বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।। ষোল।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^^
এতগুলো
পর্ব ধরে আমরা চায়ের জন্ম-ইতিহাস, চা-চাষ আর সেই গাছের পাতা থেকে কী করে
আমাদের প্রতিদিনের পানীয়-চা তৈরি করা হয় – তার একটা প্রথমিক ধারণা
পেলাম।এবার আমরা চা-শিল্পের ভিতরের গল্পের দিকে এগিয়ে যাব একটু একটু করে।
তবে, আগের পর্বগুলোর কিছু সংযোজন – যা বলা হয়ে ওঠে নি...
#
চায়ের
ছায়াগাছ (Shade Tree) হিসেবে জাফরি কাটা ক্যানোপি সমেত যে সব লিগুমিনাস
জাতীয় গাছে লাগানো হয় তাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন রকমের শিরীষ গাছ যেমন কালো
শিরিষ (Albizzia chinensis), সাদা শিরীষ (Albizzia procera), কাকুর শিরীষ
(Albizzia odoratissima), মৌহিতা শিরীষ (Derris robusta), এছাড়া Albizzia
lebbeck, Dalbergia sericea, Acacia lenticularis ইত্যাদি...
ছায়াগাছগুলোতেও
কিছু ক্ষতিকর পোকা-মাকড় আস্তানা গাড়ে। সেসব (এবং সঙ্গে শ্যাওলা) ঠেকানোর
জন্য প্রতিবছর শীতকালে গাছের গোড়া থেকে কান্ডের বেশ কিছুটা অংশ চুনগোলা
দিয়ে সাদা রঙ করে (white wash) দেওয়া হয় – যা বিশেষ কিছু পতঙ্গের প্রতিরোধক
হিসেবে কাজ করে। এতে সেখানে আর পোকারা ডিম পাড়তে পারে না। শীতকালে
বাগানজুড়ে, যেন কোমর পর্যন্ত লম্বা সাদা কাপড় পরা, সার সার ছায়াগাছ দেখলে
চোখ জুড়িয়ে যায়।
কিছু পোকা
ছায়াগাছের বাকলে ডিম পাড়ে। তাই সেই সব ছায়াগাছের বাকল চেঁচে দেওয়া হয় অনেক
সময়। ‘পতঙ্গ-ফাঁদ (insect catcher ) হিসেবে আগে শীতকালে রাতের বেলায়
সেকশানের ভিতরে ভিতরে আগুন জ্বালানো হত। পোকারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘আত্মহত্যা’
করত তাতে।এখন রাতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বেলে পোকা ধরা হয়। গত কয়েকবছর ধরে
ছায়াগাছের গায়ে হলুদ রঙের আঠালো (sticky) স্টিকার লাগানো হচ্ছে। এতে
পোকামাকড় আঠায় জড়িয়ে যায়।
এছাড়া চা-গাছে প্রথাগত
পেস্টিসাইড নিয়মিত স্প্রে করা হয়। সঙ্গে হাতে করে পোকাদের লার্ভা সংগ্রহ
করা ইত্যাদি নানা রকমের কাজ প্রায় সারা বছর ধরেই চলতে থাকে।
#
ছায়াগাছ
ছাড়াও বিশেষ উদ্দেশ্যে আরও কিছু গাছ চা বাগানে লাগানো হয়। যেমন নীচু জমি-
যেখানে জল জমার ইতিহাস আছে- সেসব জায়গায় ইউক্যালিপ্টাস গাছ লাগানো
হয়।ইউক্যালিপ্টাস গাছ অনেক বেশী জল টেনে জমির জলের স্তরকে নামিয়ে দেয়; ফলে
চায়ের গোড়ায় জমা জল সরে যায়। পোকামাকড় এবং রাস্তার ধুলোর হাত থেকে চা-গাছকে
বাঁচানোর জন্য (ধুলো এবং রোদে রেড-স্পাইডারের আক্রমণ বেড়ে যায়) সেকশানের
ধার ঘেঁষে বাসক, জ্যাট্রোপা (ভ্যারান্ডা) ইত্যাদি গাছ দিয়ে বেড়া (Hedge)
দেওয়া হয়। সিট্রোনেলা বা লেমন গ্রাস একই সঙ্গে যেমন পোকা-মাকড়কে দূরে রাখতে
সাহায্য করে তেমনি তার গুচ্ছমূল জমির ক্ষয় (soil erosion) রোধে, বিশেষ
করে পাহাড়ের ঢালু অঞ্চলে এবং বাগানের নালার ধারের মাটি রোধে অনেক সাহায্য
করে।
#
চা-নার্সারি থেকে চারা
এনে মাটিতে বসানোর সময় লম্বালম্বি এবং পাশাপাশি কতটা দূরে দূরে বসানো হবে –
তার নানা রকম নির্দিষ্ট মাপ আছে।কখনও দুইসারি গাছ ফাঁকা ফাঁকা করে বসানো
হয় – তাকে বলে সিংগ্ল হেজ প্ল্যান্টিং (Single Hedge Planting), কখনও বা
ঘন করে (Double Hedge Planting) ।
সিংগ্ল
হেজ প্ল্যান্টিং-এর ক্ষেত্রে পারস্পরিক দূরত্বের অনুসারে হেক্টর প্রতি
বারো হাজর সাতশ থেকে প্রায় সাড়ে আঠারো হাজার চারা লাগানো যায়। ডাবল হেজের
ক্ষেত্রে তা ষোলো হাজার আটশ থেকে সতেরো হাজার তিনশর মত। এই চারা লাগাবার
প্যাটার্ণ-এর নির্ভর করে সেই সেকশানের হেকটর প্রতি উৎপাদন কত
(Yield/Hectare)। এরসঙ্গে চাগাছের জাতের ব্যাপারটাও থাকে। কিছু জাতের গাছ
বেশী পাতা দেয় (High yielding), কারও আবার পাতা কম কিন্তু গুণগত মান ভালো।
ফলে সেকশানের কাঁচা পাতা উৎপাদনেরও তারতম্য ঘটে।
#
বিভিন্ন
রিসার্চ ইন্সটিটিউট থেকে কিছু সময় পর পর নতুন নতুন জাতের চা-গাছ তৈরি হয়ে
আসে। বাগানগুলো সেইমত চারা গাছ লাগায়। কিন্তু মুশকিল হল একবার চারা লাগানোর
পর তাকে পাঁচ বছর ধরে বড় করে তোলার,পরিচর্যা করার খরচ অনেক। ফলে বাগানে
এখন যে গাছ আছে তার থেকে আরও ভালো নতুন চা-গাছ বাজারে এলেও সেসব রাতারাতি
বাগানে লাগানো যায় না। পুরনো বাগানের ক্ষেত্রে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় –
যতদিন না সেকশানের চা-গাছের বয়স কম করে পঞ্চাশ বছর হচ্ছে। কেননা টি-বোর্ড
পঞ্চাশ বছরের আগে চা-গাছ তোলার অনুমতি দেয় না। (টি-বোর্ডের লিখিত অনুমতি
ছাড়া কোন চা-গাছ লাগানোও যায় না – তোলাও যায় না।)। এরফলে রাতারাতি সব কম
ইল্ডের( Yield) গাছ তুলে নতুন বেশী ইল্ডের গাছ লাগানো বাগানের পক্ষে সম্ভব
নয়।বাগানগুলোকে এর ফল ভুগতে হয় বেশ কিছুটা।
একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।
TRA-র
প্রথমদিকের আবিষ্কার TV-9 খুব শক্ত-সামর্থ গাছ। সহজে মরে না।
রোদ-ঝড়-জল-অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি খুব সহজেই সইতে পারে। আবার পাতা বাড়েও খুব
তাড়াতাড়ি। এত তাড়াতাড়ি বাড়ে যে অনেকে একে জংলি গাছও বলে। ইল্ড বেশী বলে
একসময়ে প্রায় প্রতিটি বাগানেই এই গাছ বিপুল পরিমাণে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু
এর পাতা থেকে খুব ভালো মানের (quality) চা হয় না। (অবশ্য ডুয়ার্সের প্রথম
সারির বাগান কুর্তি-র অভিজ্ঞ ম্যানেজার রাজেশ রুংতা আমাকে বলেছেন যে ঠিক
ছয়-সাত দিনের মাথায় ‘প্লাক’ করলে TV9-এর চা-ও খুব ভালো হয়)। এছাড়া
প্রথমদিকের বীজের চা-গাছ, বড় পাতার কম্বোড জাতের গাছ ইত্যাদির ইল্ডও
তুলনামূলক ভাবে কম।
এরপর,
বছর যত গড়িয়েছে, TRA-এর আরও ভালো ভালো জাতের গাছ বাজারে এসেছে – যেমন,
সমতলের জন্য তিনালি (Teenali – আসামের তিনআলি চা বাগানের ক্লোন) বা
পাহাড়ের পায়ের কাছের জন্য AB-2 (ডুয়ার্সের আমবাড়ি বাগানের ক্লোন) - যারা
একই সঙ্গে বেশী পাতা ও কিছুটা ‘ভালত্ব গুণ’ (quality) দিতে সমর্থ, কিম্বা
বা আরও পরবর্তী কালের বেশী উৎপাদনক্ষম ( High yielding) TV25, TV26। কিন্তু
যেসব বাগানের TV-9 গাছের বয়স এখনও পঞ্চাশ বছর হয় নি – তারা এখনই সেইসব গাছ
তুলে তিনালি বা AB-2 বা TV25,TV26 লাগাতে পারবে না। ফলে তাদের উৎপাদন
স্বাভাবিক ভাবেই নতুন জাতের গাছের থেকে কম থাকবে আরও বেশ কয়েক বছর।
চা-বাগানের দুরাবস্থা নিয়ে আলোচনার সময় এ প্রসঙ্গে আমাদের আবারও আসতে হবে।