নানা রঙের গানগুলি-১৬/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি (১৬)
শৌভিক কুন্ডা
---------------------------------
আমাদের বাড়িতে আমার ছোটবেলায় গান শোনার তেমন চল ছিলো না। বাবার কথা বিশেষ করে মনে পড়ে, গান থেকে তাঁর দূরত্ব ছিলো অনেক অনেক যোজন। তবু, কম্যুনিস্ট আদর্শের সেই বাবাকে দু একটা গান দু চারবার বেশ মনযোগ দিয়েই শুনতে দেখেছি। তার একটি "অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি," আর "কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো....."। তখনও নাম জানতাম না, আর একই গলায় " রানার চলেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে" গানটি সেই খুদে আমিকে অনেক বেশি টেনে রাখতো।
বেড়ে পাকা হয়ে ওঠার সময় দিয়ে গান শোনার নেশা চেপে ধরেছে। তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মানেই আমার কাছে "আমার কাউকে বলার কিছু নেই।" একলা একা জানালার পাশে, অথবা ফাঁকা দুপুরের সিঁড়ির ধাপে রবীন্দ্রগান, "তুমি তো সেই যাবেই চলে"। বৃষ্টি বাইরে, আর ট্র্যানজিস্টরে হেমন্ত, " এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন," অথবা রাতের অন্ধকার ভরাট করে দেওয়া একলা ঘরে, "তুমি এলে, অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো!"
ক'দিন আগে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একশো বছর পূর্ণ হয়েছে। হিসেবে তাহলে আমার চেয়ে চার দশক আগে তাঁর জন্ম। মেধাবী ছাত্র, ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি চাকরির খোঁজ করে চলা হেমন্তের অন্যতম প্রিয় সুহৃদ ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই বন্ধুর টানাটানিতেই তাঁর প্রথম অডিশন দেওয়া। রেকর্ডিং।
কিন্তু গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার রাস্তায় বিশাল ছায়া মেলে দাঁড়িয়ে আছেন বাঙালির সুর আইকন পংকজ কুমার মল্লিক। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হেমন্ত তখন গাইছেন বটে, কিন্তু ডাক পড়ছে পংকজ কুমারের গান শুনে অধিকাংশ শ্রোতা উঠে যাওয়ার পর।
তিনের দশকের শেষ দিক থেকে চারের শুরু পর্যন্ত বলা যায় হেমন্তের লড়াইকাল। তার পর জেট গতির উড়াল। বাংলা, হিন্দি,মারাঠি, পাঞ্জাবি, অসমীয়া যে ভাষাতেই গেয়েছেন, শ্রোতারা মাথায় তুলে নিয়েছে হেমন্ত্কুমার বা আমাদের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে।
"অলির কথা শুনে বকুল হাসে
কই তাহার মতো তুমি আমার কথা শুনে"র পর আলতো করে ভাসিয়ে দেওয়া " হাসো না তো" কোন বাঙালিকে না শিরশিরিয়ে তুলেছিলো!
স্যাটা বোস হতে চেয়েছি সকলে, "ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস" শুনতে শুনতে। "এই পথ যদি না শেষ হয়" গুনগুন করতে করতে একা বাইক, নিদেন সাইকেল চালানো বাঙালি নায়ক হতে চাই নি প্রত্যেক যুবক? ছায়াছবির পর্দায় উত্তমকুমারের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান মানেই তো হিট! একটু পাল্টে নিয়ে বলি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানে উত্তমকুমারের লিপ। অন্তত আমার কাছে। কারণ প্রবল উত্তম উপস্থিতিকে ছাড়িয়েও এইসব গান আজও ভরিয়ে রাখে আমাকে। আর সত্যি বলতে যখন কেবল এই গানগুলোই শুনতে থাকি, সিনেমার নানা চরিত্রের নায়কদের আর মনে পড়ে না। দেখতে পাই সৌম্য এক প্রৌঢ় মানুষকে, সাদা ধুতি, সাদা শার্ট, একটি চেয়ারে বসা, সামনে টেবিলের ওপর হারমোনিয়ামে হাত খেলা করছে। তাঁকে এভাবেই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমারও, অগুনতি মানুষের মতো, তিনি দেবকন্ঠে সুর উচ্চারণ করছেন,
"আগামী পৃথিবী
কান পেতে তুমি শোনো
আমি যদি আর
নাই আসি হেথা ফিরে....
তবু আমার গানের
স্বরলিপি লেখা রবে....."।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴