বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।। পনের।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^
প্রতিবছর শীতকালে আমরা দেখি যে বাগানে বাগানে চায়ের ডাল ছেঁটে ফ্যালা হচ্ছে। বাগানিয়া ভাষায় একে বলে প্রুনিং (Pruning)।
প্রুনিং
করার মূল কারণ গাছের উচ্চতা এমন একটা মাপে বেঁধে রাখা, যাতে হাত দিয়ে
সহজেই চা-পাতা তোলা যায়। এই উচ্চতাকে বলে ‘প্লাকিং হাইট’ এবং এই উচ্চতায়
চায়ের ছড়ানো ডালগুলো একসঙ্গে মিলে (ক্যানোপি) তৈরি করে ‘প্লাকিং
টেবিল’।ডালপালা যদি প্লাকিং টেবিলের থেকে খুব বেশী ওপরে বেড়ে যায় তাহলে
পাতা তুলতে অসুবিধা হয়। তাই তাকে ছেঁটে আবার নামিয়ে আনা হয়।
এছাড়া এই ছাঁটার সময় খারাপ, মরা ডালপালাও কেটে ফেলা হয়। তাতে গাছ নতুন প্রাণশক্তি পায়। পাতা বেশী দেয়।
চা
গাছ সারা বছর একই পরিমানে পাতা দেয় না। বর্ষাকালে সব চেয়ে বেশী পাতা। যত
শীত পড়তে থাকে পাতা তত কমতে কমতে একেবারে শীতঘুমে (বাঁঞ্জি) চলে যায়। তাই
প্রতিবছর শীতের সময় এই প্রুনিং-এর কাজটা করা হয়। সাধারণত মাঝ নভেম্বর থেকে
জানুয়ারীর মধ্যে প্রুনিং-এর কাজ শেষ করে ফ্যালা হয়।
ছাঁটারও
নানা ভঙ্গি আছে।কখনও শুধুমাত্র মাথার সরু নরম,সবুজ ডালগুলো আলতো করে ছেঁটে
প্লাকিং টেবিলকে সমান (level)করে দেওয়া হয়। একে বলে ‘Level of Skiff-LOS’;
কখনো ওপরের সবকটা সরু নরম,বাদামী ডালকেও ছেঁটে ফেলা হয় (Light Skiff-LS),
কখনো আরও একটু নীচে নেমে (Medium Skiff-MS)বা আরও বেশী নীচে নেমে (Deep
Skiff-DS)। কখনো কখনো প্লাকিং টেবিলের থেকে অনেকটা নীচে নেমে একটু কাষ্ঠল
(wooded) ডালগুলোকেও হালকা করে (Light Pruning-LS) বা আরও একটু গভীর নেমে
মোটা ডালগুলো কেটে ফেলা হয় (Medium Pruning - MP)। মাঝে মাঝে একটু বেশী
এবড়ো খেবড়ো গাছগুলোকে অনেকটা নীচে থেকে কেটে তাদের উচ্চতা কমিয়ে দেওয়া হয়
(Hight Reduction Pruning- HRP)।আবার বেশী বয়সের গাছকে নতুন করে জীবন শুরু
করিয়ে দেবার জন্য মূল কান্ডটাকেই প্রায় গোড়া থেকে কেটে ফ্যালা হয় (Collar
Pruning /Rejuvenating Pruning)
তবে
বাগানের সব গাছকে প্রতিবছর ছাঁটা হয় না। সাধারণত ২৫% থেক ৩৩% গাছকে ঘুরিয়ে
ঘুরিয়ে ছাঁটা হয়।(এখন অবশ্য কোন কোন বাগানে প্রায় ৫০% গাছও ছেঁটে ফ্যালা
হচ্ছে।)
এই ছাঁটাই-এরও একটা ‘চক্র’ আছে যাকে বলে
Pruning Cycle। এবছর যদি কোন গাছকে LP/MP/HRP ইত্যাদি করা হয় তবে পরের বছর
তাকে ছাঁটা হয় না; সে থাকে আনপ্রুনড (UP) বা আনটাচড্ (UT)।তৃতীয় বছর তাকে
LS বা MS বা DS করা হয় এবং চতুর্থ বছরে আবার আনপ্রুনড্। অর্থাৎ চার বছরের
একটা চক্র: (LP/MP/HRP)-(UP)-(LS/MS/DS)-(UP)। আগে তিন বছর, পাঁচ বছর
বা ছয় বছরের চক্রও ছিল। এখন সব বাগান মোটামুটি চার বছরের চক্রই মেনে চলে।
তবে ইদানীং কোন কোন বাগান আবার তিন বছরের চক্র শুরু করেছে।
লাইট
প্রুনিং করলে ৩০-৩৫% এবং মিডিয়াম প্রুনিং করলে ৬০-৭০% পাতা সেবছর কম হয়
(Crop Loss) – তবে প্রাণশক্তি (vigor) বেড়ে যাওয়ায় পরবর্তী বছরগুলোতে গাছ
ভাল এবং বেশী পাতা দেয়।
প্রথাগত
ভাবে মাথার দিকটা বাঘ-নখের মতো বাঁকানো বিশেষ একধরনের ছুরি - ‘কলম
ছুরি’(যার ওজন ৪৫০ গ্রাম ও ফলার দৈর্ঘ্য ১৫ সেমি) দিয়ে প্রুনিং করা হয়।
প্রুনিং করতে হয় পরিষ্কার, তীক্ষ্ণ ও ত্যারছা (slant) ভাবে।গাছের কেন্দ্র
থেকে শুরু করে বাইরে দিকে গোল করে ঘুরে ঘুরে সব ডাল ত্যারছা করে ছাঁটা হয়।
প্রুনিং
করার পর প্রুনিং-এর নীচের অংশে যদি মরা, পোকায় খাওয়া, রুগ্ন এবং আড়াআড়ি
বেড়ে ওঠা ডাল এবং বাঁঞ্জি মুকুল থেকে থাকে – তবে সেসবও কেটে ফেলে দিতে হয়।
একে বলে Knife Cleaning Out (KCO)।
ইদানীং
দেখা যায় যেসব গাছকে মিডিয়াম প্রুন (MP) করা হয়েছে তাদের দুটো লম্বা ডাল
না-কেটে ছেড়ে রাখা হয়েছে। একে ‘ব্রিদার’ (Breather/Lung Shoots)বলে। এরা
গাছকে নানা সুবিধা দেয় এবং কমজোরি গাছগুলোকে মরে যাবার হাত থেকে বাঁচাবার
চেষ্টা করে। যখন অন্য ছাঁটা ডাল থেকে নতুন ডাল-পাতা গজিয়ে ওঠে তখন এগুলোকেও
কেটে ফেলা হয়।
প্রুনিং-এ
মোটা ডাল কাটলে তার মাথায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব (২৪ ঘন্টার মধ্যে) আলকাতরার
প্রলেপ দিয়ে দেওয়া হয়। ডালগুলোকে ‘কস্টিক ওয়াশ’ করা হয় এবং ছেঁটে ফ্যালা
ডালপালা তাদের মাথায় চাপিয়ে (mulching) ছায়া দেবার ব্যবস্থা করা হয়।
প্রুনিং-এর
কাজের জন্য বিশেষ ভাবে দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন।শুরু থেকে পুরুষ শ্রমিকরাই করত
সে কাজ। এখন মহিলা-শ্রমিকরাও যথেষ্ট দক্ষ হয়ে উঠেছে এ ব্যাপারে।
ইদানীং
প্রুনিং-মেশিন এসে গ্যাছে। কলম ছুরি দিয়ে চায়ের ডাল একটু ত্যারছা (slant)
করে কাটা হয়; কিন্তু প্রুনিং মেশিনে তা করা যায় না।তাই প্রথমে ধারনা ছিল
মেশিন প্রুনিং-এর ভাল ফল হবে না। কিন্তু সে ধারনা ক্রমশ পালটে যাচ্ছে।
প্রুন করা ডাল থেকে যে নতুন ডাল বার হয় তারা আবার সেই প্লাকিং টেবিলের উচ্চতা পর্যন্ত বড় হবার পর আবার সেখান থেকে পাতা তোলা শুরু হয়।
প্রুনিং
করা হয় সবসময় মাটি থেকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা বজায় রেখে।তারজন্য বিশেষ
মাপ-লাঠি থাকে।সেই উচ্চতা ধরেই সেকশানের সব গাছ কাটা হয়।বৃটিশ আমলে মাপটা
‘ফুট’ হিসাবে করা হত। তাই এই ছাঁটা গাছ থেকে পরে যে পাতা তোলা হয় তাকে
বাগানিয়া ভাষায় বলে ‘ফুট পাতি’।আর আ-ছাঁটা গাছের পাতাকে বলে ‘জংলী পাতি’।
সংযোজনঃ
পর্ব তেরোতে বলা হয়েছে যে চা-চারা মাটিতে লাগানোর আগে মাটি তৈরি করে নেওয়া
হয়। রি-প্ল্যান্টিং অর্থাৎ আগের পুরনো বয়স্ক গাছ তুলে সেখানে আবার নতুন
করে গাছ বসানোর আগে আঠারো মাস ধরে মাটিকে তৈরি করা হয়। সেজন্য মাটি চাষ করে
গোবর ও রাসায়নিক সার দেওয়া হয়।মাটির প্রাকৃতিজ কার্বন ও নাইট্রোজেন
বাড়ানোর জন্য লজ্জাবতী জাতীয় গাছ (Mimosa invisa), সিট্রোনেলা (Citronella)
ঘাস, আখ গাছের মত দেখতে লম্বা লম্বা গুয়াতেমালা (Guatemala) ঘাস ইত্যাদি
লাগানো হয়।
-------------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া...