বাংড়ি তিতি ও হাউড়ি শেষে
পর্ব-১৬
মিশা ঘোষাল
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
টোটোপাড়ার একটি গ্রাম : পোয়ারগাঁও
'টোটবিকো লেইকো দেরেং'...
টোটোদের
একটি গ্রামের খবর লিখতে চেয়েছিলাম নিখুঁত আকারে । আগেও গিয়েছি অনেকবার এই
গ্রামটিতে, কিন্তু এই গ্রামটিকে নিয়ে লিখব ভেবে আবারও গিয়ে ঘুরে এলাম
টোটোপাড়ার পোয়ারগাঁও থেকে। টোটোপাড়ার এই গ্রামে এলে সবুজের চেনা রঙ আবার
নতুন করে চোখে পড়ে।প্রজাপতির মতো ইচ্ছে হয় পাখা মেলে উড়ে যেতে দূরে।
এখানে এলে সবুজের নরম রঙ মন-কেমনের জানালা দিয়ে প্রবেশ করে দিয়ে যায় ভালোলাগার এক গুচ্ছ সতেজ নরম পদ্য...
শস্য
শ্যামল এই প্রকৃতিকে শত শব্দের নিঃশব্দ কোলাহল ছুঁয়ে দেখে। আর এই সবুজ
আত্মীকরণের পরই লেখা যায় টোটোপাড়ার কোনো গ্রামের সঠিক গদ্য-সম্ভার।
দূষণমুক্ত
প্রকৃতির এক টুকরো দর্পণ হল টোটোপাড়ার এই 'পোয়ারগাঁও'। এই গ্রামের
ছবিগুলি সংগ্রহ করতে তাই আবার পৌঁছে যাই টোটোপাড়ার এই 'পোয়ারগাঁও'
গ্রামটিতে। এখানে আসা মাত্রই সবুজের মখমলি রঙ এসে ছুঁয়ে যায় দু'চোখ-
শুধুই প্রকৃতির কথা বলে এই মন...
সেই
চির সবুজ, চির নতুন এই গ্রামটিকে পাতায় পাতায় ভরে রেখে পৌঁছে দেব দূর
দূরান্তের পাঠকের মানসলোকে এই ভেবে প্রতিনিয়ত গ্রামটিকে মানসলোকে মজুত করে
ক্রমাগত জারন ক্রিয়ায় রচনা করতে লাগলাম টোটোপাড়ার এই সবুজের সাতকাহন।
যেখানে শুধু সবুজ গাছপালার পাতায় পাতায় মজুত রয়েছে ক্লোরোফিলের অশেষ
ভান্ডার, যা কিনা প্রতিনিয়ত সালোকসংশ্লেষ ও শ্বসন প্রক্রিয়াকে সচল রেখে
জীবনকে অর্পণ করে চলেছে দূষণমুক্ত অক্সিজেনের ভান্ডার। আমাদের সতেজ রেখে
আমাদের পরিত্যক্ত বিষাক্ত কার্বন- ডাই-অক্সাইড গ্যাস শুষে নিতে এই
সবুজায়নেরই তো দরকার সবখানে । আমাদের শ্বাসক্রিয়ার অমোঘ নিয়ন্ত্রণের
চাবিকাঠি থাকে এই সবুজ গাছের পাতায় পাতায়,ক্লরোপ্লাস্টের অভ্যন্তরে।
জীবনের এই সবুজ কথার মায়া মাখা প্রকৃতিই যেন পোয়ারগাঁও এই গ্রামটিতে আষ্টেপৃষ্ঠে লেখা...
শুধু সবুজ কথার নিঃশব্দ কোলাহলেই দিন কাটে পোয়ারগাঁওয়ে বসবাসকারী টোটোদের। এখানকার
সুপারি বাগান, ভুট্টা মারুয়ার ক্ষেত্রেও সবুজায়নের সাতকানিয়া রঙ লাগে। যত আগাছা এখানে তাও সব সবুজ।
টোটোপাড়ার এরকমই একটি গ্রামটি হলো পোয়ারগাঁও। এই গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বিদ্যালয়টির নাম
'টোটোপাড়া আই টি ডি পি প্রাথমিক বিদ্যালয়'। এই বিদ্যলয়ের প্রধান হলেন টোটোদের মধ্যে প্রথম মাধ্যমিক পাশ মহিলা। তিনি সূচনা টোটো।
এই বিদ্যালয়েরও চারিদিকে সবুজের আস্তরন। গাছপালার ঘেরা পোয়ারগাঁও এর এই বিদ্যালয়টি।
রিকিতার
বাড়ি এখানেই, পাশাপাশি।রিকিতা (রিকিতা টোটো) আমাদের ছাত্রী। ও যখন অষ্টম
শ্রেণিতে পড়ত তখনও একবার এসেছিলাম ওর সাথে এই গ্রামে, ওদের বাড়িতে। দরকার
ছিল আমারই। ওকে নিয়ে সেবার আমাদের জেলা আলিপুরদুয়ারের 'শিশু বিজ্ঞান
কংগ্রেসে' একটি প্রজেক্ট বানানোর কাজ করছিলাম আমি। রিকিতার বিজ্ঞানবোধ আছে।
পারুক না পারুক ওর উৎসাহ আছে। তাই ওকে নিয়ে টোটোপাড়ার জৈব আবর্জনাগুলিকে
রিসাইক্লিং করিয়ে কিভাবে একটি নতুন প্রোডাক্ট বানানো যায় আর পরিবেশের
ভারসাম্যও বজায় রাখা যায় সে বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলাম ওদের বাড়িতে
পোয়ারগাঁওএ। বাড়িতে ওর বাবা মা ও দাদার সাথে কথা বলে জানলাম পরিবেশ সংরক্ষণ
ও জৈব সারের উৎপাদনের বিষয়টি।
এখানে রিকিতা টোটোর
বাড়িতে ছিল একটি খামার। ছাগল, গরু, মোষ ছিল এই খামারে। পাশে ছিল শূকর
প্রতিপালনের ব্যবস্থা। কাঞ্চন ফুলের কচি কচি পাতাগলি পেড়ে এই খামারের গরু
ছাগলকে খেতে দিচ্ছিল রিকিতার বাবা ভীম টোটো। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে নমস্কার
জানিয়ে নিয়ে গিয়ে বসতে দিল ওদের কাঠের পাটাতনের উচু ঘরটিতে।
শাল
কাঠের মজবুত খুঁটি ও টিনের চালের ওই ঘরটির জানালা দিয়ে প্রবেশ করছিল
সূর্যের তীর্যক আলোক রশ্মির একগুচ্ছ মিঠা রোদের উত্তাপ। শীতের আবহে এই
জানালার কাছে বসে প্রথম 'ইউ' পান একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল আমার। আমি 'না
না' বললেও রিকিতার মা না-ছোড়!
বললেন, "কিছু হবে না ম্যাডাম। অল্প খেয়ে দেখেন আমাদের ইউ।"
এই বলে পূর্ণ গ্লাসের ইউ কিছুটা ঢেলে রেখে কম করে আনলেন তিনি।
একটি কাচের গ্লাসে জলের মতো স্বচ্ছ তরল দেখতে পেলাম। গ্লাসটির চার ভাগের একভাগ ইউ আমার দিকে সযতনে এগিয়ে দিলেন তিনি।
আমাকে ইতঃস্তত করতে দেখে রিকিতার কাকু বলে উঠল,
"ম্যাম,
এটি মারুয়ার দানা, চাল ও ধানি লঙ্কা দিয়ে বাড়িতে তৈরি করা একটি তরল পানীয়।
কিছু খারাপ জিনিস এটা না ম্যাম। আমাদের রীতি এটাই যে বাড়িতে কেউ এলে
আমারা সর্বপ্রথম তাঁকে 'ইউ' দিয়ে অভ্যর্থনা জানাই।"
আর
কী! সেই প্রথম এখানে এসে 'ইউ'এর স্বাদ নিয়েছিলাম। একটু কষাটে স্বাদের এই
পানীয় পান করে জেনেছিলাম এতে অনেক ঔষধি গুণও আছে। আরও জানলাম এই 'ইউ'তে
অ্যালকোহল কন্টেন্ট খুবই কম। মাত্র টেন পার্সেন্ট।
রিকিতাদের
বাড়িতে কাঁঠালগাছ আছে কয়েকটি। কাঁঠালগাছের নীচে ওদের ঘরের কাঠের সিঁড়ির
পাশ দিয়ে মুরগির আস্তানা। একটি ছোটো মুরগি পোষার ফার্ম হাউস।
একটি
পোষা ময়ূর দেখতে পেলাম সেখানে। এসে দাঁড়ালাম ডুমুর গাছের নীচে। সামনেই
ভূট্টার (মেম্বে) ক্ষেত। সোনালী ধানের শীষগুলি তখন এলিয়ে পড়েছে একের গায়ের
পরে আর এক।
শিশিরভেজা সকালের হলুদ আলো তখন আমাকে
প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এগিয়ে এলো রিকিতার মা। হাতে একটি ডোকো। এই ডোকো মাথায়
করে আনতে যাবে রান্নার কাঠ উপরের পাহাড় থেকে। পাশে শিমুল আলুর ক্ষেত। আলু
তুলছে রিকিতার ঠাকুরমা। শিমৃল আলুর পাতাগুলি যেন করতলের পাঁচটি আঙ্গুলের
মতো দেখতে।
পাশেই ছিল টুঙ বা গাছবাড়ি একটি।
গাছবাড়িটি খয়ের গাছের মগডালে। সেখানে গাছের কান্ডটির সাথে লাগোয়া মই বেয়ে
গাছে চড়ে উপরে উঠে গেল রিকিতার ভাই রথিন টোটো। অদ্ভূত লাগছিল এই গাছবাড়িটি
ওদের। পাশাপাশি ছিল বাঁশের ঝোপ। বাতাবি লেবু, মোসম্বি ও পাতি লেবুর বাগান।
সবুজায়নের সার্থক নিদর্শন এই বাড়ির চারিধার। গ্রামটিও চির সবুজ।
"সিনি কো সিংতেং তৈতিংসো ডাংতেং নিনা অংক লোই জেজেংপা"...
তাংসা তা নেত্তা না লোই
নেত্তা না ইয়োনিংপা"...
সনের
গানের দু'কলি গিয়ে উঠল প্রতিমা। প্রতিমা টোটোর সাথে এসেছিল ওর ভাই শঙ্কর
টোটো। ওরা আমাকে নিয়ে গেল এবার একটু নীচের দিকে। ওদের বাড়িতে। সেখানে এসে
একটি জৈব সার উৎপাদনের একটি নতুন প্রোজেক্ট পেয়ে গেলাম। রিকিতা, প্রতিমা,
শঙ্কর ও প্রিয়া টোটোকে নিয়ে সেবার শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেসের 'জৈব সার
উৎপাদনের প্রজেক্টটি' আমরা তৈরি করেছিলাম। ওদের নিয়েই ঐ প্রত্যন্ত এলাকা
টোটোপাড়া থেকে 'শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেসে' ভাগ নিতে পেরেছিলাম আমরা। সেবার
আমাদের জেলা আলিপুরদুয়ারের 'রেলওয়ে উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে' অনুষ্ঠিত
হয়েছিল এই "শিশু বিজ্ঞান কংগ্রেস"। টোটোপাড়া থেকে আমাদের এই প্রজেক্টটি
একটি পুরস্কারও পেয়েছিল সেবছর।।