পইলা সাঞ্ঝির কথা/১৬
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব : ১৬
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
কইনাগৎ
উঠোনে পা দিয়েই সুষেণ 'মা' 'মা' করে ডাক পাড়ে। রসবালা রান্নাঘরের পেছন থেকে উত্তর দিলেও তা ছেলের কানে পৌঁছায় না।গলাটা তুলে আরো জোরে ডাকতে থাকে। এবার রসবালা রেগেমেগে ঝাঁজিয়ে ওঠে,
"কি হইসে, আও দিলে শুনিন না আর খালি চিকরিছিত।"
সুষেণ একটু থতমত খায়। শান্ত হয়ে বলে "আও না শুনোছোং, তে মানসিটাক যে দ্যাখোছোং না। কোটে থাকি প্যান্নেত করি আও দিছিত শুনায় না যাছে।"
তারপর হাতের প্রসাদগুলো বাড়িয়ে ধরে বলে,
"পোসাদ আনসুং, খা কেনে।"
রসবালার কাদামাটি হাত। বোঝাই যাচ্ছে লেপা-পোঁছা চলছে। সেদিকে তাকিয়ে সুষেণ বিরক্ত গলায় বলে,
"তোক কি দিনাও ঘর মুছির নাগে? কাজে ফুরায় না? নে, তাড়াতাড়ি হাত ধুয়া আগোত পোসাদ খা, না হলে বাছা বাউ দেখিলে এলায় খায়া নিবে।"
"কেনে উয়ায় পোসাদ খায় নাই?"
রসবালা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু সুষেণ ওর মায়ের দ্বিধাকে পাত্তা না দিয়ে জোর গলায় বলে,
"না খাইসে তে কি! উমরা চাইর জনে দুইটা নাইকেল আলাদায় খাইসে আরো। তাও দেখিলে এলায় তোর ত্যানে থুবে না।"
বড় ছেলেটা এরকমই রসবালার। যা খাবে মায়ের জন্য একটু হাতে করে নিয়ে আসবে। ছোটটার ওসব বালাই নেই। প্রসাদের নারকেল চিবোতে চিবোতে রসবালা জানতে চায়,
"দধিকাদো খেলা শ্যাষ হইল তে বাউ? তোর বাপ কোটে?"
সুষেণ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
"শ্যাষ! কতখান আরো নয় ! বাবা অলিন পিসার সতে গেল।"
নাম শুনে রসবালা আঁতকে ওঠে।
"অলিনের সতে আরো কেনে গেইল? হোটে যায়া এলায় গাঞ্জা খাবে। যা যা ড্যাকে আন না। ক বোলে মার তাও উঠেছে। খমকায় বাড়ি যাবার কইল।"
সুষেণ বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারে খুব দ্রুত। আজকে জন্মাষ্টমী। এমনিতেই পাড়ার সবাই মন্দিরের পুজো শেষে এখানে ওখানে আড্ডায় ব্যস্ত। নেশাড়ু লোকেদের এটা নেশা করার আদর্শ সময়। আগের বার কোন এক পুজোতে অনিলের সঙ্গে গাঁজা খেয়ে এসে সুষেণের বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। সারাদিন আবোল-তাবোল বকছে, এই হাসছে তো পরক্ষণেই কেঁদে ভাসাচ্ছে। রসবালার সে এক দিন গেছে। এ পাড়া ও পাড়া মিলে বেশ কয়েকজন আছে গঞ্জিকা সেবনপ্রিয় মানুষ। এরা সুযোগ পেলেই দল ভারী করার চেষ্টায় থাকে। সেজন্য সুষেণ আর দেরি করে না, বাবাকে ডেকে আনতে আবার বাইরের দিকে পা বাড়ায়।
রসবালা কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে চিন্তিত মুখে নিজের মনেই বলে ওঠে,
"বাচ্চা বাউটা আরো বা কোটে আছে।"
বলে অবশ্য রসবালা ভাবেইনি ওর কথার কেউ জবাব দেবে। আচমকাই বাইরে থেকে উত্তর আসে,
"বিষেণোক দেকিলুং চকচ্চল খেলের ধইচ্চে বটের গোড়োত"।
শুনে রসবালার গা পিত্তি জ্বলে গেল।
"চকচ্চল খেলের ধইচ্চে? আসুক তো জলখান এলায়। এমনি কয়দিন থাকি খড়ি-খ্যার, দাগিলি-কেতালা শুকি থুবার ধইচ্চুং। আজিও উমারে মোটা দাগিলিখান টারোৎ দিয়া আসিলুং।"
রসবালার কথা শেষ না হতেই বুধেশ্বরের মা উঠোনে এসে দাঁড়ায়। বলে,
"চকচ্চল হইল আলসিয়া মানসির খেলা। কাজ-কামাই নাই, দিনমনটায় খেলা আর ওই খেলা।"
কথাটা রসবালার ভালো না লাগলেও চুপ করে থাকে। বিষেণ মোটেও অলস নয়। আজ মন্দিরে পূজা উপলক্ষে পাড়ার সবাই প্রায় ওখানে। আজ একটু অমন হবে। বুধেশ্বরের মা রসবালার মুখ দেখে প্রসঙ্গ পাল্টায়।
"পূজার ওঠে যাইস নাই মাই? মুই গেলুং কোনেক। দশংগোতিয়া পূজা! হামারলার না গেইলে হয়?"
রসবালা মাথা নাড়ে। তারপর বলে,
"মুই নাই যাং, ছাওয়ালা গেইসে। উয়ার বাপ গেইসে। পোসাদ আনিসে বাউ, খালুং।"
বুধেশ্বরের মা বলে,
"তোরঠে আসিলুং কোনেক ঠেকাৎ। কালি এক খাচারি গোবর দিবার পাবু? সাকালে? নাই গরুলা ব্যাচেয়া গোবরের খিব আকাল হইসে একেরে। সাকালে তো আগিনাত এলা আর দিবারে না পাং। কুনো সোমাতে দোলা থাকি কুড়ি আনি দ্যাং। কালি কোনেক গোবরে মাটিয়ে মিশাল করি আকা চৌকাগিলা মুছিম। মাটি দিয়া মুছিলুং তে উদুরি পড়েছে এখেলে।
রসবালা আপত্তি করে না।
"তে কোনেক সাকালে আসিস দি। মোর ফম না থাকিলে এলায় ভিড়াৎ ফ্যালে দিবার পাং।"
বুধেশ্বরের মা গেলে রসবালা আবার আপন মনে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। টানা বৃষ্টিতে বাড়ি ঘর কেমন স্যাঁৎসেতে হয়ে আছে। আজকেও রাতে বৃষ্টি ছিল। সে তো জানাই কথা। জন্মাষ্টমীতে বৃষ্টি না হয়ে যায় কোথায়! কিন্তু আজ আবার সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার। রসবালা এখন ভাবছে ট্রাঙ্ক থেকে তোলা কাপড়দুটোও বের করে একটু রোদ খাওয়াবে কিনা। ভাদ্রমাস শেষ হতে চলল, এখন বৃষ্টির দাপটটা কমলে হয় একটু। সেদিন এই কথাটাই বলাতে বসমতী অবাক হয়ে গেল। বলল,
"এলাং কইনালায় কান্দিল না। তাতে দ্যাওয়াটা ভাল হয় মাই? তেরোটা কইনা তেরোদিন যাবে, তার পাছোৎ দ্যাওয়া ভাল হবে।"
রসবালা আসলে 'কইনাগতের' কথা ভুলেই গেছিল। ঠিকই তো! দেবী পূজার আগে তো 'কইনাগৎ' যাবে! অবশ্য কোনো কোনো কইনা কান্দে না। বসমতী হিসেব করে বলে,
"আজিকার কইনাটা হাইসতে হাইসতে গেল। দ্যাওয়াটাৎ একেনা ম্যাগ নাই। এলকার চেংরিগিলার মতোন। এলা আরো বিয়াও হইলে কাহো কান্দে না। প্যান্নেত করি কোনেক কান্দি ওদি চুপ।"
কথাটা অবশ্য বসমতী ভুল বলে না। রসবালা মনে মনে ভাবে। তবে এত বৃষ্টি আর ভালো লাগছে না। কইনাগৎটা এরকমই আকাশ পরিষ্কার থাকলে ভালোই হয় একটু।
.............................................................
প্যান্নেত - আস্তে বা নিচু স্বরে
তাও - রাগ
খমকায় - তাড়াতাড়ি
চকচ্চল খেলা - মাটিতে দাগ কেটে এক ধরণের খেলা। বাঘ-বন্দির মতো। চকচ্চল খেললে বৃষ্টি নামে এরকম বিশ্বাস প্রচলিত আছে কোথাও কোথাও।
দশোংগোতিয়া - দশের পরিচালিত
খাচারি - বাঁকের জন্য বানানো ঝুড়ি, একটু ফাঁকা ফাঁকা গাঁথুনি।
ভিড়া - রোজকার গোবর জমা করার গর্ত।
কইনাগৎ - পূর্ণিমা থেকে মহালয়া পর্যন্ত সময়টাকে কইনাগৎ ধরা হয়। এ সময় বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। পূর্ণিমার দিনেই একসাথে পাঁচখানা কইনা যায়, এরপর রোজ একজন করে মোট ষোলোটা কইনা যায়।
ছবি : ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴