দ্বিধা/শুক্লা রায়
দ্বিধা
শুক্লা রায়
শ্যামবর্ণাকে কে আর শ্যামা বলে, সবাই হয় কালো নয় ময়লাই বলে। সাহিত্য গল্পেই এসব শব্দ প্রচলিত। বাস্তবে নয়। দীপিকা বিয়ের কনেরূপে সেজেগুজে কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। আসলে জীবনের প্রতি আর কোনো কৌতুহল অবশিষ্ট নেই। ওর মেয়েটা একটু আগেও পাশে পাশে ঘুর ঘুর করছিল। মায়ের ঝকমকে ওড়নাটা, নাকের লম্বা নথটা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল। দীপিকা বাধা দিচ্ছিল না। আসলে তার বুকের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করছে। কে জানে মেয়েটার ভাগ্যে কী আছে। যে বাড়িতে যাচ্ছে সেখানে তার তার মেয়েকে আদর করবে কিনা। বিয়ে ও করতেই চায়নি। নিরুপায় হয়েই করছে। ছেলেরও আগে একবার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু দুটো বাচ্চা রেখে বৌটা মরেছে। সেও বেশ কয়েকবছর হয়ে গেল। এতদিনে ছেলেটা বিয়েতে বসছে। বাড়ির বড়দের নিতান্ত চাপাচাপিতে। দেখতে যেদিন এসেছিল, দীপিকা চেয়েও দেখেনি ছেলের মুখ। ওর আসলে কিছুই দেখার মন নেই যেন।
বাপ মরেছে সেই কোন ছোটবেলায়। মুড়ি ভেজে, এবাড়ি ওবাড়ি কাজ করে মা তাকে মানুষ করেছে, মানুষ আর কোথায়, বড় করেছে। দুঃখী মায়ের মেয়ে, তাও গায়র রঙ ময়লা। পাত্র পক্ষ আসে, দেখে, চলে যায়। অথচ মুখখানি কিন্তু তার ভারী মিষ্টি! তাতে কী? সবার যে ফর্সা রঙটাই চাই। অবশেষে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ একদিন বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। পাড়ার লোকই তদ্বির-তদারক করে বিয়ের ব্যবস্থা করল। দান সামগ্রীও সব ভাগাভাগি করে বহন করেছে। দুঃখিনী মায়ের মেয়ে বলে যে দাবি-দাওয়া ছাড়া বিয়ে হবে তা তো আর নয়! সবাই সাধ্যমতো চাঁদা তুলে বৌভাতের খরচটা তুলে ছেলের বাবার হাতে দিয়েছে। বিয়ে-বাড়ির খরচও বহন করেছে প্রতিবেশিরাই। বৌ হয়ে বাড়িতে পা দিয়েই কেমন একটা গুজগুজ ফুসফুস। ওর সঙ্গে যে বুড়িটা এসেছে সে এসে জানালো, ছেলের নাকি এই বিয়েতে মত ছিল না। জোর করে বাপ-মায়ে বিয়ে দিয়েছে। দীপিকা মনে মনে ঘাবড়ে যায়। গায়ের রঙটা যে কালো! কিন্তু সব দুশ্চিন্তা দূর হয় শ্যামলকে একান্তে পেয়ে। বাসর ঘরে শ্যামল তাকে র্নিদ্ধিধায় আপন করে নেয়। শ্বশুর বাড়ি এসেও হইহই করে কাটিয়ে দেয়। তারপর বাড়িতেও সবকিছুতে শ্যামলের উৎসাহ, আন্তরিকার কমতি নেই। শ্যামল কাজ করত কেরালায়। ওখান থেকেই পরে কাশ্মিরে চলে গিয়েছিল। সেজন্য বাড়ির লোক অনেকদিন যোগাযোগ করতে পারেনি। এবার সুযোগ পেতেই সোজা বাড়ি এসেছে। অবশ্য ওর বিয়ে করার ইচ্ছে ছিল না। আর কিছু টাকা জমিয়ে একেবারে এসে বাড়িতেই থিতু হত। কিন্তু বাড়ির লোক ছাড়ে না। সেজন্যই সবাই ভেবেছিল বুঝি জোর করে বিয়ে দিয়েছে। শুনে দীপিকা শান্ত হয়। এত কাছের মানুষটাকে বিশ্বাস না করে করে কি? দেখতে দেখতে তিনটা মাস কোথা দিয়ে কেটে গেল বোঝাই গেল না। যেন স্বপ্ন।
ঠিকঠাক আলো ফোটার আগে উঠোনময় ভাতের গন্ধ। শ্যামল যাবে। বাবা-মা আনেক নিষেধ করেছে। কিন্তু শ্যামল যাবেই। দীপিকা কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। কি জানি কেন মনটাও অজান্তে কু গাইছে। এই তিনমাসে ও একটা চিত্র পেয়ে গেছে সকলের কথায়। শ্যামল দীর্ঘ দু বছর পরে এবারেই বাড়ি ফিরেছে। এই এতগুলো দিন বুড়ো বাপ-মায়ের না নিয়েছে কোনো খবর, না পাঠিয়েছে কোনো টাকা। এই এতদিন পরে যে এসেছে, সেরকম টাকাপয়সা কিছুই আনতে পারেনি। এটাই আশ্চর্যজনক। সেজন্য কেউ চায়নি শ্যামল এবার এবার যাক, দীপিকা তো নয়ই। পৌঁছেই দুদিন ঘন ঘন ফোন পাওয়াতে বাড়ির লোক মোটামুটি নিশ্চিন্ত, যাক এবার সব ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু নিশ্চিন্তভাব বেশিদিন টিকল না। দুদিন পরেই হঠাৎ আবার ফোন বন্ধ। যারা সঙ্গে গেছে আশেপাশের সবাইকে ফোন করে একটাই উত্তর শ্যামল এখানে নেই। অন্য জায়গায় চলে গেছে। যে লোক নিজে থেকে হারাতে চায় তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা বৃথা। ততদিনে দীপিকার পেটে শ্যামলের মেয়ে বাড়ছে একটু একটু করে। তারপর যা হয়, শ্বশুর বাড়ির লোক হাত ঝেড়ে ফেলে দিল আর বাচ্চা কোলে দীপিকা পুনরায় বাপের বাড়ি, মায়ের কাছে। বিয়েটা যেন এক স্বপ্ন ছিল, বাস্তবে মেয়েটা ছাড়া সে বিয়ের কোনো অস্তিত্বই নেই। এখন মাঠের এমন কোনো কাজ নেই যা দীপিকা করে না। বছর খানেক পেরোলে শ্যামলের খবরও পাওয়া যেতে লাগল ধীরে ধীরে। দুটো বাচ্চাসহ ওর ভরা সংসার সেখানে। সেসব রেখে কদিনের জন্য বাড়িতে এসেছিল ঘুরতে। কিন্তু বিয়ে করে ফিরে গেছে। বাবা মায়ের উপর সব দায় চাপিয়ে। না নিজে কোনো বাধা দেয়নি, প্রতিবাদও করেনি। সব দায় বাড়ির লোকের। সব জেনেও দীপিকা আর বিয়ে করতে চায়নি, তবু বলত যদি কখনো ফিরে আসে! আসলে বিয়ের পরের তিন মাসের স্মৃতিটাই খুব যত্নে রেখেছে দীপিকা। বিশ্বাস করতে চায় না ওই তিনটে মাস মিথ্যে ছিল। কিন্তু এখন তো বুড়ি মা-টাও মৃত্যু শয্যায়। আজ মরে কী কাল মরে। বয়স কী ই বা আর হয়েছিল! মেয়ের চিন্তায় চিন্তায় আয়ু ক্ষয় করে ফেলল। এখন বুড়িটা মরলে দীপিকাকে কে দেখবে? হতে পারে কালো, কিন্তু এই রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ধুয়েও যে রঙ ওঠে না, সেই রঙেই সে এক কালো প্রতিমার মতো। পুরুষমাত্রই তাকে হাত বাড়িয়ে একবার ছুঁয়ে দেখতে চায়। সমাজ এই দায় নেবে কেন? সুতরাং বুড়ি মরার আগে আজকে দীপিকার পুনর্বিবাহ।
"দীপিকা!"
অদ্ভুত এক গলায় পাড়াতুতো এক মামি এসে দীপিকাকে ডাকে। দীপিকা চমকে ওঠে। এখনও পুরনো কথা নিয়ে পড়ে আছে ও বোকার মতো। এক ধাক্কায় বাস্তবে ফেরে। অবাক হয়ে বলে, "কী হয়েছে মামি?"
উত্তর পেতে দেরি হল না। মামির চোখ অনুসরণ করে একটু তাকিয়েই দীপিকা বিমূঢ় হয়ে যায়। ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্যামল। আগের চেয়ে সামান্য মোটা হয়েছে। চোখমুখ উস্কোখুস্কো লাগলেও চেহারায় একটা সুখী ভদ্রলোকের ছাপ। বোঝা যায় ভালোই আছে সে। দীপিকা দু পা পিছিয়ে গিয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয়। দীর্ঘ দশবছর। দীর্ঘ দশটি বছর পর শ্যামল আজকে তার সামনে। তাকে দেখে বুঝঞতে পারল এতদিনে তার সেই যত্নে রাখা স্মৃতির ঝাঁপি অবহেলায় পুরোটাই মলিন। এখন আর বিয়ে করতে তার মনের ভেতর কোনো দ্বিধা নেই।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴