আমি এক যাযাবর-১৬/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর (ষোড়শ পর্ব)
শৌভিক কুন্ডা
বৃষ্টি ঘুম পারিয়ে রেখেছিলো ছোট্ট বেলার মায়ের মতোই। ঘুম ভাঙতে ভোর, তখনও বৃষ্টি, তবে জোশ কমেছে। বিট্টুকে ফোন করলাম, বললো একটু পরেই আসছে। সঞ্জীব আদা-লবন-দারচিনি সহযোগে চা দিয়ে গেলো। একটু পরে আমার চাহিদামতো রুটি আর সবজি।
আজ বুধবার। সঞ্জীবও উশখুশ করছে। অতিথি, তুম কব যাওগে আর কি! আজ ওরও তো বাড়ি ফেরার দিন! খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি অবশ্য। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বিট্টুর বাইক হাজির। টাকাপয়সা মিটিয়ে সওয়ার হলাম। মাঝপথে ঘচাং ব্রেক। বার্কিং ডিয়ার রাস্তা পেরোলো লাফিয়ে। ইচ্ছে ছিলো হোমস্টেতে ঢোকার আগে হাট ঘুরে যাবো। কিন্তু বৃষ্টি তা আর হতে দিলো না। গ্রেসি লিপসে পৌঁছে শুনি তারা দাজু বাজার থেকে ফেরেন নি তখনও। আটের দশকে সম্ভবত শিকার করা আইনত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তার আগে পর্যন্ত বিটিআর জঙ্গলে শিকারী হিসেবে বিখ্যাত নামগুলোর অন্যতম এই তারাশঙ্কর থাপা। বহুকালের পরিচিতি আমার সাথে। পঁচিশ বছর আগে ওঁর এই হোমস্টে থেকেই কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া শুকনো ডালের কুটুমকাটাম আমাদের বাড়িতে আজও সাজানো আছে। বক্সায় বিখ্যাত ইন্দ্র বাবুর যে হোমস্টে, সে জমিটিও তারা দাজুরই পৈত্রিক সম্পত্তি ছিলো। আর এই গ্রেসি লিপস, আমার জানা অনুযায়ী, এ তল্লাটের প্রথম হোমস্টে।
এ বাড়ির সামনের দিকে যে কাঠের দোতলা, তারই বারান্দায় অপেক্ষা করছিলাম। দোতলাতে অতিথিদের জন্য তিনটি ঘর ছিলো শুরুর দিকে। পাশেই সিমেন্টেড ডাইনিং। সেটাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারাদা বাজার থেকে ফিরলে রূপান্তরটি পুরোপুরি বুঝতে পারলাম। এই পুরনো বাড়ির পেছন দিকে সবুজ লন, যত্নে সাজানো অজস্র গাছের সাক্ষী হয়ে টানা বারান্দা নিয়ে তিনটি ঘর এখন অতিথিদের। একটি আমার জন্য বরাদ্দ। পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তারা দাজু কতটা খুঁতখুঁতে, সেটা বোঝা যায় বারবার স্টিল রঙের রেলিং মুছতে থাকা দেখলে। দু দিন ছিলাম, দু দিনে অন্তত দু'শো বার রেলিং মুছতে, র্যাগ টেনে বারান্দা মুছতে দেখেছি ওঁকে! কথা বলতে বলতেই গাছের পরিচর্যাও করতে থাকেন। সান্ত্রাঁবাড়ির হাটে যেতে পারি নি, আজও রাজাভাতখাওয়ার হাট মিস করলাম, এ কথা বলাতে তারা দাজু বললেন, "বিকেলের দিকে বৃষ্টি ধরে আসবে মনে হয়, দমনপুর হাটে চলে যান, এ তল্লাটের সবচাইতে বড়ো হাট। সবচেয়ে পুরনোও। আগে তো এই হাটে ভুটান, আসাম থেকেও আসতো মানুষেরা।"
রাজাভাতখাওয়ায় থাকবো জেনে বল্লরী ডাক দিয়েছিলো আলিপুরদুয়ারে ওর বাড়িতে। এমনকি স্থানীয় বন্ধু মানুষ নুপুদার ফোন নাম্বারও দিয়ে দিয়েছিলো, যাতে ওঁকে নিয়েই যেতে পারি। কিন্তু, একে বৃষ্টি, তার ওপর নুপু'দার অসুবিধে, তারও পরে দমনপুর হাটের হাতছানি, অতএব সে ইচ্ছে ছাড়তে হ'ল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সারার অবসরেই অবশ্য সন্দেশ এলো, মহম্মদের কাছেই আসবে পর্বত! সেইমতো বিকেল বিকেল বল্লরী আর ওর সহকর্মীরা চলে এলো গ্রেসি লিপসে, আমার ডেরায়! কেউ বুঝতে পারবে না, এমনকি আমি-বল্লরীও, যে এই আমাদের প্রথম দেখা, ফেসবুক ছাড়িয়ে! গল্পে আড্ডায়, কফি-পকোড়ায় বেশ কিছুক্ষণ সুন্দর সময় কাটলো। এই আচমকা আনন্দ রোজকার জীবনে প্রাপ্তির বৈচিত্র্য নিয়ে আসে। ওদের ফিরতে হবে আলিপুরদুয়ার, আমিও দমনপুর ছুটবো, বিকেল নিভে আসছে, বৃষ্টি তার ঝাঁঝ কমিয়েছে। সুতরাং এ যাত্রার আড্ডা থামাতেই হ'ল। তবে আবারও দেখা হবে রে বল্লরী।
ওরা চলে গেলে আমিও রওনা হলাম। অমৃত অটোরিকশা নিয়ে অপেক্ষা করছিলো গ্রেসি লিপসের দরজায়। তারা দাজুই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অমৃত বেশ হাসিখুশি গপ্পি ছেলে। বৃষ্টিভেজা হাটে আজ মানুষজন কম, শুনলাম। কিন্তু যা দেখলাম, আমার চোখে ভীড় কিছু কম নয়। বিরাট বড়ো হাট। শুধু সবজির সম্ভারই যে কোনো মফস্বলি রোজকার বাজারকে টেক্কা দিতে পারে! জামা-কাপড়, হাঁড়ি-কড়াই, তেলেভাজা, মশারি, মাটির-কাঠের-বাঁশের পাত্র,আসবাব, এককথায় আলপিন থেকে আলমারি : কি নেই! তবে প্যাচপেচে কাদায় বেশিক্ষণ হাঁটা গেল না। অমৃত এবার নিয়ে গেল, আমারই তাড়নায়, পথের ধারের চা-দোকানে। তন্দুর চায়ের স্বাদ নিলাম। ইচ্ছে ছিলো ডিমা ব্রিজ যাওয়ার। কিন্তু সদাহাস্যোজ্বল অমৃতের মুখে ছায়া নামলো। "আবার প্রদীপ দার বাড়ি যাবেন স্যার, ডিমা আজকে বাদ থাক, অন্ধকার হয়ে আসতেছে, বলা যায় না কখন কি বার হবে!" 'কি' বলতে গজরাজ। চিতাও নাকি আছে ও তল্লাটে। অতএব পাম্পু বস্তির রাস্তা। রাজাভাতখাওয়ায় এসে প্রদীপের সাথে দেখা করবো না, এমনটা হয়? প্রদীপের হোমস্টেতে দুবার থেকেছি আগে। অনুজ, অধ্যাপক রূপন সরকারের বাল্যবন্ধু প্রদীপ দুদিনের পরিচয়েই আমারও বন্ধু। তবে এবার কেবল বুড়ি ছোঁয়াই সারতে হ'ল। বৃষ্টি আবার তেজ বাড়িয়েছে। তারাদাজুর আস্তানায় ফিরে দেখি আমার পাশের ঘরটিতেও অতিথি এসেছেন। আসাম থেকে। স্বামী-স্ত্রী, এক কন্যা।
(চলবে)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴