ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-১৫/মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১৫)
মৈনাক ভট্টাচার্য
---------------------------------------
বলবীর সিং কটের পোর্টরেট ভাস্কর্য : রামকিঙ্কর
রাশিয়ান চিত্রশিল্পী কান্ডিন্সস্কি ওয়াসীলি বলতেন- “রঙ হচ্ছে ছবির প্রাণ, তার বড় কারণ রঙ সরাসরি আত্মাকে প্রভাবিত করতে পারে। আত্মা যদি পিয়ানো হয় রঙ তবে কী বোর্ড”। কান্ডিন্সস্কির কথার সুত্র ধরেই ইমপ্রেসনিস্ট রেনোয়ার বলতেন –“আমার ছবির প্রথম এবং প্রধান বিষয় হচ্ছে আলো। আমি মনে করি আলো রঙেরই আর এক নাম”।
একটা জিনিষ একটু লক্ষ করলে বোঝা যায়-ভাস্কর্য রঙ নিয়ে খেলে বটে কিন্তু সেটা কখনই মুখ্য হয়ে ওঠেনা। ভাস্কর্যের ভেতর একটা চোরাগোপ্তা রঙের যাদু অবশ্যই থাকতে হয় নয়ত সেটা যান্ত্রিক হয়ে যায়, যা কিনা পুতুলের সমতূল্য। চিত্রশিল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠায় রঙের যে ভূমিকা সেই ভূমিকা ভাস্কর্যে হয়ে দাঁড়ায় আলোছায়ার খেলায়। একজন ভাস্করকে তাই খেলতে হয় আলো নিয়ে। আলোছায়ার এই আবেশ একটা ভাস্কর্যকে পৌঁছে দেয় আলাদা এক মাত্রায়। সেই ভাবনা থেকেই রামকিঙ্কর স্ট্রিট লাইটের আলোয় হামাগুড়ি দিয়ে আলোছায়ার প্রভাব অনুভব করতে গিয়ে প্রতিবেশীর হাতে ধরা পড়ে খুব লজ্জিত হয়েছিলেন একবার। সেই গল্প আগে বলেছি।
পোর্টেরট তৈরি এক বিশেষ ধরনের শিল্পকলা। সে ভাস্কর্যতেই হোক আর চিত্রশিল্পেই হোক। শরীরের অ্যানাটমি বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা না থাকলে এই কাজ অনেক কঠিন হয়ে ওঠে। আবার তেমনই ফেস স্টাডি একটা বড় বিষয়। শুধু মুখের বিশেষ আদল খুঁজে নিলেই হবেনা, খুঁজতে হবে সেই জায়গা যেখান থেকে ফুটে উঠবে বৈশিষ্ট্যও। যত দ্রুত এবং যত নিঁখুত ভাবে কোন শিল্পী খুঁজে নিতে পারেন তত সহজ হয়ে যায় সেই কাজ। জেকব এপস্টাইনের প্রসঙ্গে রামকিঙ্কর বলেছিলন-“এত জোরালো পোট্রেট তাঁর অথচ সমালোচকরা কি না বলেছেন তাঁকে নিয়ে। আর্টিস্টের একটা অ্যাঙ্গেল থাকে তা নাই দেখো জোরালো কাজটা একটু মন দিয়ে দেখবে না? কত নিন্দে বান্দা তবু কেমন মনের জোরে কাজ করে গেছেন এপস্টাইন। সব জোরালো কাজ। তাঁর বারনার্ড-শ্ খুব ভালো। সেলফ পোট্রেটও ভালো । ব্রোঞ্জে রবীন্দ্রনাথও অসামান্য। সে তো রবীন্দ্রভবনেই আছে। মজার কথা ইংল্যান্ডের সমালোচকেরা বলেন ওর ব্রোঞ্জের কাজ নাকি মন্দ নয়। আবার পাথর খোদাইতে যেই হাত দেন অমনি সব বিদঘুটে কাজ বেরতে থাকে। মাতব্বরি দেখেছো, দিগ্গজ সব। যে কিছুই বোঝেনা সেও বিনা মূলধনে কেমন বিচারক বনে যায় আর হতভাগা আর্টিস্ট পড়ে পড়ে মার খায়”।
একটা কাজ করতে কত সময় লাগতে পারে এই ব্যাপারেও সাধারণ মানুষের ভেতর একটা জানার আগ্রহ থেকে যায়। রামকিঙ্করের ভাষায়-“অল্প সময়ে কাজ করলেই যে কাজ খারাপ হবে আর বেশি সময় নিলে ভালো হবে তার কোন মানে নেই। পনের মিনিটে যদি আসল জিনিসটা ধরা পড়ল তবে হয়ে গেল। পরে একটু একটু বাড়তি কাজ ফিনিশের কাজ তো কিছু নয়। সে তো থাকেই। অবশ্য এমন কাজ আছে যা হবার সময় চায় শ্রম সময় নিয়ে। আসলে সময় নিয়ে জোর করে কিছু বলা খুব মুশকিল। যখন যেমন। এই ছেদ আর প্রতীক্ষাও কিন্তু মূল্যবান।
জেকব এপস্টাইন বিশ্বাস করতেন-“ যে কাজ ধাক্কা সয়না তা নষ্ট করে ফেলাই উচিত। কোন কাজ যা মুড নির্ভর তর সইতে চায় না, আদৌ কালক্ষেপ মাত্র না করে দ্রুত শেষ করে ফেলা অতি জরুরী”।
এই ভাবনা গুলো পোর্টেরট শিল্পের আলোচনায় এসেই যায়। যে শিল্পী যত দ্রুত চরিত্রটা ধরতে পারেন কাজটা তত দ্রুত পরিণত হয়ে আসে। রামকিঙ্কর বেশ কিছু মূল্যবান বিশ্লেষণ করে গেছেন পোর্টেরট নিয়ে নানা টুকরো আলোচনায়। তিনি মানতেন পোর্টেরট হাত খুলে কেরামতি দেখানোর সুযোগ সব চেয়ে বেশি থাকে। কেননা পোর্টেরট মানেই তো মুখের অ্যানাটমির হুবহ নকল নয়, মানুষের চরিত্রটা ফুটিয়ে তোলা। সেই জন্যই আজও ইতিহাস হয়ে আছে। রোদ্যাঁর বালজাক, জেকব এপস্টাইনের বানার্ড শ্, রেম্ব্রান্টের পিকাসো। এর বাইরেও কিন্তু আছে।
রামকিঙ্কর নিজে পোট্রেট করতে পছন্দ করতেন। শান্তিনিকেতনে কোন শিল্পী এলে রবীন্দ্রনাথের নিজের থেকে নন্দলাল বসুর কাছে হুকুমজারী হয়ে যেত- আ্লাউদ্দীন খাঁ সাহেবের মাথাটা নিয়ে রেখো- ইত্যাদি-। ডাক পড়ত রামকিঙ্করের। কখনও বা অন্য কারও। আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের পোর্টেরট করতে বড় জোর আধা ঘন্টা সময় নিয়েছিলেন। উপায়ও ছিলনা। খাঁ সাহেব সেই দিনই চলে যাবেন, আবার হুকুমটাও এসেছে খোদ গুরুদেবের কাছ থেকেই। হয়ে যায় কখনও কখনও। রামকিঙ্করের পোট্রেট বানানো নিয়ে গল্প হয়ে আছে তাঁর এক প্রিয় ছাত্র বলবীর সিং কট। বলবীরের খুব ইচ্ছে তাঁর মাস্টারমশাই রামকিঙ্করের একটা পোট্রেট স্টাডি করবেন। বলবীররের কাজের প্রতি রামকিঙ্করেরও দুর্বলতা ছিল। তাই রাজি হয়ে গেলেন। অনেক করেও বলবীর কিছুতেই চরিত্রের সবটা আনতে পারছেন না। অথচ নাক, চোখ, কপাল কোথাও ভুল নেই। বলবীর ঘেমে নেয়ে একেবারে একাকার। মাস্টারমশাই তো দেখছেন শুরু থেকেই। জহুরীর চোখ। বোধহয় মজাই নিচ্ছেন কিংবা হয়ত বা ছাত্রকে ঠেকে শিখতে হবে তাই একদম চুপ চাপ। বলবীরের যখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। রক্ষাকর্তা হয়ে এগিয়ে এলেন খোদ মাস্টারমশাই রামকিঙ্কর। হেসে ফেললেন-“ওরে আমার মুখের গঠনটা ভাল করে খেয়াল কর। আমার মুখটা যে একেবারে কুকুরের মত। ঠোঁটের দিকটা সামনে এগিয়ে। একান্ত সাক্ষাৎকারে সোমেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে হাসতে হাসতে নিজে গল্প করেছিলেন রামকিঙ্কর। তাঁর এই মন্তব্যে না কোন হতাশা না কোন অভিযোগ। রামকিঙ্কর মানুষটাই যে এমন ছিলেন। নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন এই সব ছাত্রদের। পরবর্তীতে বলবীর সিং কট ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত স্টোন কার্ভার হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে মার্বেল এবং কাঠের মিশ্র সমন্বয়ের কাজ গুলি। কট কানাডার এডমন্টন কমনওয়েলথ ভাস্কর্যের পৃথিবীর দশজন ভাস্করের মধ্যে একজন হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে ভারতকে সম্মানিত করেছেন উনিশও আটাত্তর কমনওয়েলথ গেম সংগঠনের সময়। দুইহাজার সালে, যখন তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ভাস্কর্য বিভাগের ডীন, প্রাতঃ ভ্রমনে বেরিয়ে আর ফিরলেন না। রহস্য রয়ে গেল তাঁর সৃষ্টির মতই তাঁর এই বিমূর্ত পরিণতি নিয়ে। এর একটাই সম্ভবনা, বিতর্কিত কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন সেই সময় বলবীর অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান দুর্নীতি নিয়ে। প্রশাসন কখনও কখনও শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে মানুষ পাষাণ থেকে প্রাণ নিংড়ে আনার জন্য বিশ্বের দরবারে নিজেকে এক বিখ্যাত পাথর খোদাইকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই তিনিই হেরে গেলেন পাষাণ প্রাণের কিছু মানুষের কাছে। এই খানেই বোধ হয় বলবীর সিং কট মনে করিয়ে দেন বিশ্ব সাহিত্যের অমর এক কবি নাট্যকারকে- যার নাম ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। বলবীরও কি আঁচ করতে পারেনি লোরকার মতই তার পারিপার্শিক জনদের বিদ্রোহের অবস্থান। লোরকার মতই তাঁর মৃতদেহ আজও খুজে পাওয়া যায়নি। লোরকা হোক আর বলবীর কোন কোন শিল্পী আক্ষরিক অর্থেই কোন মৃত্যুদিন থাকেনা। লোরকার যেমন একশ পঁচিশে বলবীর সিং কটের চুরাশী বছর পার করেও, হয়ত এভাবেই কেটে যাবে লোরকার মতোই একশ-একশ পঁচিশ.........।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴