পইলা সাঞ্ঝির কথা/১৫
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব : ১৫
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
মামির হাতে ভাত
কাটো কোলার পাত
কান্তেশ্বরকে বাজারের একটা বিরাট ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে বসমতী নিমন্ত্রণ করতে বের হল। এ বেলাটা ভুন্দি মানে ওর ননদ শিবানী রান্না করবে। গতকাল তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে শিবানী আর ওর বর মন্তেশ্বর এসেছে প্রায় সন্ধ্যা। গাড়িয়াল ছেলেটা ভাত খেয়ে অনেক রাতেই ফিরে গেছে। নিতে আসবে আবার সপ্তাহখানেক পর। আজকে রবিবার পড়াতে বসমতী চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে আজকেই খাওয়ানোর ঝামেলাটা শেষ করে দিতে চাইছে। এই দিনটায় ওরা পাড়াতুতো ভাগ্না-ভাগ্নীদেরও খাওয়ায়। তাছাড়া খুব বয়স্ক মানুষ যারা আছেন সবাইকেই খেতে ডাকে। উঠোনেই কলার পাতায় ভাত বেড়ে দেয়। লন্ঠন আর কূপীর আলোয় এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। কান্তেশ্বরের একটু হুঁকো টানার অভ্যাস আছে। কান্তেশ্বর এদিন সকালেই হুঁকোর জল পাল্টে পরিস্কার করে রাখে। গুনগুন করতে করতে বসমতীকে ডাকে -
"হাকোইগিলা কোটে থুসেন? বুড়া মানসিলা আসিবে, হাকোই চান্দাবে এলায়।"
বলতে বলতে সন্ধ্যাবেলার জন্য পাতলা গুড় মাখানো সুগন্ধী নতুন তামাক পুরে হুঁকোটা রেডি করে ফেলে। বসমতীরও মনে পড়ে। এই গরমে হাতপাখা ছাড়া কষ্ট হবে খুব। হুঁকোর গুড়ুক গুড়ুক শব্দের সঙ্গে তামাকের গন্ধ মিলেমিশে একাকার। আর বাচ্চাদের মাঝে মাঝে ধমকে থামিয়ে বুড়োরাই গল্পে গল্পে কখন বাচ্চা হয়ে যায়! ভাবলেই মনটা ভালো হয়ে যায় বসমতীর।
প্রথমেই রসবালার কাছে গেল। ওর ছোটো ছেলেটাকে বলে এল কলার পাতা কেটে রাখতে। কাজ কী কম! রসবালাকে বলল বিকালেই কুয়ো থেকে রান্নার জল তুলে রাখতে। সবাই হাতে হাতে করবে যদিও, তবু একটু বলে রাখা আর কি। মেয়েরা এলে কেউ বসে থাকে না, কুটনো কোটা, বাটা-বাটি, ধোয়া-পোঁছা সবেতেই হাত লাগায়। নইলে বসমতী একা পারে নাকি! ওর শাশুড়ি বেঁচে থাকতে জামাইকে একদিন রেঁধে খাওয়াতেন। জামাইকে শাশুড়ির রেঁধে খাওয়ানোটাও প্রথা এই মাসে।
কলেশ্বর কাকার বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই দেখে এক কোণে পিঁড়ি পেতে কাকা খেতে বসেছে। ওকে দেখেই হাসিমুখে জানতে চাইল,
"কি বারে শাশুড়ি মাও। তোমার ভাগিনি বোলে আইচ্চে? তে এদি একেরে হাতোত তুলি দিবেন নাকি?"
বসমতী হেসে ফেলল। ভাগ্নী শুনলে বুড়োর উপর ক্ষেপে আগুন হয়ে যেত। বসমতী জানতে চাইল
"কি খাচেন বাবা?"
"এঃ, হামার এইলা খাবার! পয়রার গুন্ডা খাং বারে, নাল চা দিয়া।"
"পয়রা কোটে পালেন?"
"ছিল চাইট্টা। তোমার মাও কোটে বা কোটোরাত ডুবি থুসে, খাবারে নাই আজি আরো হামার, তে বারকে দিলেক। ওইলায় বৌ হামার ভাজিয়া গুন্ডা করি নুন চা দিয়া দিলেক।"
বড় একটা গোল পেতলের চামচে করে একটু একটু করে খাচ্ছিল কলেশ্বর। পাশে কাঁসার ঘটিতে জল। ওই একটাই বাপ কালিয়া মানে বাপের আমলের সম্পত্তি। ওই ঘটিতে কলেশ্বরই জল খায় শুধু। অন্যরা দস্তার বড় বড় গ্লাসে করে জল খায়। কলেশ্বরের বৌমা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। বসমতীকে একটা পিঁড়ি ফেলে দিয়ে বসতে দিয়ে সলজ্জ হেসে জানতে চাইল,
"মিটাইর চা খাবু দিদি?"
এই অভাবী পরিবারগুলো চিনি খুব কম কেনে। শুধুমাত্র আত্মীয়-স্বজন এলেই একটু চিনি কিনে এনে চা করে। নিজেদের জন্য গুড় নয়ত নুন-চা। সেজন্য ওর সংকোচকে পাত্তা না দিয়ে বসমতী খোলা গলায় আব্দার করল,
"জ্বালা তো কোনেক। খাং।"
তারপর কলেশ্বরের দিকে ফিরে বলল,
"আইতোত কোনেক যান বা। তোমার শাশুড়ির হাতোত ভাত খায়া আইসেন।"
রাতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়ে স্পষ্টতই বুড়ো মানুষটা খুশি হয়ে উঠল।
নিমন্ত্রণ শেষ করে ফিরতেই বেলা দুপুর। এসেই মেয়েকে ডাকে একটু জল খাবে। কূয়ো থেকে ঠান্ডা জল গ্লাসে ভরে এনে ভুন্দিই এগিয়ে দেয়। হাসতে হাসতে বলে,
"মাই এলা চুপ করি নয়? দ্যাখেক কোটে আসাঙের মাতাত চড়ি আছে।"
ভুন্দির চোখ অনুসরণ করে বসমতী তাকিয়ে দেখে পেয়ারা গাছটার মগডালে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মেয়ে। দেখে হাড়-পিত্তি জ্বলে গেল।
"কেমন ছাওয়া তুই মাই? দুপুর নাই তাপর নাই গছৎ চড়ি আছিস? নাম কসং এলায়? নাহলে নাটিখান দেইখসিস?"
মেয়ে ভয় পেয়ে সরসর করে নেমে এল। নেমেই ছুট বাইরের দিকে। জল খেয়ে গ্লাসটা হাতে নিয়ে নিজেই মাজতে মাজতে জিজ্ঞেস করে,
"মন্তেশ্বর কোটে? উয়ার দাদার সতে গেইসে?"
ভুন্দি "হ্যাঁ" বলেই তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ছুটল তরকারি দেখতে, কেমন যেন তলায় লেগে যাওয়ার মতো গন্ধ লাগছিল নাকে। একটু পরেই খুন্তি কড়াইয়ের সাথে ওর যুদ্ধের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। বসমতী হাসতে হাসতে বলে,
"আকা থাকি নিচোত নামা কান্তাইটা। জল দিন না, কোনেক কাঁচা ত্যাল দিয়া ঘাটেক মাই।"
তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বসমতী কাজে লেগে পড়ে। দুপুরের তাতে এমনিই ক্লান্ত লাগে। বিকেল হতেই মাটি থেকে যেন ভাপ উঠছে। এত লোকজন। বাইরের ডারিয়া ঘরে হাতপাখা বা হাকোইগুলো সাজিয়ে রাখে। এরমধ্যে মাছ মাংস ধুয়ে লবন হলুদ মশলা মাখিয়ে রেখে দিয়েছে। বেলা-বেলি রান্না চড়াবে। বেশি রাত করা যাবে না। সবার প্রায় সন্ধেতেই খেয়ে ঘুমোনো অভ্যেস। বয়স্করা তো তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ে। ঘুম না পেলেও। সেজন্য আজকে একটু আগেই সন্ধ্যা-বাতি দিয়ে দেয়।
............................................................
হাকোই - হাতপাখা
পয়রার গুন্ডা - পয়রা গমের মতো দেখতে, ছোট দানা। যব। সেই যবের ছাতু।
কোটোরা - লাউয়ের বস বা ঘুপচি কোনো জায়গা
আসাঙের মাতাত - বিদ্রুপ অর্থে উঁচু জায়গা বোঝায়
............................................................
ছবি : ময়ূখ রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴