শেষ বেলাতে হাতি /অমিত কুমার দে
শেষ বেলাতে হাতি
অমিত কুমার দে
----------------------
এবার জয়ন্তী নদী পেরোলাম নিজে গাড়ি চালিয়ে। চৈত্রের শুকনো নদীবুকে দু’বার জলধারা পেলাম। এর আগের বার অজয়-এর বাড়িতে গাড়ি রেখে সাফারি গাড়ি করে নদী পেরিয়েছিলাম।
এবড়োখেবড়ো নদীরাস্তায় হেলেদুলে আবার ভুটিয়াবস্তি। কিছু কিছু জায়গা বারবার টানে। মনে হয় থেকেই যাই! কোলাহলের বাইরে যেখানে প্রশান্ত শান্তি এসে বসে।
সেই আগের হোম স্টে। একই রকম আছে। বাঁধে উঠেই কাঠের দোতলাটি দেখে মনে হল নিজের বাড়িতেই আবার অনেকদিন পর এলাম। এবার সঙ্গে প্রিয় বন্ধু প্রদীপ সাহা সপরিবারে এবং একমাত্র শ্যালিকা মৌ সরকার (মন) সপরিবারে। মন-এর মেয়ে তিপাই ট্রাভেল ভ্লগ বানাবে, ড্রাইভার মেসোর পাশে বসে অনর্গল ভিডিও করে গেল প্রায় পুরো পথ। মাঝে মাঝে মেসোর দিকে মোবাইল ক্যামেরা তাক করে বলছে – তুমি কিছু বলো!
আজ নদী জুড়ে পাগল হাওয়া। এ হাওয়ার পাগলামি লিখে বা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। রাজা ভাতখাওয়া গেট পেরোবার পর জঙ্গলে ঢুকতেই অপার ভালোলাগা। চৈত্রের বন কী অসামান্য! তিপাইকে দেখাচ্ছিলাম – এই বৈপরীত্য এ সময়েই শুধু পাওয়া যায়। ডানদিকে পাতাশূন্য ন্যাড়া গাছ, অসংখ্য আঙুল তুলে কত সংকেত আঁকছে! আর বাঁ দিকে কচি সবুজের সমারোহ। পাকা রাস্তার মাঝখানে হাতিদের টাটকা হাগু!
আমি বললাম – “আমরা দেখতে পাচ্ছি না তাদের, কিন্তু কাছেপিঠে কোনও ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে তেনারা যে আমাদের দেখছেন না তা কিন্তু বলা যাবে না!” ‘ক্ক্যাও ক্ক্যাও’ ময়ূরের ডাক মাঝে মাঝেই বুকে এসে লাগছে।
দোতলার বারান্দায় উঠতেই হাসিমুখে অজয় এসে হাজির। “গতবার দেখা করতে পারিনি। এবার মিস করবই না। তাই আগেভাগে এসে আছি!” তুমুল হাওয়ায় বন্ধুপত্নী রূপা ও ছোট শালীর চুল উড়ছে! চুল সামলে রাখতে পারছে না ওদের মেয়ে তিপাই আর ফুল! অজয় বলছে – “দুদিন আগেই এই রিভারবেডেই হাতির পাল ছিল।”
জঙ্গল আর নদীর হুহু বাতাসকে সঙ্গী করে আমরা দুপুরেই হাঁটতে বের হলাম। দিনদুপুরেও কী শান্ত গ্রাম। মৌ আবাক হয়ে বলল – “এরা এত আস্তে কথা বলে? প্রকৃতিই বোধহয় ওদের এমন শান্ত বানিয়েছে! তাই না?”
পাহাড় থেকে পাথর আর ডলোমাইট বিগত বর্ষায় ভেঙে নেমে এসে বন চিরে একটা মোহময় পথ তৈরি করেছে। গতবার ভোরে হাঁটতে হাঁটতে এই পথে হরিণ দেখেছিলাম। সে গল্প করতে করতে সবাইকে নিয়ে সেদিকেই চলতে লাগলাম। অনেকটা দূর চলেও গিয়েছিলাম। পেছন থেকে অজয়ের চিৎকার শুনে ফিরতে হল – “ওদিকে যাবেন না। হাতি বাঘ যে কোনও সময় বেরোতে পারে। খুব রিস্কি। তাছাড়া বনবিভাগ দেখলে ফাইন করবে!” অগত্যা ফেরা।
অজয়ের হোম-স্টের রাঁধুনি বড্ড ভালো রাঁধে। রীতিমতো কবজি ডুবিয়ে খেলাম আমরা। তারপর বেলা তিনটে থেকে ২৬ মাইল কোর জঙ্গল সাফারি, বক্সা টাইগার রিজার্ভে। বুনোদের তেমন দেখা না মিললেও তাদের আস্তানায় প্রায় দু ঘন্টা মন ভালো করে দিল। চৈত্রবনের যে অসীম সৌন্দর্য তা আমাদের নির্বাক করে রাখল বহুক্ষণ।
রাতটা ছিল অপার্থিব সুন্দর। মৌ ও তিপাই বারান্দায় বসে গান গাইছিল। আমি হোম স্টের সব আলো নিবিয়ে দিলাম। আবছা চাঁদের উপস্থিতি কেমন রহস্যময় করে তুলেছে চারিদিক। কিন্তু হঠাৎই সব অন্ধকার হয়ে এল। খেতে যাওয়ার আগেই তুমুল ঝড়বৃষ্টি। হোম স্টের জমির মালিক বিজয় ছাতা মাথায় কাঠের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বললেন – “ডাইনিংয়ে যেতে পারবেন না। খাবার এখানেই পৌঁছে দিচ্ছি।”
খাবার ওরা দিয়ে গেল প্রায় ভিজতে ভিজতে। আমি বিজয়ের কাছ থেকে সার্চ-লাইটটা চেয়ে নিলাম। সাদা সিলিংয়ে সার্চলাইট-এর আলো ফেলে একটা অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হল। জলকণা মাখা বাতাসের ঝাপটা, টিনের চালে বৃষ্টির লহরা, আমরা খাবার বাড়ছি। তিপাই বলল – “ক্যান্ডেললাইট ডিনার সবাই জানি, জীবনে এই প্রথম সার্চলাইট ডিনার!”
প্রিয় বন্ধুর পাশে শুয়ে নিশ্চুপ বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
গতকাল সাফারির গাড়ি চালিয়েছে প্রিয় কিষাণ। এখানে এলে ওর গাড়িতে চড়তেই ভালোবাসি। আজ ও আসতে পারেনি, পাঠিয়েছে অন্য একজনকে। আমরা চললাম ছোট মহাকাল। জয়ন্তী নদীর বুকটাই রাস্তা! শুকনো নদীতে নিশ্চিন্ত মনে ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাড়ির দিকে খুব একটা ভ্রূক্ষেপ করল না!
মহাকালে পৌঁছতেই আমার এক গুচ্ছ চারপেয়ে বন্ধু যথারীতি জুটে গেল। তেনারাই যেন পথ দেখাতে দেখাতে আমাকে নিয়ে চলল পাহাড়ের ওপরে। কিছু সিঁড়ি উঠবার পরই দেখতে পেলাম আমাদের পায়ের আওয়াজ পেয়ে পুরোহিত মশাই তড়িঘড়ি বাঘছাল আঁকা ফতুয়া পরে নিচ্ছেন। এত সকালে কেউ আসবেন তিনি হয়তো ভাবতে পারেননি। ধূপকাঠি মোমবাতি জ্বালালেন। একটা পবিত্র গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি মন্দির জুড়ে। পুরোহিতের কি হল জানি না, আমাকে তিনি খুব ভক্ত মানুষ ভেবে বসলেন। অনেকদিন বাদে নাকি তিনি এমন নির্ভেজাল ভক্তকে কাছে পেলেন! সবাই ঝর্না দেখতে গেল, আমি তাঁর সামনে বসে শুনতে লাগলাম ধর্মকথা, তাঁর সন্ন্যাসী হবার কথা, সারা ভারত ঘুরে সাধুসঙ্গ করার অভিজ্ঞতার কথা। আমার মাথায় রক্ততিলক এঁকে দিতে দিতে বললেন – জীবনে শুধু তিনটে জিনিস প্রয়োজন – সত্য, সততা আর বিশ্বাস। চমকে তাঁর চোখের দিকে তাকালাম। হাসিটায় অদ্ভুত মায়া। সত্যিই ভক্ত হয়ে পড়লাম!
মহাকাল মন্দির থেকে নেমে গাড়ির দিকে এগিয়ে চললাম। পাশে কুকুরেরাও চলল। গাড়ি ছাড়ার পরও দেখি – কী মায়াময় চোখে একটি কুকুর তাকিয়েই আছে। মনটা কেমন করে উঠল।
তারপর পোখরি হ্রদ। জঙ্গুলে সেই রাস্তাটাও দারুণ। অনেকটা ট্রেকিং করে উঠতে হয়। ১১০০ ফুট উচ্চতায় কীভাবে সারা বছর পুকুরটা জুড়ে জল থাকে কে জানে! নিসর্গই পারে এমন সব বিস্ময়ের মুখোমুখি দাঁড় করাতে। অতিকায় অসংখ্য মাগুর মাছ মুড়ি ছড়াতেই খলবল করে প্রায় ডাঙায় উঠে পড়ছে! গাইড বিজয় জানালেন – এখানে এসব মাছও পূজিত হয়, একটাও ধরা বা মারা হয় না।
হোম স্টে-তে ফিরে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম আমার প্রিয় ছাত্র নুর ইসলাম-এর ডাকে পূর্ব রাজা ভাতখাওয়ার দিকে। এর আগেও লিখেছি ওকে নিয়ে। আমাকে সঙ্গে করে আগের বছর ও গেছিল ভুটানঘাটে। দুপুর থেকে বিকেল নুর আমাদের নিয়ে বনে বনে ঘুরে বেড়াল। সঙ্গে তরুণ বনসহায়ক সঞ্জু কুজুর্, কবিতা লেখে। মেঘলা দুপুরে নজরমিনারের ওপর দাঁড়িয়ে বনরক্ষীদের কষ্ট-সংগ্রাম নিয়ে লেখা কবিতা পড়ে শোনাল সঞ্জু। বুনোপথে আমার পাশে বসে নুর শোনাল বনের অনেক অজানা কথা। অন্যদের একটু মনখারাপ – হাতি বাইসনের দেখা মিলল না।
দমনপুর মোড়ে এসে সবাইকে বিদায় জানালাম। একা একা ফিরছি নিজের ঠিকানায়। পোরোর কাছে হঠাত রাস্তার পাশেই চোখ আটকে গেল। কোনও মতে হাইওয়ের পাশে গাড়ি পার্ক করে ডান দিকের জংলি রাস্তায় নামলাম। ৩৫টি হাতির একটি বিশাল দল। ধুলো ওড়াচ্ছে। ছোট বড় মাঝারি সব রয়েছে।
খুব আপসোস হল তিপাইদের জন্য। এত কাছে হাতি, অথচ ওরা দেখতে পেল না। এমনই হয় বনে।
---------------------------------------------------------------
ভুটিয়াবস্তিতে-তে যেতে হলে যোগাযোগ : অজয় রায় – ৮৮০৩৪৭০৭৩৭
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴