দাঁড়াবার জায়গা/পনেরো
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
তখন
ক্লাস সিক্সে পড়ি। পরীক্ষা হয়ে গেছে, রেজাল্ট তখনও বেরোয়নি। স্কুলে যাবার
ব্যাপার নেই, রোজ ঘরেই থাকি। হাতে অনেক সময়। ছুটির মেজাজ। কখনও ছবি আঁকি,
কখনও গল্পের বই পড়ি, কখনও পদ্য লিখি, কখনও মাটি দিয়ে এটা সেটা বানাই।
একদিন সকালের দিকে আমাদের বাড়িতে এলেন পাড়ারই একজন। আমাদের কাছে তিনি
সন্তোষদা। তাঁকে আমার দাদা বলে সম্বোধন অত্যন্ত বেমানান ছিল। তবু, আমাদের
সবচেয়ে বড় দাদা আমার চেয়ে বছর চব্বিশের বড়। তাঁর সম্বোধন অনুযায়ী আমরাও
একই সম্বোধন করতাম। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। সেদিন তিনি বাবার
সঙ্গে গল্পে মজে আছেন। কোনওভাবে আমার প্রসঙ্গও উঠে এসেছিল। বাবা বলেছিলেন,
‘সারাদিনই তো ছবি আঁকে, নয়তো মাটি দিয়ে কিছু না কিছু বানায়’। একথা শুনে
সন্তোষদা আমাকে বললেন, ‘মাটি দিয়ে কী বানিয়েছিস, আমাকে দেখা’। আমি প্রবল
উৎসাহে ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস দেখালাম। তিনি বললেন, ‘সামনেই তো সরস্বতী
পূজা। পারবি সরস্বতী মূর্তি বানাতে?’ আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘পারব’। তিনি
বললেন, ‘তাহলে বানিয়ে দেখা দেখি’। আমি বললাম, ‘অনেক কিছু লাগবে তো’। তিনি
বললেন, ‘কী লাগবে’? আমি বললাম, ‘কাঠামো লাগবে, খড় লাগবে, ভালো মাটি লাগবে,
পরে রং লাগবে’। লম্বা ফিরিস্তি দিলাম। তিনি বললেন, ‘সেসব হবে। আমাদের
পুকুরে অনেক কাঠামো পড়ে আছে, তোর যেটা পছন্দ নিয়ে নিবি। ভালো মাটিও পাবি
পুকুরে। আগে শুরু কর, তারপর যা যা লাগবে আমি ব্যবস্থা করব’।
আমরা
কয়েকজন হইহই করে ছুটলাম। শীতকাল, পুকুর তখন প্রায় শুকনো। শুধু মাঝখানে
পায়ের পাতা ডোবা জল, কাদা। পছন্দের কাঠামো একটিও খুঁজে পেলাম না। তারপর,
একটি কাঠামো কয়েকজনে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে এলাম। দেখা গেল, সেটা একটা
কালীমূর্তির কাঠামো! এবারে আমি সমস্যায় পড়ে গেলাম। বীণা হাতে বসে থাকা
সরস্বতী আমার পছন্দ। কিন্তু যে কাঠামোটা তুলে এনেছি, সেটা কালীমূর্তির এবং
অবশ্যই দাঁড়ানো। কয়েকদিন ভাবলাম, কী করে এই কাঠামোর সঙ্গে মিলিয়ে সরস্বতী
মূর্তি হতে পারে। বোঝা গেল, আমার সরস্বতীকেও দাঁড়াতেই হবে, বাধ্যতামূলক!
অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আমার সরস্বতীও দাঁড়িয়েই থাকবে। সন্তোষদার
বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হলো প্রচুর খড়। আনা হলো পাটের সরু দড়ি। কয়েকদিনের
চেষ্টায় খড়ের কাঠামো চমৎকার দাঁড়িয়ে গেল। সঙ্গীসাথিদের নিয়ে সন্তোষদার
পুকুর থেকে মাটিও আনা হলো কয়েক দফায়। কয়েকদিন ধরে মাটি ছানা চলল। মেজদা
বুদ্ধি দিল, মাটিতে পাট মেশাতে হয়। নইলে, মাটি ফেটে ঝুরঝুর করে খুলে আসবে।
সেই মতো পাট জোগাড় হলো। ছোট ছোট টুকরো কেটে কাদামাটির সঙ্গে খুব করে
মেশানো হলো। তারপর শুরু হলো মাটি লেপার কাজ। এসব চলতে চলতেই একদিন ভর্তি
হলাম জেনকিন্স স্কুলে। একদিন এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলের কাছেই প্রতিমা
বানানোর পাড়ায় চলে গেলাম। বেশ কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিমা তৈরি
দেখলাম। সেখানে নানা ধরনের প্রতিমা। দেখলাম প্রতিমার মাথাটা আলাদা ভাবে
তৈরি করে জুড়ে দেওয়া হয়। ফলে, আমিও প্রতিমা শিল্পীদের অনুকরণে মাথা বাদ
রেখে মূর্তিটা বানাতে থাকলাম। ওরা হাত ও পায়ের আঙুলগুলোও আলাদা বানিয়ে পরে
জুড়ে দেয়। আমিও তাদের অনুকরণ করলাম। মূর্তি উঠোনে শুকোচ্ছে। মাঝে মাঝেই
ফাটা দাগ দেখা যাচ্ছে। আমি কাদা গুলে ব্রাশ দিয়ে পোচ দিতে থাকলাম। সেটাও
প্রতিমা শিল্পীদের কাছ থেকেই শেখা। নারকেলের অর্ধেক মালার ওপরে মাটি চেপে
বসিয়ে মাথার আদল নিয়ে এলাম। কয়েকদিনের চেষ্টায় চোখ, নাক, ঠোঁটের আকার দেওয়া
গেলো। তখন আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রায়ই প্রতিমা কারখানায় গিয়ে ঢুঁ
মারি। এসব করতে করতেই একসময় প্রতিমা তৈরি শেষ। এখন বাকি শুধু রং করা। সেটাও
করা গেলো। এমনকি, প্রতিমার গা চকচকে করতে তেঁতুলের বীজ সেদ্ধ করে তা দিয়ে
এক প্রস্ত প্রলেপ দেবার পর নরম কাপড়ে ঘসে ঘসে চমৎকার সুফল পাওয়া গেল। এখন
পুরো মূর্তিটা সাদা রঙের। আঁকতে হবে চোখ, ঠোঁট, চুল। কপালে পরাতে হবে টিপ।
চোখ ছাড়া সেসবও হয়ে গেল। আমার সঙ্গী সাথিদের প্রবল উৎসাহ। সন্তোষদা প্রায়
রোজই এসে দেখে যান কাজের অগ্রগতি। আরও অনেকেই এসে দেখে যান। আমরা ছোটরা এই
সরস্বতী প্রতিমার পুজো করব। রাস্তার পাশে একটা মাদার গাছের গায়ে পেরেক দিয়ে
সাইনবোর্ড লটকে দিলাম ‘স্বর্ণলতা ক্লাব’। সেটাও একটা পিচবোর্ডের ওপরে
আমারই লেখা। নামটা পছন্দ করলাম কয়েকজন মিলে আলোচনা করে। পাশের জঙ্গলে
প্রচুর স্বর্ণলতা আমাদের নজরে পড়েছিল। সেটা দেখেই স্বর্ণলতা নামটা মনে
এসেছে। পুজোর আগের দিন স্কুল গিয়েছি। দুপুরের পরই স্কুল ছুটি হয়ে যাবে।
বিকেলে প্রতিমার চোখ আঁকব ভেবে রেখেছি। ভেতরে ভেতরে খুব উত্তেজিত হয়ে আছি।
স্কুল থেকে ফেরার পথে শেষবারের মতো প্রতিমা কারখানায় হানা দিলাম। এক বৃদ্ধ
একটি প্রতিমার চোখ আঁকছেন। খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলাম। তারপর সোজা
বাড়ির পথে। বাড়িতে আমার জন্য খুব বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। রং শুরুর
আগেই শিশিরে নষ্ট হতে পারে ভেবে প্রতিমাটা ঘরেই এন রাখা হয়েছিল। ঘরে ঢুকে
দেখি প্রতিমার চোখ আঁকা হয়ে আছে! কিন্তু সে চোখ আমার স্বপ্নের থেকে
সম্পূর্ণ আলাদা। সত্যি বলতে কি, বিশ্রী লাগছিলো। এমন সে চোখ, যাকে সরস্বতীর
চোখ বলে মনেই হচ্ছিল না। বরং, সে চোখ অসুরের চোখও হতে পারত! আমি এই দৃশ্য
দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছি। কী করে এমন হল! মেজদি এগিয়ে এসে বলল, ‘তুই তো পারবি
না, সেজন্য ওকে (এক দাদাকে দেখিয়ে) আঁকতে বলেছি। কী সুন্দর হয়েছে’। আমি
একথা শুনে কেঁদে ফেলেছি। আমার স্বপ্নের প্রতিমা, এতদিন তিলে তিলে সেটা
বানিয়েছি। সবটাই আমার নিজের করা। একেবারে শেষ মুহূর্তে আমার স্বপ্ন ভেঙে
চৌচির। আমার ইচ্ছে করছিল প্রতিমাটা ভেঙে ফেলি। এক বালকের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে
ফেলেছিল মেজদি। এখনও সেই কষ্টটা মনে আছে। বয়সে বড় অতএব ‘পদাধিকার বলে’ এই
যে সব কিছুতেই বড়দের চরম কর্তৃত্ব, এটা চিরকালই আমার না-পসন্দ। জীবনের
প্রতিটি ক্ষেত্রে বড়দের এই কর্তৃত্ব আমার পক্ষে ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়ে
উঠেছে। আমার প্রতিটি স্বপ্ন, প্রতিটি আকাঙ্ক্ষা বড়রা চিরকাল নির্মমভাবে
গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এনিয়ে একসময় তীব্র ক্ষোভ ছিলো আমার। আর, তারই জেরে আমিও
তাদের সীমাহীন কর্তৃত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা চালিয়ে গেছি দীর্ঘকাল।
পারিবারিক যেসব নিয়ম-শৃঙ্খলা সকলের পক্ষেই ছিল একেবারে অনতিক্রম্য, সে
সমস্তই আমি প্রবলভাবে অস্বীকার করেছি। চোদ্দ বছর বয়সে প্রথম সিগারেট
খেয়েছি, সেটাও পারিবারিক বিধিনিষেধকে সরাসরি কাঁচকলা দেখাতে চেয়েই। মাথার
ওপরে ডজনখানেক অভিভাবকের ‘অত্যাচার’ অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ‘আমাকে আমার মতো’
থাকতে দিচ্ছিল না তারা। বাড়িটা হয়ে উঠেছিল স্রেফ বন্দিশালা। আমার ভেতরে
অভিভাবকদের অস্বীকার করার প্রবণতায় বিরোধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। আমার
ক্ষোভের অন্যতম কারণ ছিল, সবক্ষেত্রেই বঞ্চনা। আমার স্কুল জীবনে কখনই
বই-খাতা-কলম-পেন্সিল ঠিকঠাক পাইনি। আমার স্কুলের বেতনের কথা কেউ গুরুত্ব
দিয়ে ভাবেইনি। ফলে, প্রতি বছরই আটকে থাকত সারা বছরের বেতন এবং রেজাল্ট
বেরনোর দিন সকলে মার্কশিট পেলেও আমার ভাগ্যে জোটেনি। পরের বছর জানুয়ারি
মাসে আগের বছরের পুরো বেতন দিতে হতো। একটা বা দুটো বই হয়ত কোনও কোনও বছর
পেয়েছি। আর, আমার ঠিক ওপরের দিদি আমার সঙ্গে একই ক্লাসের পড়ুয়া। দুজনের
নাম করে এক সেট বই কেনা হলেও সারা বছর একটি বইও আমার চেখে দেখার সুযোগও হতো
না। অভিভাবকদের কাউকে বলেও কোনওদিন সুফল মেলেনি। ফলে, আমার ভরসা ছিল
ক্লাসের বন্ধুরা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তাদের বই টেনে নিয়ে খানিকটা পড়ে
নিতাম। স্বভাবতই মনে রাখার দায় ছিলই আমার। এবং ওভাবেই ফাইভ থেকে মাধ্যমিকের
বেড়া টপকে যাওয়া! আর, সবচেয়ে বেকায়দায় ফেলেছিল অংক। বিশেষ করে বীজগণিত।
সেভেনে প্রথম দিন অংকের ক্লাসেই মালুম হয়েছিল, পাটিগণিত যেমন সহজে হতে
পারে, বীজগণিতে সেটা সম্ভব নয়। প্রথমেই শিখতে হবে ফর্মুলা। ‘এ প্লাস বি হোল
স্কয়ার’ জিনিসটা ঠিক কী অথবা সেটাই ‘এ স্কয়ার প্লাস টুএবি প্লাস বি
স্কয়ার’ কী করে হবে অথবা কেনই বা হবে...সবটাই আমার কাছে জটিল ধাঁধা মাত্র।
পরবর্তীতে ‘পাইয়ের মান’, ‘থিটা’, ‘কস থিটা’ ইত্যাদি, প্রভৃতি আমাকে এমন এক
অন্ধকার গুহায় ঠেলে দিয়েছিলো যেখান থেকে আর উঠে আসা হয়নি! বীজগণিত
প্রতিদিনই আমাকে ছাত্র হিসেবে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ফলে, অংকের ক্লাস মানেই
গায়ে জ্বর আসা। এখনও ভাবলে বিস্ময়ের শেষ থাকে না যে, এই বিশাল পৃথিবীতে কেউ
একজনও আমাকে বীজগণিতের গোলকধাঁধা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেনি। ক্লাস
সেভেন থেকে মাধ্যমিক অবধি অংক কষার জন্য আমার ছিল বড় জোর দুই দিস্তা বা
আড়াই দিস্তা কাগজ!
সরস্বতী প্রতিমার চোখ আঁকার ওই ঘটনার পর দীর্ঘকাল আর মূর্তি বানাইনি।
প্রবৃত্তি হয়নি। দেড় দশক পর ফের মূর্তি তৈরিতে প্রবল আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম।
তবে, এবারের প্রচেষ্টায় অবশ্য সচেতনভাবে শিল্প সৃষ্টির মেজাজ ছিল। অনেক
ভাঙচুর করেছিলাম অবয়বে। প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল। তবে, বছর তিনেক
মাত্র। তারপর চিরকালের জন্য সরে এসেছি সেই পথ থেকে। মাঝখানে একবার ফের ছবি
আমাকে গ্রাস করেছিল। ততদিনে চিত্র সম্পর্কে খানিকটা পড়াশুনো হয়েছে।
বিখ্যাত শিল্পীদের ছবির প্রিন্ট দেখেছি। ক্লাস ইলেভেনে আমাদের পাঠ্য ছিল
সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাশ্মীর কবিতাটি। একদিন সুকান্তের কাশ্মীরকে বিষয় করে
ছবি আঁকলাম। অনেকের ভালো লেগেছিল সেই ছবি। উৎসাহিত হয়ে ফের কিছু ছবি আঁকি।
এতদিন মেটে রং, জলরং নিয়ে কাজ করেছি। এবারে তেলরঙে তীব্র আসক্ত হয়ে পড়ি।
কিন্তু ভেতরে কেমন এক অস্থিরতা চলছিল, যার সুস্পষ্ট চেহারা আমার দৃষ্টিতে,
চেতনায় ধরা দেয়নি। এই অস্থিরতা আমাকে কোথাও স্থির হতে দিচ্ছিল না। অথচ,
কোথাও যেন স্থিত হতে চাইছিলাম। ছবি, ভাস্কর্য, কবিতা লেখা, গল্প লেখা এবং
পড়াশুনো, সবই চলছিল সমান তালে। তবু, বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কোনটা আমার
নিজের হতে পারে। এই অস্থির অবস্থা চলেছে বছর তিনেক। সে এক অদ্ভুত সময়। একটা
ঘোরের মধ্যে যেন কেটে যাচ্ছে দিনরাত।