সাইলি চা বাগিচার সবুজ সমুদ্রে/গৌতম চক্রবর্তী
সাইলি চা বাগিচার সবুজ সমুদ্রে
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
এবারের সফর পিকনিকের মুডে। কেবল ডুয়ার্স নয়, গোটা উত্তরবঙ্গবাসী শীতে বনভোজনে উৎসাহিত হয়ে ওঠে প্রবলভাবে। হাতে একটা ছুটির দিন পেলেই হলো। দলবেঁধে দে ছুট। পাহাড়ে জঙ্গলে অথবা নদীর ধারের পরিচিত পিকনিক স্পটগুলিতে ভিড় লেগেই থাকে। পশ্চিম ডুয়ার্সও তার ব্যতিক্রম নয়। ঝালং, বিন্দু, রকি আইল্যান্ড, লালিগুরাসের পাশাপাশি গরুবাথানের ডালিমখোলা বা পাপরখেতিও তৈরি থাকে প্রতিবছরই বনভোজনপ্রেমীদের স্বাগত জানাতে। শীতের
পিকনিক মরসুমে চেনাজানা স্পটগুলোর পাশাপাশি বনভোজনের জন্য আকর্ষণীয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে পশ্চিম ডুয়ার্সের অপরিচিত কিছু জায়গা। চেল লাইন পিকনিক স্পট তার মধ্যে অন্যতম। তবে এবার বাদ সেধেছে কালান্তক করোনা। তাই কেমন যেন ভাঁটার টান সবকিছুতেই। আমার কিন্তু চরৈবেতিতে ভাটা নেই। ফাঁক পেলেই দে ছুট। কারণ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যে কোন চা বাগানে ঢুকে পড়ে কাজ সেরে আবার বাড়ি ফিরলে সারাদিনে যা রসদ সংগ্রহ হবে তা অন্তত দশটা লেখাতে কাজে লাগবে আমার। আমি অন্তত ক্ষেত্রসমীক্ষা বা সার্ভে বা গল্প বা তথ্য চয়ন যাই বলুন না কেন, সেইভাবেই করি। এবারেও সাইলি চা বাগিচাতে যখন এলাম তখন ভাবছিলাম এখনো এসব সার্কিট কেন চা পর্যটনে জুড়ে দিচ্ছে না সরকার। ভাবছিলাম আর ডামডিম মোড় থেকে টোটোতে করে এগোচ্ছিলাম সাইলি ফ্যাক্টরির দিকে। মালবাজার সাব ডিভিশনের সাইলি টি গার্ডেনটি সাইলি টি এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানীর নামেই পরিচালিত হয়। বর্তমান কোম্পানী ২০১১ সালে বাগানটির দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
ফ্যাক্টরিতে ঢোকার আগে টোটোওয়ালা ছেলেটার আগ্রহে গেলাম চেল লাইন পিকনক স্পটে। রাঙ্গামাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত সাইলি চা বাগানের চেললাইন শ্রমিক বস্তির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। তার ধারে বনভোজনপ্রেমীদের পাশাপাশি যদি ডুয়ার্স বেড়াতে আসা পর্যটকেরা ভিড় জমান তাহলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কারণ চেললাইনের অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্যের কথা যেভাবে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। বাজার থেকে ডামডিম হয়ে যে পথটা গরুবাথানের দিকে চলে গেছে সেই পথে সাইলি হাট পৌঁছে বাঁ দিকে বাঁক নিলে জেলা পরিষদের রাস্তা। পিচঢালা, সরু রাস্তাটির ডান ধারে সাইলি এবং বাঁয়ে রানীচেরা চা বাগানকে দাঁড় করিয়ে রেখে সোজা পৌঁছে গেছে চেল নদীর ধারে। ওই নদী তার উৎসমুখ থেকে নৃত্যরতা সুন্দরীর মতো একের পর এক পাহাড়ি পথ পরিক্রমা করে অবশেষে গরুবাথান পেরিয়ে সমতলে নেমেছে। যদিও গরুবাথান পেরিয়ে এসে চেল নদী এখানে বেশ চওড়া। তার গতি অনেক স্লথ। দীর্ঘ পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে নদী যেন কিছুটা ক্লান্ত। তাই চেল এখানে খরস্রোতা নয়। সেখানে শান্ত নদীর উত্তর পশ্চিম দিকে চোখ মেললেই দেখা যায় নদীর ধার থেকেই যেন মাথা তুলেছে হিমালয়। তারপর শৃঙ্গের পর শৃঙ্গের ঢেউ তুলে এগিয়ে গেছে। উত্তর আর পশ্চিমে অদূরেই ভুট্টাবাড়ির জঙ্গল। সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লেই খাবারের সন্ধানে যেখান সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে হাতির দল। তারপর পাহাড় যেখানে নদীর কাছে নতজানু হয়েছে ঠিক সেই পথ ধরে সোনালী ধানের খোঁজে ছড়িয়ে যেতে পারে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম, এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে।
ফ্যাক্টরিতে ঢুকতে গিয়ে দেখলাম গেট মিটিং হচ্ছে। দেখা জয়েন্ট ফোরামের জিয়াউল আলমের সঙ্গে। ১ লা জানুয়ারী থেকে ন্যূনতম মজুরী চালু হবার একটা সম্ভাবনা ছিল। সেটা ভেস্তে যাওয়াতে শ্রমিকেরা ক্ষেপে আগুণ। তাই গেট মিটিং। ভেস্তে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে জিয়াদার কাছ থেকে জানতে পারলাম ন্যূনতম মজুরি নিয়ে ১ লা ডিসেম্বর শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্নার উপস্থিতিতে মাদারিহাটে ৩০ সদস্যের পরামর্শদাতা কমিটির ১৬ তম বৈঠক হয়। সেখানে শ্রমিক প্রতিনিধিরা ন্যূনতম মজুরি নিয়ে তাদের বক্তব্য লিখিতভাবে রাজ্যকে জানিয়ে দেয়। মালিকদের বক্তব্য জানানোর জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়। ন্যূনতম মজুরির পরামর্শদাতা কমিটি থেকে সব পক্ষকে নিয়ে আলোচনার সুবিধার জন্য যে ছয় সদস্যের ছোট কমিটি গঠিত হয়েছিল তাদের বৈঠক ২৪ শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত করার কথা বলা হয়। চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে সিদ্ধান্ত হয় ২৪ শে ডিসেম্বর কলকাতার নিউ সেক্রেটারিয়েট ভবনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই আশাবাদী হয়ে ওঠে। ন্যূনতম মজুরির ৩০ সদস্যের বড় কমিটির বৈঠক থেকে তা চূড়ান্ত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন বছরের পয়লা জানুয়ারি থেকেই চা শ্রমিকদের মজুরি প্রদান করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল । চা বাগিচার শ্রমিক মহলও আশাবাদী ছিল। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে ছয় সদস্যের যে কমিটি তার অন্যতম শ্রমিক প্রতিনিধি জিয়াউল আলম জানান ২৪ তারিখের আলোচনার পর বড় কমিটির বৈঠকে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যাবে বলে আশা করা গিয়েছিল এবং পয়লা জানুয়ারি থেকেই তা কার্যকরী হবে বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু মালিকপক্ষের প্রস্তাবগুলি জমা না পড়ার জন্যই এই বৈঠক সংগঠিত হতে পারল না। তাই ২৪ ডিসেম্বরের চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সংক্রান্ত ছোট কমিটির বৈঠকেও মজুরি বৃদ্ধির হার নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো না।
অক্টাভিয়াস টি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড ১৯২২ সালের একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পাণী। কোলকাতাতে অবস্থিত। প্রায় পাঁচ বছর ধরে নীলিমা জৈন অন্যতম বোর্ড অব ডিরেকটর। ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ মাসে তিনি ডিরেকটর হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২০২০ সালের ৩১ শে আগস্ট প্রদীপ কুমার কোকা, অঞ্জনা জৈন এবং নলিনী জৈন ডিরেকটর হিসাবে যোগদান করেন। ডিবিআইটিএ ম্যানেজমেন্ট সংগঠনের সদস্য এই বাগানটিতে মোট ম্যানেজারিয়াল স্টাফ ৫ জন। জয়েন্ট ফোরাম এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলের ট্রেড ইউনিয়নগুলি ছাড়া অন্যগুলির অস্তিত্ব আগে থাকলেও বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। সাইলি চা বাগানটির আয়তন এবং ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত চাষযোগ্য আবাদী অন্চল ৫৯১.৪৪ হেক্টর। প্ল্যান্টেশন এরিয়া থেকে প্রতি হেক্টর জমি পিছু ১০৭০ কেজি করে চা ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয়। বাগানের নিজস্ব কাঁচা চা পাতা উৎপাদনের গড় ৩২—৩৫ লাখ কেজি। ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত তৈরি চা ৭-৮ লাখ কেজি। বাইরের বাগান থেকে সংগৃহীত কাঁচা পাতা থেকে প্রস্তুত রেডিমেড চা গড়ে প্রায় ৫০০০০ কেজি। মোট বাৎসরিক উৎপাদিত চা ৭—৮ লাখ কেজি। বাগানে ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা উৎপাদিত হয়। বাগানটির লীজ হোল্ডার অক্টাভিয়াস টি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। লীজের ভ্যালিডিটির সময়সীমা ২৩.৫.২০২৫ পর্যন্ত। বাগান পরিচালনার কার্যকর মূলধন আসে ব্যাঙ্ক, এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। ইউবিআইএর কাছে বাগানটি আর্থিকভাবে দায়বদ্ধ। বাগিচার সাব স্টাফের সংখ্যা ৭৬ জন, করণিক ০৯ জন, ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ ১২ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ১০৪০। মোট জনসংখ্যা ৬৭৩০ জন। স্থায়ী শ্রমিক ১৪১৭ জন। ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত স্টাফ এবং শ্রমিক সংখ্যা ৬৮ জন। সর্বমোট সাব স্টাফ ৭৬ জন। মোট কর্মরত শ্রমিক ১৬১৬ জন। অশ্রমিক সংখ্যা ৫১১৪ জন।
সাইলি বাগানের মোট শ্রমিক আবাস ১৪৫৯ টি । বাগানে শতকরা ৭০ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। বাগিচায় শৌচাগারের সংখ্যা ৫০ টি। সাইলি চা বাগিচায় একটি ছোট হাসপাতাল এবং ডিসপেনসরি ৩ টি। আবাসিক ডাক্তার আছে। প্রশিক্ষিত নার্স নেই। বাগিচায় নার্সের সহযোগী মিড ওয়াইভস ১ জন। কম্পাউন্ডার অথবা স্বাস্থ্য সহযোগী ১ জন। মেল ওয়ার্ডের বেড সংখ্যা ১৬ টি। ফিমেল ওয়ার্ডের সংখ্যা ১২ টি। আইসোলেশন ওয়ার্ড এবং মেটারনিটি ওয়ার্ড ১ টি করে। বাগিচার হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার নেই। অ্যাম্বুলেন্স আছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ হয় না। লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই ২০০৪ সাল থেকে। ভ্রাম্যমান ক্রেশের সংখ্যা ৩ টি। স্তায়ী ক্রেশ নেই। ক্রেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা, শৌচালয় নেই। শিশুদের পোশাক সরবরাহ করা হয় না নিয়মিত। ক্রেশে মোট অ্যাটেন্ডেন্ট ৩ জন। বাগিচায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। বাগিচা সংলগ্ন উচ্চ বিদ্যালয় নেই। শ্রমিক সন্তানদের বিদ্যালয়ে নেবার জন্য যানবাহনের ব্যাবস্থা হিসাবে একটা বাস আছে। অধিকাংশ সময়ে অচল হয়ে পড়ে থাকে। বাগিচায় বাৎসরিক বোনাসের পরিমাণ ২০% হলেও এই বোনাস দেওয়া হয় না। বোনাসের টাকা অনেক সময়েই বকেয়া থাকে। বকেয়া পি এফ এর মোট অর্থও বেশ কয়েকলাখ টাকা। গ্র্যাচুইটি বাবদ বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বছরে গড়ে চার লাখ টাকা। অনেক সময়ে গ্র্যাচুয়িটিও বকেয়া থাকে। বছরে গড়ে ১৫০ জনের ওপর শ্রমিক গ্র্যাচুইটি পেয়ে থাকে।
এলাম শতাব্দী প্রাচীন ওয়েস্টার্ণ ডুয়ার্স ক্লাবে। প্রাক স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার পরবর্তীকালে মালবাজারের বিশেষ আকর্ষণ ছিল এই ইউরোপীয়ান ক্লাব। ইউরোপীয়রা চলে যাবার পর এই ইউরোপীয়ান ক্লাবটির নামকরণ করা হয় ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স ক্লাব। ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে উত্তর দিকে পিচ রাস্তা ধরে অগ্রসর হয়ে চেল নদীর পাশে রানীচেরা চা বাগানের অন্দরে এক অনিন্দ্যসুন্দর স্থানে এই ক্লাবটি গড়ে উঠেছে। চেল নদীর পূর্ব প্রান্তে রয়েছে এই ক্লাব যাকে স্থানীয় লোকেরা বলে চেল ক্লাব। ক্লাবের ঠিক সামনেই রয়েছে সবুজ মখমলের মতো গলফ কোর্স। ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন চা বাগানের ম্যানেজারেরা সাজসরঞ্জাম নিয়ে নেমে পড়তেন গলফ খেলতে। এখনো গলফের আসর বসে। চা বাগানের ব্রিটিশ ম্যানেজারদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল সুইমিং পুল। বাস্কেটবল, লন টেনিসের পাশাপাশি বিভিন্ন ইনডোর গেম এখানে খেলা হতো। এছাড়াও ক্লাবের ভিতরে কাঠের তৈরি ড্যান্স ফ্লোর এবং পুরনো আসবাবপত্র আজও এই ক্লাবের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। যদিও চা শিল্পের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে জৌলুশ অনেকটাই অস্তমিত। তবুও চেল নদীর ধারে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের মাঝে লাল রংয়ের চেল ক্লাব চেল লাইনের অন্যতম আকর্ষণ। ক্লাবের সামনে পেছনে এবং ডাইনে বাঁয়ে যেন সবুজের গালিচা পাতা। ক্লাবের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে চেল নদী। নদীর ধারে রয়েছে মখমল মসৃণ গলফ কোর্ট। নদীর ওপারে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবুজ ভুটান পাহাড়।
এই ক্লাবটির প্রতিষ্ঠাকাল ছিল ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ। মালবাজার সংলগ্ন ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্স এর সমস্ত চা বাগানের ব্রিটিশ সাহেবেরা তাদের অবসর বিনোদনের জন্য এই ক্লাবে আসত। প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এই ক্লাবে রয়েছে তিনটি লন টেনিস এবং একটি ব্যাডমিন্টন কোর্ট। অন্দরে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন বিলিয়ার্ড বোর্ড এবং একটি গ্র্যান্ড পিয়ানো। চার হাজার স্কোয়ার ফিটের কাঠের তৈরি সুন্দর ডান্স ফ্লোরে প্রতি শনিবার সন্ধ্যা থেকে সাহেব মেমেরা জমায়েত হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত নাচ গান এবং মদ্যপান করত। চা বাগানের শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে এক টুকরো বিনোদন এবং বিলাসের কেন্দ্রস্থল ছিলো এই ক্লাব। তাই এই ক্লাব হাউসের প্রতিটি ইঞ্চিতে ছড়িয়ে ছিলো আভিজাত্যের পরশ। এই ক্লাবে ভারতীয়দের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এখনো প্রতি শনি রবিবার সন্ধ্যাকালীন জমায়েত হয় এবং বসে পাণীয়ের আসর। এছাড়াও রয়েছে প্রায় তিনহাজার বইসমৃদ্ধ ক্লাবের নিজস্ব লাইব্রেরী কক্ষ। ক্লাবটির সামনে ছিল এক বিশাল মাঠ যে মাঠে প্রতি শনিবার এবং বুধবার পোলো খেলা হতো। শীতের সময় এই মাঠে পোলো টুর্নামেন্ট হত। দার্জিলিং ইউরোপিয়ান ক্লাব, ক্যালকাটা ইউরোপিয়ান ক্লাব, কালিম্পং ইউরোপিয়ান ক্লাব, আসাম ইউরোপিয়ান ক্লাব প্রভৃতি বিভিন্ন ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলি এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করত।
ক্লাবের সামনে চেল নদীর গা ঘেঁষে তৈরি হয়েছে ১৪৮.২ একর জমি নিয়ে এক বিশাল গলফ কোর্ট। ১৯৬০-৬২ খ্রিস্টাব্দে ডিবিআইটিএর চেয়ারম্যান গ্রিয়ারসন সাহেব তাঁর ছোট প্লেন নিয়ে গলফ খেলার জন্য এই মাঠে আসতেন। ১৮ টি হোলবিশিষ্ট এই গলফ কোর্টটিতে খেলা চলে প্রতি বুধবার এবং রবিবার। এই গলফ কোর্টে প্রতিবছর অনেকগুলি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় গলফ প্রতিযোগিতা প্রতিবছর ডিসেম্বর জানুয়ারী মাসে এই গলফ কোর্টে অনুষ্ঠিত হয়। ডুয়ার্স ইউনিয়ন আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, কালিম্পং, ভুটান, আসাম এবং নেপালের গলফাররা। চন্ডীগড় কিংবা কুন্নুর প্ল্যান্টার্স ক্লাব আয়োজিত গলফ প্রতিযোগিতাতেও পাড়ি জমান এই ক্লাবের সদস্যরা। এখানে রয়েছে গলফ ইকুইপমেন্ট এবং অ্যাক্সেসরিজ। আছে প্রশিক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থাও। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় শীতকালে এবং যে কেউ এর সুযোগ নিতে পারেন। ক্লাবের তরফে প্রতিবছর পুষ্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রায় দু হাজার লোকের উপস্থিতিতে পালন করা হয় বড়দিন এবং নিউ ইয়ার্স ডে। সবুজ গালিচায় শরীর এবং মনকে সতেজ এবং উষ্ণ করবার এই আয়োজনে অংশ নিতে পারেন সকলেই। সেগুন কাঠের চিনা মিস্ত্রিদের হাতে তৈরি সুন্দর ক্লাব কক্ষটির অস্তিত্ব বর্তমানে আর নেই। যদিও চা-শিল্পের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবের সেই জৌলুস অনেকটাই অস্তমিত, তবুও চেল নদীর ধারে আদিগন্ত বিস্তৃত সবুজের মাঝে লাল রংয়ের ক্লাব চেল লাইনের অন্যতম আকর্ষণ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴