বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-১৬/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং,
পর্ব-১৬
ড. রূপন সরকার
দার্জিলিং পৌরসভার বহুমুখী কর্মকাণ্ডের ব্যয়ভার নেহাৎ কম ছিল না। এই বিরাট অংশের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন ছিল তার জন্য সরকারি ও বেসরকারি অনুদানের পাশাপাশি পৌরসভার নিজস্ব উৎস ছিল। দার্জিলিং পৌরসভা মূলত ঘৃহকর, জলকর (২%), বৈদ্যুতিক আলো বাবদ ধার্য কর (২.২৫%), কনসারভেন্সি ট্যাক্স, ল্যাট্রিন ট্যাক্স, জরিমানা বাবদ আয় ইত্যাদি থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতো। আমরা যদি ১৮৯১-৯২ সালের আর্থিক বর্ষের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো উক্ত আর্থীক বৎসরে দার্জিলিং পৌরসভার বিভিন্ন খাতে মোট আয় হয়েছিল ৪৬, ৯০০ টাকা, এর ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৮৯২-৯৩ সালে তা বেরে দাঁড়ায় ৫৪, ৩৩৩ টাকা। ১৮৯৫-৬৯ সালের আর্থীক বৎসরে পৌরসভার আয়ের পরিমান বৃৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৯, ৭২৫/- টাকায়।
দার্জিলিং শহরের শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জোয়াড় আসে। স্বনির্ভর গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির স্থলে শহুরে অর্থনীতি আবর্তিত হয় মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোৎপাদন, পেশাগত ও কর্মজীবী জীবিকাকে কেন্দ্র করে। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা চলে, অকৃষিজ অর্থনীতির বিকাশের সাথে সাথেই নির্দিষ্ট জনপদ শহুরে বৈশিষ্ট্য লাভ করতে থাকে। দার্জিলিংয়ের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছিল।
দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যাকে পেশাগতভাবে দুভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, যারা উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সরাসরি জড়িত, আর দ্বিতীয়ত, যাদের উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে সরাসরি কোন যোগাযোগ ছিল না, অর্থাৎ পেশাজীবী এবং কর্মজীবী শ্রেণির মানুষজন। যেহেতু শুরু থেকেই উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে দার্জিলিং শহরের তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না, সেহেতু শহরের অর্থনীতিতে মধ্যস্ততাকারি শ্রেণি হিসেবে ব্যবসায়ী শ্রেণি যা আবার বিভাজন অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে পরে তাদের ভূমিকা নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। দার্জিলিং শহরের অর্থব্যবস্থার সাথে জড়িত ব্যবসায়ি শ্রেণিকেও দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, যে সমস্ত ব্যবসায়ি শুধুমাত্র খুজরো ব্যবসার সাথে যুক্ত অর্থাৎ যারা শুধুমাত্র শহরের মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আদান প্রদানের সাথে যুক্ত ছিলেন, দ্বিতীয়ত, যারা পাইকারি ও সীমান্ত বাণিজ্যের সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে শহরকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়িক শ্রেণির উত্থান ও কর্মকাণ্ড বিশেষভাবে চোখে পরে ১৮৬৯ সালে হিলকার্ট রোড এবং আরো ভালোভাবে বলতে গেলে ১৮৮৯ সালে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের মাধ্যমে শিলিগুড়ির সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের পর থেকে। এছাড়াও উনবিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকের পর থেকে দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায় একের পর এক চা বাগানের বিস্তার দার্জিলিং শহরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভীষণভাবে অক্সিজেন দান করেছিল। চা উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করতে হতো এই দার্জিলিং শহরকে। ফলে চা বাগানের ম্যানেজার, করণিক, এরা সপ্তাহে একদিন করে শহরে আসতেন সারা সপ্তাহের ক্লান্তি দূর করতে, যা পরক্ষ্যভাবে শহরের অর্থব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করতো।
দার্জিলিং শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এবং স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য একদিকে যেমন ইউরোপীয়ানরা শহরে ভিড় জমাতে শুরু করে, তেমনি নিকট, দূর বহু জায়গা থেকে ভারতীয়রা শহরে আসতে শুরু করে। গ্রীষ্মকালে বিশেষকরে জুন, জুলাই মাসে পার্বত্য শহর দার্জিলিংয়ে একপ্রকার মানুষের ঢল নেমে আসে। শুরুতে নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে যদিও এই ভ্রমণ পিপাসু মানুষের সংখ্যা অনুমান করা অসম্ভব ছিল কিন্তু জনগণনা শুরু হওয়ার পর প্রাসঙ্গিক সেনসাস রিপোর্টের ভিত্তিতে দেখে যায় যে, বিংশ শতকের প্রথম দশকে এই সংখ্যাটি ছিল চার থেকে পাঁচ হাজারের কম নয়, তৎকালিক সময়া যা নজিরবিহীন। এই মানুষের আগমনে শহরের পর্যটন কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে দ্রুতগতিতে। এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল হোটেল ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি, স্থানীয় জিনিসপত্রের লেনদেন, বিশেষকরে করে গরমের জামাকাপড় এবং নানা রকম পরিষেবা মূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এই পর্যটন শিল্প নিঃসন্দেহে দার্জিলিংয়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম অবদান রেখে এসেছে। পর্যটন শিল্পের পাশাপাশি শৈল শহর হয়ে ওঠে পাশ্চাত্য শিক্ষার পীঠস্থান। বহু ইউরোপীয় ও সম্পন্ন দেশীয় পরিবারের সন্তান সন্ততিরা কেবলমাত্র শিক্ষা লাভের জন্য পার্বত্য শহরে আসতে শুরু করে। নিঃসন্দেহ এই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রয়োজনীয় সামগ্রী শহরের বাজার থেকে সরবরাহ করা হতো, যা পরোক্ষভাবে দার্জিলিং শহরের অর্থব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করে। এভাবেই প্রাথমিক বাধা অতিক্রম করে দার্জিলিং শহরের বাজার, ব্যবসা বাণিজ্য, অন্তর্দেশীয় তথা অভ্যন্তরীণ বিস্তার লাভ করে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴