তোর্সার ঘরবাড়ি-১৬
তোর্সার ঘর বাড়ি// ষোড়শ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
-----------------------------------------
'তোর্সারে তক্ মনের কথা কই/ নারীর দুখ জীওন মরণ মাটি বিনাই রই'
কার যাওয়ার কথা কায় যাবার ধইরছে বাপো... কাঁদে চরুয়ার প্রতিনিধি মনো।
একহাতে বহুদিন থেকে কাজ করে অভিজিৎ মিত্রের ঘরে। একটা হাত নুলো তো কি! অন্য হাতেই বাড়িঘর, বাসনকোষণ ঝকঝকে। সেই মানি দিদি চলে যাওয়া ইস্তক টাক মার যন্ত্রণা একটু করে বেড়েছে। মনো জানে। কাছ থেকে দেখা। ঐ চরুয়া জীবনের চরে বেড়ানো সুন্দরীর সঙ্গে পুনুর মেলামেশা এ তল্লাট, বৃহত্তর রাজনগর মেনে নেবে! সুমিত্রামাসি, মনো বড় দু:খী। ওরা তো জানে না মানুষ মানুষই তো বড় পরিচয়। রক্তের রঙ লাল। সে মেয়ে পড়াশুনোর মাথা ভাল। ওর মা টিনের দরজা দেয়াল পার করে ওকে ইস্কুলে ভর্তি করিয়েছে। বেশ দৌড়য় স্পোর্টসের মাঠে। নাম রেখেছে ওর মা 'নীপা'। ওর মা সেলাইয়ের কাজ করে, ওদের মত কাজের বাড়িতে বাসন মাজতে যায়না। বাপ নেই। কম ভাড়ায় কোথায় বাড়ি! পুনুর সঙ্গে ঐ স্পোর্টসের মাঠেই দেখাশোনা।
মিনি অনেকদিন আসতে পারেনি। বাবার অসুখের খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসেছিল এক কাপড়ে বাস ধরে। বাড়িতে ঢোকার মুখে কে যেন বলল, ভাল আছেরে। চিন্তা করিসনা। মা বললেন, একটু খেয়ে যা বাপু। দু মুঠো খেয়েই হাসপাতালের দিকে।। না, ভাল দেখেনি সে বাবাকে। ভুল ভুল তথ্য সব। ব্যক্তিত্ব তবু কেন নাড়া খেয়ে জেগে ওঠেনা মিনির! পুরুষতন্ত্র ঘরে বাইরে মানতে হয়েছে। মেনে নিতে হয়েছে পুনুর খবরদারি। সে মুহূর্তে অন্যত্র শিফট্ করলে হয়ত বেঁচে যেত মানুষটা। সুগার ফল, ট্রিটমেন্ট হল সেরিব্রাল অ্যাটাকের।
নদী একথা মনে রাখে।গতি ধীর হয়। মানুষ চলে যায় সেও নতুন করে মুখ ফিরিয়ে নেয় বার বার। অজস্র কথার ধারে অন্য শহরের ম্যাডামকে আর কেউ মিনি বা মোনা সম্বোধন করেনা।ডাকার কেউ নেইযে! সে ডাক শুনতে হলে এ নদীর পাড়েই এসে দাঁড়াতে হয়। জ্ঞানে অজ্ঞানে। চলচ্চিত্রের ছবির মত। যেখানে অন্ধকার একবুক জলস্রোতে নৌকো ভাসে টিম টিম লন্ঠনের আলোয়। জলের দুলুনিতে আলোর দোলায় মনে হয় জলের বুকে তারা ফুটেছে। মেছো পাড়ার পাশ দিয়ে যে রাস্তা গেছে সেটাতো সোজা উঠে গেছে তোর্সার বাঁধে।... অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মিনি এখানে এলেই, ঐ কালীতলার মন্দিরের দিকে। হাসপাতালে যন্ত্রণায় যখন ছটফট করছে বাবা ঠিক তখন ই ফুল হাতছ লাল কাপড়ের ঐ লোক এসে দাঁড়িয়েছিল দরজায়। কেউ বাধা দেয়নি। ফুল ছুঁয়ে দিয়েছিল অভিজিৎ মিত্রের কপালে। তারপর ই দ্রুত হেঁটে বেরিয়ে যায় সাধু। এখানেও ভালবাসার মানুষ একে একে তৈরি করে নিয়েছিল বাবা। ঠিক তার পাশে যে প্রেস, ওখান থেকে বেরোত'রাজনগর সমাচার', তার সম্পাদকপদে বুড়ো মনোজ দাদুর ছেলে তখন। সেও ছুটে এসেছিল। এত মানুষের ভালবাসার দাবীটা একটু কি দেরী হল দানা বাঁধতে! পরদিন অভিজিৎ বাবু চললেন শিলিগুড়ি নার্সিং হোম। ততক্ষণে কোমায় চলে গেছে মিনির বাবা। ছোট্ট হয়ে এসেছে আই সি ইউতে রাখা শরীর। শিলিগুড়ি হেড অফিসের লোকেরাও ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল, অবিশ্বাস্য লেগেছিল 'বাবা নেই' একথা শুনতে।...কেমন যেন পৃথিবীটা বদলে গেল মিনির।
* * *
প্রজ্ঞা ম্যাডামের বাড়ির ছাদে তিনদিনের কাজে সহকর্মীরা এসেছিল। বাবার ছবিটা এখনো জীবন্ত। পুজো করেছিলেন যে পুরোহিত তিনি বলেছিলেন বড় ভালো সময়ে চলে গেছেন উনি। বড় ভালমানুষ ছিলেন। তোর্সার মূল ধারা আরো একবার বিচ্ছিন্ন হল। হারালো 'মিনি' ডাক দেবার সেই মানুষ। বাড়ির সামনে রবার গাছের পুরুষ্টু পাতা এখনো ছাগলেরা খেতে আসে। কচিপাতা মুখে নিয়ে চোয়াল নাড়তেই থাকে। মিনির সে ঘরের রোয়াক শূন্য এখন। কখনো বা ঘন্টি বাজে। এসে দাঁড়ায় ছায়ার মত এবাড়ির মেয়ে। সে যেন অন্য বাড়ির অন্য জায়গার। অন্য নদীর হয়ে থাকা এক মানুষ। কিন্তু মা ... তাঁর যন্ত্রণা গুলো দেখেছে আগেও, পরেও।সুস্থ হয়ে অফিসের কাজ সেরে আবার আগের মত উষ্ণতা। প্রজ্ঞার মেয়ে রোহিনী তখন ফোর। সেও মার সঙ্গে এসে দাঁড়ায় দাদুর বাড়ির অন্দর মহলে। আগের সে আনন্দ নিংড়ে নিতে পারেনা। তবু দিদাম্মার নরম শাড়ির আঁচলে মুখ ডুবিয়ে বিশেষ গন্ধ পায় সে। মার কাছে শোনা নদীর গল্পকথা খুঁজে নিতে পুনুর হাত ধরে দূরের অভিমানী তোর্সার বয়ে যাওয়া দেখে। দেখে বেড়ায় শহরের দীঘিগুলো। বৈরাগী দীঘির অন্যধারে বিরাট সাদা গম্বুজ মদনমোহন বাড়ি। এখানকার আকর্ষণ অন্যরকম। এলেই জলে পা ধুয়ে ঢোল দাদুর সন্দেশ কিনে পুজো দেওয়া মার নেশা। রোহিনীও তার সঙ্গী হয়েছে কতদিন, কখনো বাবার ।ঐ গম্ভীর বাবাকেও আসতে হয়েছে কতবার। ঐ পুজো, দাদুর অসুখ, দিদার চলে যাওয়া সব সব ছবির মত নেমে আসে রোহিনীর ছোটবেলা জুড়ে। স্থিরচিত্র হয়ে ঘোরে ফেরে। পুনুমামার অধুনা দোতলার রেলিঙ বারান্দা পেরিয়ে ছাদে উঠলেই সে মার তোর্সা ঘেরা কথকতা শোনে। মা কেমন ছেলেমানুষ হয়ে যায়। গড়গড়িয়ে তোর্সার খেজুর গাছের গল্প, বন্যা আর কাঠ ভেসে যাওয়ার গল্প, ঘনারামের কথা, মিলুর কথা গল্প করে। রোহিনী সেসব ছবির মত নামা ওঠা করতে দেখে। না দেখা অর্জুন, কাঠগোলাপ সবার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। মিনি মার ভিতরের ছেলেমানুষ অন্য মেয়ে রোহিনীকে আচ্ছন্ন করে। ঠিক যেমন মাকে আচ্ছন্ন করে রাখে দাদু আর ঐ তোর্সা আর পুরো রাজনগরের সত্য ও কিছু ভাবনার ইতিহাস।
রোহিনী নামের কোন নদীই যেন মার স্বপ্নে ছিল। কালো হারমোনিয়ামটা মার ছোট্টবেলার। এর আগে মার কাছে হলদে ডোয়ারকিন হারমোনিয়ামের গল্প শুনেছে।সেটা ছিল মার বিনু দিদির। পুরোনো তাই ভাল বাজতনা তবু আকাশে মেঘ জমলে, তোর্সা নদীর জল বাড়লে, পুঁতে রাখা কাঠি ডুব দিতে দিতে হারিয়ে গেলে মা গান গাইত, দাদুও। ঠিক যেমন রোহিনী গায় মার সঙ্গে। মা ওকে আদর করে ডাকে 'রু'। রাজনগরের ছায়ায় মায়ায় মা পেয়েছে নদীর আস্বাদ আর বন্ধুত্ব। রোহিনী যতবার এসেছে, উঁচু বাঁধে দাঁড়িয়ে দেখেছে নদী দূরে আরো দূরে চলে যাচ্ছে। অভিমানে! ঠিক যেদিন দিদাম্মা চলে গেল কতদিনের কত কষ্টের পর রোহিনী এসেছিল বাবার হাত ধরে। মা তখন কলেজের কাজ নিয়ে অনেক দূর। শেষ লগ্নের কষ্টবোধ যে কাছে না থাকে তার আরো বেশি, তার শূন্যতাটুকু সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। সেটা মা বহন করে চলেছে। চলবে আজীবন।
এ নদীর সঙ্গে যেন প্রাণের কথা তৈরি হয় রোহিনীর ও। মার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুরা, চরের মানুষদের সন্ধানে দুচোখ তার কি যেন খোঁজে! এ নদী কত দূরের বন্ধু। রাজনগরে কাছের খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে রোহিনীর অদ্ভুত নামের দীঘিগুলো। এদের পাড়ে দাঁড়িয়ে ঘাটে ঘাটে সন্ধে্য অপূর্ব রূপ অথবা ভোরের ছায়া মাখা অদৃশ্য টানে রোহিনী, মার আদরের রু নিজস্ব অবস্থান ভুলে যেত। প্রতিবছর পুজোয় বায়না, জেদ চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছত...রাজনগর যেতেই হবে তার। এখনো সে মনে করতে পারে মার গায়ে জ্বর প্রায় চার ছাড়িয়েছে, পরদিন ষষ্ঠী। বাবা মা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবার আর যাওয়া হলোনা। কিন্তু ঐযে রু এর ভীষণ ভীষণ মনখারাপে পরদিন মত বদলে ওষুধপত্র বগলে নিয়ে ঠিক পৌঁছে যাওয়া সার্বজনীন দুর্গোৎসবে। পাশে চিরন্তন দেবীবাড়ির পুজোর কাছে আর মদনমোহনবাড়ির দুর্গা প্রতিমার মায়াবী টানের কাছে। ওখানে গেলে প্রজ্ঞা কখন যে মিনি হয়ে যেত তা মেয়ে রোহিনীর চোখে অবাক করা এক গল্প।
প্রিয় বৈরাগী দীঘি ছুঁয়ে ছুঁয়ে নরসিং দীঘির কাছে নিয়ে যেত পুনু মামা।জল চেনাত, কি করে লালদীঘির জল এমন রঙ, কখন তৈরি হল সব এতবড় বড় চোখে শুনত সে। আর সবচেয়ে প্রিয় সাগরদীঘির গভীর জলে নিজেকেই পরিযায়ী মনে হত। থাকত যদি দুই ডানা আর হাঁসেদের মত ভেসে বেড়ানোর ক্ষমতা ঠিক ঐ কাকচক্ষু জলে ঝাঁপ দিত রু।
বড়দেবীর মূর্তি দেখতে গিয়ে বিনু মাসির বাড়ি বেড়াতে যাওয়াও হত আর দেখা হত যমুনা দীঘির সঙ্গে। কবে থূকে যে সে দীঘির নাম লম্বা দীঘি হল তাই বা কে বলবে রু কে। পুনু মামা যেসব শুনেছে, সব দেখিয়ে ঘুরিয়েছে। একবার সাগরদীঘিতে বিকেল তিনটে থেকে বোট রাইডিং শুরু হল। সাগরদীঘির সবদিক ডুম লাইটে রঙীণ করে দিল প্রশাসন । রোহিনী তখন ছোট্টটি। দিম্মার দুর্বলতা লরীরে থাকলেও মনে তো সজীব ছিলেন... সবাই মিলে দুটো বোট নিয়ে পুরো সাগরদীঘি ঘোরা হল। মার কোলে জড়সড় তখন রু। সেখানে বসে শুনেছিল এ দীঘিতে বাইচ খেলার কথা, মদনমোহনকে নিয়ে রাজার নৌকো বওয়ার গল্প। সব যেন কেমন স্বপ্নপুরীর মত। আর সাগরদীঘির পাড়ে এলেই দূরে রাজবাড়ির লাল ইট আর উঁচু গম্বুজ কোন সে আমলে যে নিয়ে যায় রোহিনীকে!
* * *
তোর্সা যেমন দূরে আরো দূরে যেতে থাকে, চরের বাড়িগুলো বদলে গেছে তত ই। রোহিনী প্রজ্ঞা আর সে লাল ইটের সঙ্গে বন্ধুত্ব সুতো শক্ত করে বাঁধল ক ই! যে বাঁধবে সেই মানুষ ইতো নেই। দাদু দিম্মার জন্য রোহিনীর মন কাঁদে। যত বড় হয় মার পাথরের মত মুখের সে কোচবিহারের গল্পগুলো ফুরিয়ে যেতে থাকে যেন। রোহিনীতো সে ছবিগুলোর টুকরো কোলাজ বুকের মধ্যে বাঁধিয়ে রেখেছে। সে সব আবার কবে দেখবে সে, জানে অনেক বদলে গেছে রাস্তা থেকে বাড়িঘর, নতুন বিল্ডিং এর সারি দেওয়া ভীড়। কিন্তু রাজ আমলতো ধরে রেখেছে রাজবাড়ি, পথঘাট।আর বছর বছর অন্তত: একবার গাড়ি নিয়ে রাসমেলা দেখতে যাওয়া।* * *
মিনির কষ্ট আর শূন্যতা ঐ নদীর মতোই। চেনা মুখের সব যদি হারিয়ে যায় চেনা গাছগুলোর ধ্বংসাবশেষটুকুও থাকেনা, নিজস্ব মাটি নিজের হাত বাড়ানো জশ, মার হাতে বোনা নারকেল গাছ, নিমের হাওয়া সব যদি অধিকার বদলে যায়...সে ইতিহাস কি করে ছুঁয়ে দেবে, কি করে 'রু' কে বাকিটুকু বলবে...প্রত্ন সম্পদটুকু, লাল ইটের জমে থাকা অক্ষর ভাগ করে নেবে কি করে চল্লিশোর্ধ মিনি....
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴