট্রেট তৈরি খ্যাতি গুণীজনদের নজরে এসে গেছে। তাঁর ধারায় একটা প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে কোথাও রদ্যাঁ, কোথাও ব্রাঁকুসি আবার কোথাও হেনরি মুরের শিল্পবিপ্লবের এক মিশ্রণ হিসেবে। শিল্পী শর্বরীর খ্যাতি তৈরি হয়েছে ছোট কাজগুলির ভেতরে তাঁর মুনশিয়ানার ব্যাপ্তিতে। তাঁর কাজের এই সংবেদনশীলতা এই বয়সেই পরিণত হয়েছিল তাঁরই কাজের অন্তরঙ্গতার বিস্তৃতিতে। শান্তিনিকেতনে এসে শর্বরী ব্যাটন ধরলেন এমন একজন শিল্পীর দায়িত্ব বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, যাঁকে অবজ্ঞা করা যায়না গথিক সময় থেকে আজকের ভাস্কর্যের স্বাবালকত্ব প্রাপ্তিতে। তিনি রামকিঙ্কর বেইজ, তিনি উজ্জ্বল ফলকের মত ভারতীয় ভাস্কর্যের পথ চলার হিসেব নিকেশে হয়ে আছেন। চিরাচরিত এই সত্য অনস্বীকার্য যে, কোন দেশের ভাস্কর্যের শক্তিই আসে লৌকিক বা আদিম জনপ্রবাহের জীবন যাপন থেকে। সোজা সাপ্টা ভাবে যাকে মাইথোলজি বলতেই পারি। ভারতীয় ভাস্কর্যে একটা বড় শক্তির উৎসও এই আদিম জন প্রবাহ বা প্রচলিত লৌকিকতার পরম্পরায়, এক কথায় যা মাইথোলজি। এই পরম্পরা ধরে ভারতীয়তাকে আধুনিকতার ভাস্কর্য উত্তোরণও তো রামকিঙ্করের হাত ধরেই। ‘যক্ষ-যক্ষী’ রূপকল্প তার একটা উদাহরণ মাত্র। তাঁর আগের কাজগুলিতে পরোক্ষ প্রভাব থাকলেও ‘যক্ষ-যক্ষী’তে এসে আমরা অনেকটাই প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখতে পাই।
অসম্ভব সঙ্গীত প্রিয় মানুষ শর্বরী রায় চৌধুরী। এই মানুষটি ভাস্কর্যের পাশাপাশি সঙ্গীতে ডুবে থাকাকে অনেকে তাঁর ভাস্কর্য চর্চার ক্ষতিকারক প্রভাব হিসেবে বর্ণনা করলেন। তিনি বলতেন-“সঙ্গীতের বিমূর্ততা অন্য কোন শিল্পের মধ্যেও যে সঞ্চার লাভ করে তা আমি অনুভব করি। ব্যক্তিগতভাবে সঙ্গীতই পরিচালন করে আমার চেতনাকে তথা আমার সৃষ্টিকর্মকে। আমি সঙ্গীতের মধ্যেই ভাস্কর্যের সন্ধান পাই - সঙ্গীতের ভাস্কর্যরূপ প্রত্যক্ষ করি এবং নিজের কর্মে সেই শৈলি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি”। সঙ্গীতের লয়ের সাথে তার এই সম্পৃক্ততা তাকে ছন্দের একটি উচ্চতর অনুভূতি দিয়েছে, যা তার কাজের লক্ষণীয় এক ছন্দবদ্ধতা। তবে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে শিল্পী শর্বরীর করা রামকিঙ্করের পোট্রেট সহ বড়ে গোলাম আলী কিংবা সিদ্ধেশ্বরী দেবী'র মাথার স্টাডি।
অস্থির প্রকৃতির মানুষ রামকিঙ্কর নিজে পোট্রেট করতে খুব ভালবাসতেন এই সত্য সর্বজনবিদিত। তাঁর করা রবীন্দ্রনাথের কাজ যেমন ভারতীয় ভাস্কর্যের বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দু হয়েও মাইল ফলক হয়ে আছে তেমন বিখ্যাত হয়ে আছে আলি আকবর খাঁ, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র( যদিও রাগের বশে সুচিত্রা সেই কাজটি নিজেই নষ্ট করে অনুতপ্ত ছিলেন সমস্ত জীবন ধরে) রামকৃষ্ণের রিলিফ পোট্রেট ইত্যাদি। অথচ রামকিঙ্কর নিজের অনিহা ছিল মডেল হিসেবে সিটিং দিতে। তাই তাঁর উল্লেখযোগ্য পোট্রেট বলতে বলবীর সিং কটের করা কাজটির পাশাপাশি শর্বরী রায় চৌধুরীর করা রামকিঙ্করের পোট্রেট। তবে বলবীরের মত শিল্পী শর্বরীকেও তিনি নিজের ইচ্ছেয় সিটিং দিয়েছিলেন কেননা রামকিঙ্কর জানতেন তাঁর প্রতিভা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে ভাস্কর্য প্রবাহের এই শর্বরী ধারা। রামকিঙ্কর বিশ্বাস করতেন শর্বরীও তার মতই জানে পোট্রেট ভাস্কর্য আসলে কোন বাহ্যিক অ্যানাটমির বহিঃপ্রকাশ নয়, চরিত্রের ভেতরের রস নিঙরে সৃষ্ট এক শিল্প। শর্বরী তাঁর ভাস্কর্য আর সঙ্গীতের মিলনে এক নতুন ধারা তৈরি করতে পারবে সেটাও জানতেন। তাই তো আজও শিল্পী শর্বরীর হাতে অমর হয়ে আছে তাঁর পোট্রেট ‘রামকিঙ্কর’ এবং সাথে সাথে বড়ে গোলাম আলী, সিদ্ধেশ্বরী দেবী'র মাথার স্টাডি, ইত্যাদি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴