তোর্সার ঘর বাড়ি//পঞ্চদশ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
-------------------------------------------
গঙ্গা যমুনার নদী বলে হীরা-জিরা
মন কহে উড়িয়া যাও, বিধি না দেয় পাঙ্খা...
পরিযায়ী
হয় মেয়ে।ঘর থাকেনা।থাকেনা বসত। কিছুই হয়না নিজের অন্তরতম। যে সবুজ উঠোনের
একধারে বসে বড়মা বড় মাটির জালায় বটপাতা ভেজাত, ভিজতে ভিজতে সে পাতার সবুজ
গা থকথক করত, বড়মা দু আঙুলে ক্লোরোফিল তুলে ফেলে সাদা বটপাতার স্কেলিটন
বিছিয়ে দিত পরিষ্কার কাগজের উপর। সেগুলো প্যাকেটবন্দী হতে সময় নিত, ওর ই
ফাঁকে দু-চারটে শুকনো স্কেলিটন উড়ে এলে হাতের রঙ তুলি উসখুশ করত। স্কুলে
শেখা সদ্য ডিমের খোলার উপর পুতুল, নানা নকশা তখন সদ্য শিখছে সেসব করতে
করতেই বটপাতার শিরা উপশিরার উপর ছবি এঁকেছে ছোট্ট আমাদের প্রজ্ঞা। বাড়ির
সবার মিনি,বড়মার মনা। এ আদরগুলো কৌটো ভরে অস্তসূর্যের রঙে মিশিয়ে কোথায় গেল
মিনি! মনটা এধারে ওধারে আছারি পিছারী। চলে যাওয়ার দিনে বাবার মুখের সেই
কান্না মেশা হাসিটা কি করে ভুলে যায়! আর তারপর ওদের গাড়িটা মদনমোহন বাড়ি
হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরই ঘনারামের কথা শুনেছিল পরে ফিরে গিয়ে। সারারাত
মনখারাপের আকাশের নীচে শুয়েছিল সে। কারো ডাক শোনেনি। না সুমিত্রা মাসি,না
মনো। প্রিয় বন্ধুকে ছেড়ে দেওয়া আর তোরসার হাত বহুদিন আগেই ছেড়ে চলে যাওয়া
ঘনা আর ফিরবেনা রাজনগর। বলে গিয়েছিল। তার খবর আর কে রেখেছে! চরুয়া বাপ মা
কবেই মরেছে, ঐ মাসিটার জন্য ঠিক মাস মাস মানিঅর্ডার করেছে ঘনা, ওটুকুই
যোগসূত্র। ফাঁকা শূন্য মিত্র বাড়িটার দাওয়ায় বসে ঘনা যেদিন চলে যাবে চোখের
জলে ডুকরে উঠেছিল। ছোটবৌ,মিনির মা বুকে টেনেছিল ওকে। পুনুর চোখের জল কেউ
দেখতে পায়নি সেদিন। আড়াল করেছিল। ওর আদরের দিদিটার বেধড়ক ভালবাসাবাসিতে
পুনুতো একটু কোনঠাসাই বরাবর। বাবা মার শূন্যতার চেয়ে এবার বিরাট ক্ষত তৈরি
হল ওর নিজের ভিতর। ঘনার কাছে বসেছিল সে, দুজনে মিলেই জলের ধারে পুরোনো
দাদা ভাইয়ের মত মনে মনে মিনির মঙ্গল চেয়েছিল যার যার মত করে নীরবে নির্জনে।
ভালবেসে।
খুব কি দূরত্ব এক শহর থেকে অন্য শহর...
নাতো! তাহলে, মাঝে মধ্যেই ছুটে ছুটে এসেছে মেয়ে। চাকরি সামলে...রক্তিমের
উদাসীনতার সবটুকু গুছিয়ে নিয়ে ভেবেছিল এ বাড়ির বড়ছেলের ভূমিকায় ওকে পাওয়া
যাবে। হয়নি। সব মানুষ সমান হয়না। ভাবনার তারতম্য থাকে, গড়ে ওঠার বিরাট
ফারাক থাকে, সবটুকু ভাল লাগাগুলো এক করে মন্দগুলো পাশে নিয়ে একমাত্র বাবা
মা আর নদীর কাছে যাওয়া যায়। সে নদীও হতে হবে নিজের একান্ত নিজস্ব। সে টান
বড় গভীরের।
দুর্গোৎসব মানেই অভিজিৎ আর ছোটবৌ এর নিভৃত
প্রতীক্ষা। এ অপেক্ষা বাড়ির অন্যান্যদের ও। রান্নাঘর কবেইতো আলাদা
হয়েছে, উঠোন জুড়ে ঘর উঠেছে, একে একে কাটা পড়েছে কাঠগোলাপ, কূটরাজ, ডালিম,
পেয়ারা, জলপাইগাছ। মিনির আর আসতে ইচ্ছে হয়নি। সেদিন শূন্য কাঠগোলাপ হীন
বাড়ির ফটক পেরিয়ে নিজেদের ঘরের দরজায় এগিয়ে যাচ্ছে, পা সরছিলনা মিনির। শরীর
খারাপ লাগছে, এখনো সে মাটিতে এক্কা দোক্কার দাগ লেগে আছে, চোখের সামনে
শক্ত দড়ি বাঁধা দোলনাটা উঠছে আর নামছে। কাঠবেড়ালির মত মনখারাপ হলেই
কাঠগোলাপের কাছে গিয়ে মনের কথার ধারাভাষ্য দেওয়া...সেসব কোথায়! এ বাড়ির
ছেলেরা তাদের প্রয়োজনে ঘর বানিয়েছে, ঘরতো নয়, ইমারত। রাস্তা ছুঁয়েছে সব,
উঠোনহীন গাছপালা হীন অন্ধকার কুঠুরি রাতের আলোয় ঝলমল করে। চৈত্র মাসে সাদা
সজনে ফুলের ঝরে পড়া... জেঠির বানানো সে ফুলের বড়ার স্বাদ মুখে লেগে আছে,
চৈত্র শেষের সবুজ সজনের দুলুনি...সব হারিয়েছে। তাও মিনির রিক্সা এসে দাঁড়ায়
মাসে অন্তত: একবার তোর্সার পাড়ে। অভিজিৎ মিত্রের ভেঙে যাওয়া মুখে কি
পবিত্র হাসি তখন। মঞ্চ হারিয়েছে পথ। টুকটাক লেখালেখি নিয়ে বসে থাকা,
মাঝেমধ্যে বইপড়া আর পুরোনো পত্রপত্রিকা ঘেঁটে তোলা।...ছোটবৌ ভারি অসুস্থ।
মিনি যতবার ফিরে ফিরে আসে মার শরীর ক্ষীণ হতে দেখে।...এর ই মধ্যে পুনুর
কলেজ শেষ।কাগজ, লেখা এসব নিয়েই কাটে তার আর মা বাবাতো ছেলে মেয়ে তার। মিনির
ভিতর কেউ বলে এসব... এই মাটি, এইযে মার হাতে বোনা নিমের হাওয়া, এইযে ভিতর
উঠোনের দু দুটো নারকেল গাছ এদের রক্ষা করার দায়কি তারও ছিলনা! সে'ত এ মাটি
ছেড়ে, তোর্সার পাড় ছেড়ে ছুটে চলে গিয়ে বেঁচে গেছে।
একে
কি বাঁচা বলে! সময়ের ধারাভাষ্যে মিনিরও ছোট্ট কন্যা। ওকে নিয়ে এবাড়ি
এলেই সম্পূর্ন মাটি যেন তা ধিন ধিন। মার হাতে বোনা নারকেল গাছের মাটির নীচে
পোঁতা আছে সেই শুকিয়ে ওঠা নাভি মূল। মার থেকে বিচ্ছিন্ন করা অংশটুকু। সেই
থেকে সে মেয়েও রাজনগরের ই যেন। পুনুর নয়নমণি। কচি গলার গান কবিতায় ঘিরে
ঘিরে মাতিয়ে দিতে পারে মিত্রদের শরিকি ভাই বোনেদের। এঘর সেঘর সবখানেই ঠিক
এইরকম কথাবলা পুতুলেরা জড়ো হয় অভিজিৎ মিত্রের ঘরে প্রতি পুজেয় অষ্টমীর সকাল
থেকে দুপুর ওদেরকে তিনি একসঙ্গে করেন। খাওয়া দাওয়া গানে কথায়। প্রতিবছর
মিনির যোগদান আর নদী মাটির বন্ধুত্ব নিবিড় হয়।
* * *
কালচক্র
একভাবে ঘোরে? উত্তর হল 'না'। ভীষণরকম নেতিবাদ।আর যা চাইলাম সব কি পাওয়া
যায়, সব আমার হয়! হয়না। ছোটবৌ ওতো চেয়েছিল রক্তিম মা মা করে ছুটে এসে ছেলের
মত পাশে থাকবে, সে যে কখনো হবেনা মিনি টের পেয়েছিল অনেক আগেই।রক্তিমের
প্রকৃতি যূথবদ্ধতার বিপরীত। একার সংসার পুংতন্ত্রের কথকতা। ঠিক তখন ই
বিচ্যুতি। প্রজ্ঞা একা আরো একা।... শুরু হল মেয়ের পড়াশুনো। যাবতীয় চাপ
নিজের ভিতর নিয়ে প্রজ্ঞা তটস্থ। ভূগোলের সীমারেখা লঙ্ঘন করা যায়না আর। কমে
গেল নদী যোগ। কালে ভদ্রে কখনো বা বাবার অসুখে অথবা মার চিকিৎসায়।.... পুনুর
শুরু হল একার সংগ্রাম। অভিজিৎ মিত্র ঠিক নিজের প্রতি যত্নশীল কখনোইনা।
ওদিকে স্ত্রীর অসুখ ধরা পড়ার পর আরো ভেঙে যাওয়া এক মানুষ।
যেমন
নদী মুখ বদলে যায়, বিস্তৃত চর এপাশ থেকে ওপাশ বদলে যেতে থাকে, ছনের ঘর
গুলো ধীরে টিনের ছাউনিতে পরিনত হয়, ঠিক তেমন করেই সংসার বদলে যায়। গানের
বাড়ি, লেখার বাড়ি সব বদলে যেতে যেতে পুনুর কল্যাণে পুজোর সময় নাট্যমঞ্চ
আর মানুষ টিকে থাকে। কখনো মিনি কন্যা সহ জোর কদমে ছুটি নিয়ে চলে আসে আবার
দিন সাতেক পর ফিরে যায়। আসলে যে রান্নাঘ্য বড় প্রিয় হয়ে ওঠে মার হাতের
ছোঁয়ায় আর উপস্থিতিতে, বিভিন্ন পদ অপেক্ষা করে তার জন্য, ফুলকপি,
মোচাঘন্ট, সেই সরষে বোরোলী সব কোথায় থমকে গেল... রান্নাঘরে মার অনুপস্থিতি
মিনিকে কাঁদায়, শূন্যতা ভরে দিগ্বিদিক।মা ধীরে আরো ধীরে কেমন অন্য মানুষ
হয়ে যায় শরীর থেকে মনে। কেমন তীব্র আগ্রহে সে আসে আর স্বার্থপরের মত পুনুর
হাতে সব ছেড়ে পালিয়ে যায়। এইতো ইতিবৃত্ত। মার কষ্টের তীব্রতা পরীক্ষা করে
ডাক্তার দেখিয়ে ধরা পড়েছে ক্যানসার।সিরোসিস অব লিভার, যা সারবে কেউ বলেনা
তখন। সে যন্ত্রণা মিনি দেখবে কি করে! কোন কষ্টের আঁচ লাগতে দেয়নি যে দুজন
মানুষ, তাদের ছেড়ে এ নদীর আলেয়াটুকু ছেড়ে, এ স্থলপদ্মের গোলাপি পাপড়ি ছেড়ে
মিনি অনেকদূরে মুখ লুকিয়ে থাকে। কন্যার পড়াশুনোই বড় কারণ এখন। না, রক্তিম
কোন কিছুতেই মাথা ঘামায়নি কোনদিন। মেয়ের ব্যাপারেও আলতো ছুঁয়ে থাকাটুকু। ঐ
যখন প্রজ্ঞাকে ছাড়তে হয়েছে না পেরে ততক্ষণ সে উদাসীন পিতা, উদাসীন পরিবার।
স্বতন্ত্র একা। মিনির ছুটে যেতে ইচ্ছে করে ঐ নৌকোর কাছে, যেখানে খরস্রোতা
তিস্তার সঙ্গে মিলেছে করলা। এ জলশহরের নদী বৈভব। বড় বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে
ইচ্ছে হয় সেই কবেকার নদীর মত ভুলে যাওয়া তার শান্ত স্রোতের গভীরতার মত। না
তেমন নিবিড় কলকথা আর বন্ধুত্ব, মাও জননী তোর্সার মত... হয়না। শুধু গড়ে ওঠে
ডুয়ার্স কথা সবুজ অরণ্য পাহাড়ী ঝর্নার উপকথা বুকের ভিতর। খুঁজতে থাকে
তিস্তা বঙ্গ জীবনে নদীর লুকোনো খাত আর প্রমত্ততা। পড়ে নেয় দেবেশ রায়, ছুঁয়ে
থাকে অক্ষর অশোক বসুর। উপন্যাসে ডুব সমরেশ মজুমদার।
অভিজিৎ
বাবুর পরামর্শ মত নিজে আর অভিনয় করল কোথায়! কিন্তু কলেজ ছাত্রীদের নিয়ে
গড়ে নিল নিজের পীঠস্থান খানি।ভালবাসার অন্য জমি। সেখানে পরিচালক প্রজ্ঞা
কখনো গান কখনো নাটকে ছাত্রীদের শিখিয়ে আত্মজা রোহিনীকেও সঙ্গে নিয়েছে,
খুঁজেছে পছন্দের আকাশ।
বন্যার স্রোতের মত কাজ আর
কাজে ডুবে যেতে থাকে সে। যাতায়াত ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। রোহিনীর আব্দারে বেশ
ক'বার ছুটি নিয়ে চলে গেছে। বেশ ক'মাস যায়নি। মায়ের অসুখের বাড়াবাড়িতে
স্থানীয় ভাবে ব্যবস্থা করে মাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া...
অপারেশন
আর সারিয়ে তুলে আবার প্লেনেই ফেরা সে নব্বুয়ের দশকে বহু মানুষ,আত্মীয় আর
অভিজিৎ বাবুর সঙ্গে থাকার ফল।যৌথ যাপনের সদর্থক দিক। তোর্সার পাড় ভাঙনের মত
ছোটবৌএর রূপ গেছে। মেঘের মত চুল গেছে। নিজস্ব ভাবনায় ডুবে থাকা তার এখনকার
সময়।
* * *
সময়ের টানাপোড়েন সুস্থ এক মানুষের অন্তর গভীরে চলে তীব্র ক্ষণন। ধীরে সংযোগ হীনতায় সে নি:সরণ কমে যায়।
পুনুও
বাড়ির জটিলতা থেকে বাঁচতে প্রেমে আছে, কষ্টে আছে। সদ্য মন দিয়েছে । ঘরের
আসবাবের মত মা- বাবাকে এত সময় দেওয়া আরকি করে সম্ভব! আসলে ধীরে চর পড়ে নদীর
দূরে চলে যাওয়ার মত মা বাবার সঙ্গে মানসিক দূরত্ব বাড়ে। এখানে বৃদ্ধ মা ও
বৃদ্ধ বাবার পারস্পরিক সহাবস্থান, মতামত এক সরলরেখায় দাঁড়িয়ে থাকলে বা
মতামতের জায়গায় সমদৃষ্টি সমমত হলে সন্তান এবং কাছের মানুষের সুবিধে হয়।
* * *
না তা হতে দেয়নি পুনু। মার ইচ্ছামৃত্যুর পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। লজ্জা
পেয়েছে বিস্তর ছোটবৌ হাসপাতাল থেকে ফিরে। মিনুর লজ্জা বেড়েছে এখানে এ মাটির
কাছে, এ নদীর কাছে, প্রিয় মানুষদের কাছে থাকা হলোনা বলে।
বাবার
সজ্ঞান সেবা করা মানেই এখন সবার সঙ্গে প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে দেওয়া। সৃষ্টি
হয় নির্জনতার ভাষা। এ যাত্রায় টিকে যান ছোটবৌ। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বাবা
অভিজিৎ। হাতঘড়ির দিকে তাকায়- না, আজ না।... আগামীকাল সুগার টেষ্ট করাতে
হবে। বেঁচে থাকার নতুন সূর্য আলো জাগে অভিজিতের প্রশস্ত কপালে।