সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
22-September,2023 - Friday ✍️ By- শুক্লা রায় 634

শাস্তি/শুক্লা রায়

শাস্তি
শুক্লা রায়

ছোট্ট বাড়িটা এখন লোকে লোকারণ্য। উপচে পড়া ভিড়ে মাথা গলাবার স্থানটুকুও নেই। কঙ্কালসার বাড়িটার চারদিকে যে সব ছোট ছোট গাছ ছিল সব মাড়িয়ে টাড়িয়ে একাকার করে ভিড় তার জয়যাত্রা ধরে রেখেছে। যারা এসেছে তারা নড়ছে না, আর নতুন নতুন আরো যারা শুনছে ছুটে আসছে ঘটনা কী জানার জন্য। এই এ্যাত্ত ছোট্ট একটা মেয়ের মনে কী এত দুঃখ থাকতে পারে যে সুইসাইড করল? নানা জনে নানা রকম অনুমান করে সেগুলোকেই সত্যি বলে চালানোর চেষ্টা করতে লাগল। আসলে গল্পের গন্ধ একবার নাকে এসে লাগলে কেউ নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। মহিলা-পুরুষ উভয় পক্ষই সমান বলা যায়। মেয়েটা মরেছেও বেশ স্টাইল করে। ভালো জামা পরে সেজেগুজে সুন্দর করে বসে ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কেটেছে। বাবা-মাকে শাস্তি দিয়েছে সে। একজন বয়স্ক লোক বাইরে বেরিয়ে এসে বাইক স্টার্ট দিতে দিতে পরিচিত কাকে যেন বলল, "এসব আসলে অতিরিক্ত সিনেমা দেখার ফল।"
আর একজন সঙ্গে সঙ্গেই সায় দিয়ে বলে, "আদরও একটু বেশিই হয়ে গেছে, সেজন্য গরিব বাপের কষ্ট বুঝল না। যেমন রোজগার তেমনটা যদি মেয়েকে বুঝতে দিত তাহলে আজকে আর এই দিনটা দেখতে হত না।"
লোকে সুযোগ পেলে বলতে ছাড়ে না। সে লোকটা যে অবস্থাতেই থাক। অবশ্য রমেন আর প্রমিলা এখন উঠোনে মেয়ের মৃতদেহের সামনে হাহাকার করছে। মুখে পান চিবোতে চিবোতে আয়েশ করে দাঁড়িয়ে  পেটমোটা স্পনও বলে, "আজকাল বাপ-মাদের ছেলে-মেয়ের প্রতি যে আদিখ্যেতা!"
উপস্থিত সবাই মাথা নাড়লেও জানে স্বপনও এদিকে কিছু কম যায় না। একটামাত্র মেয়ে, মাথায় তুলে নাচে। মুখের কথাটি খসামাত্র জিনিস হাজির। এসব গবেষণা অবশ্য সহজে থামবার নয়, শ্যামল কিছুক্ষণ শুনে ভিড় ঠেলে এগোতে চেষ্টা করল। রমেন আর ওর বৌ প্রমিলাকে দেখার জন্য। বাচ্চার একটা হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে কেমন লাগে সে কেবলমাত্র যার যায় সে-ই বোঝে। একসঙ্গেই কাজ করছিল, রমেন আর প্রমিলা যখন আসছিল তখনও আসলে শ্যামল ভাবেনি এরকমটা হতে পারে। বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে খবর শুনে মাঝপথ থেকেই আবার এখানে এসেছে। ভিড় দেখে ঢোকার চেষ্টা করেনি, চুপ করে একপাশে বসে ছিল এতক্ষণ।  বিষণ্ণ মনে মাথা নাড়ল। তারও বুকটা কেমন করছে। ভেতরে ঢোকার আবারও একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বাইরেই একপাশে চুপচাপ বসে থাকল। কী আর করবে! আবার সব ছেড়ে বাড়ি যেতেও মন চাইছে না।

রমেন বসে বসে তামাক ডলছিল, বাইরে গাছের ছায়ায় পাতা বাঁশের চাংড়াটায়। হাজিরা থেকে এসে এই দুপুরবেলাটা সামান্য সময় বিশ্রাম। তারপরে তিনটা বাজার সাথে সাথেই আবার কাজে 'জয়েন' হতে লাগে। ওর বৌ প্রমিলাও কাজ করে। ওর সঙ্গেই। উপায় নেই। দুটো বাচ্চার টিউশনির টাকা। খাতাপত্র। এটা সেটা খরচ লেগেই আছে। ছেলেটা ছোট। মেয়েটাই বড়। আর আজকালকার বাচ্চার জামাকাপড়ও লাগে দেখনসই। নইলে আবার ওদের 'পেস্টিজ' থাকে না। রমেন ভাবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আগে ওরা স্কুলে যেত একটা হাফ প্যান্ট আর যেন তেন জামা গায়ে। ছেঁড়া হলেও কুছ পরোয়া নেহী। একদিকে প্যান্টের পকেট ছেঁড়া তো অন্যদিকে জামার বগলফাটা। প্লাস্টিক পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ফুটবল বানিয়েই কী খেলা! আর এখন! এখনকার ছেলে-মেয়েরা ছেঁড়া তো দূরের কথা একটু রঙ ঊঠলেও সে জামা গায়ে দেবে না। সে বাপের টাকা-পয়সা থাকুক আর না থাকুক। রমেন বলে 'নাই পয়সার ফুটানি'। তা কি আর করা। দিতে হয়। যুগের হাওয়া! না দিলেই বিপদ! বাতাসে একটা হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে গুনগুন করে গান ধরল রমেন। তারপর খৈনিটা মুখে দিয়েই উঠে দাঁড়াল। থুথু ফেলল দূরে।  প্রমিলা আসুক। একসঙ্গেই পা বাড়াবে কাজের জায়গায়। রমেনের আলসেমিকে ছিন্নভিন্ন করে তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল বাড়ি থেকে। কী আবার হল! মা-মেয়ের চিরাচরিত ঝগড়া। এবারের ঘটনা হল মোবাইল চাই। কদিন থেকেই মোবাইল কেনার কথাটা শুনতে পাচ্ছে রমেনও। মায়ের কাছে তো ঘ্যান ঘ্যান করছেই, রমেনকেও ধরেছে মেয়ে। রমেন সটান না করে দিয়েছে। সাইকেল সাইকেল করে কিছুদিন আগে বাড়িটা মাথায় তুলেছিল। স্কুলে না এখন সাইকেল পায়ই সবাই। তা না, সুন্দর সাইকেল লাগে, দামী। হাজিরার টাকায় কী আর এতকিছু হয়! ওর মা ছাগল পুষেছিল। খাসি একটা বড় করেছে কষ্ট করে। কত যত্ন! কত নজরদারি ! শুনসান দুপুরে কুকুরে মেরে খেয়ে ফেলার ভয়, নয়ত চুরি হওয়ার ভয়। এখন আবার চুরির নতুন নতুন কায়দা। দুপুরবেলা সবাই কাজে ব্যস্ত অথবা ভাতঘুমে বাঙালি! এদিকে মারুতি গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে চটপট মাঠ থেকেই কয়েকটা ছাগল উঠিয়ে নিয়ে চোরের দল হাওয়া! রাস্তাঘাট ভালো হওয়ার কী উপকার! সত্যি। আজকালকার মানুষ পারেও।  গরীব দুঃখী মানুষ তো ছাগলটা মুরগীটা বেচেই সখের জিনিস কেনে। প্রমিলার যেমন ইচ্ছা ছিল এক জোড়া কানের দুল বানানোর। এখন ও পরত, পরে বিয়েতে মেয়েকে ওটাই ভাঙিয়ে গড়িয়ে দিত। তা আর হল কোথায়! ছাগল বেচে সাইকেল হল। ঝকঝকে। গোলাপী রঙের। তবে ভালোই লাগে দেখতে। মেয়েটা যখন সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়, দেখে মনে হয় বড় ঘরের মেয়ে। তখন আর দুলের জন্য মনখারাপ থাকে না। গর্বে বুকটা ভরে ওঠে প্রমিলার, রমেনেরও। প্রমিলার নাইটির রঙ উঠে যায়, এখানে সেখানে ছেঁড়া ফাটা উঁকি দেয়। রমেনের গেঞ্জির গোল ফুটো গুলো বড় হতে থাকে, তার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে অবশ্য বড় হতে থাকে মেয়েকে ঘিরে বড় বড় সব স্বপ্ন।

মেয়ের কান্না মিশ্রিত চিৎকার শুনে রমেন আর থাকতে পারল না। উঠোনে পা দিয়েই শোনে মেয়ে মরার হুমকি দিচ্ছে। ফোন না দিলেই বিষ খাবে, ফাঁসি দেবে। রমেন কেমন অসহায় হয়ে পড়ল। কোনওরকমে মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এখনি চাই তো আজকেই চাই। ওর বন্ধুরা সবাই কিনেছে। এবার প্রমিলাও চিৎকার করে। তুই বুঝিস না কিছু? আমরা দিন এনে দিন খাই। একদিন হাজিরা না করলে আমাদের পেটে ভাত নাই।  এত টাকা কোথায় পাই। টুয়েলভে উঠলেই না একটা ফোন পাবিই স্কুল থেকে। আরো দুই বছর! না। আজকেই চাই। না হলে আমি মরব! মরবই। প্রমিলাও রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে দেয়, "বাপ মা-র দুঃখ কষ্ট কিছুই না বুঝলে তুই মর।"

কাজে এসে রমেন প্রমিলা কারোরই মনটা ভালো লাগছে না। কেমন যেন থেকে থেকে অস্থির লাগছে। তবু ওভাবেই পাঁচটা পযর্ন্ত কাজ শেষ করে ক্লান্ত শরীরে যখন বাড়ি ফিরছে পাশের বাড়ির স্বপনের ছেলেকে সাইকেল নিয়ে আসতে দেখে দুজনেই একটু জোরে পা চালায়। মনটা কেন যেন কু ডাকে। কাছাকাছি আসতেই সনাতন বলে কাকা, তাড়াতাড়ি চল। কিছুটা ভয়, কিছুটা টেনশন মিশিয়ে প্রমিলা অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে, কেন? কী হয়েছে? সনাতন প্রথমে কিছু বলে না। তারপর দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলে, এমনি কিছু হয়নি। তোমরা আসো। বাড়িতে লোক এসেছে। কথাটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য না হলেও রমেন প্রমিলা দুজনেই নিজের মনের সাথে কিছুটা লুকোচুরি খেলে। নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা করে। এটা ক্ষণিকের জন্য। দূর থেকেই দেখতে পায় বাড়ি লোকে লোকারণ্য। রমেন কিছু বোঝার আগেই প্রমিলা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। রমেনও দ্রুত অনুসরণ করে। বাড়ি ঢুকেই এক বুকফাটা বিলাপ করে প্রমিলা মেয়ের মৃতদেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। 
রমেন যেন কাঁদার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছে। হুমকিটা যে সত্যি  হবে এটা যেন এখনও বুঝতে পারছে না সে। কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে নির্বাক বসে থাকে।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri