চা-ডুবুরি : পর্ব-১৫
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
জীবনের নতুন বাঁকে
'সবে দশম শ্রেণীতে উঠেছি। খবর পেলাম বাবা অসুস্থ। কুচবিহার থেকে তাঁকে দেখতে এসেছিলাম কাজলিডাঙায়। ভেবেছিলাম দেখেই ফিরে যাব। আমার চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ব, কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটি। তারপর বেছে নেব সেই মানুষটির মতো জীবন, যাঁকে স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখতাম।
সুনীতি রোড ধরে স্কুলের পথে চলেছি। সেসময় রাজনগরের সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়। ঝকঝকে রাস্তা। রাস্তার দু'ধারে বড়বড় গাছ। জল টলটলে দীঘি। কিছুদূর যেতেই প্রাচীন ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের নিদর্শন বড় পোস্ট অফিস বিল্ডিং। ঠিক তার পাশেই ছোট্ট ছিমছাম একটি বাড়ি। সামনে ফুলের বাগান। দেখতাম সেই বাড়িটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন একজন শ্যামবর্ণ, দীর্ঘদেহী সুপুরুষ। পরনে নিপাট, ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী, পায়ে চকচকে পাম-শ্যু। হাতে তাঁর কখনও থাকত বই। মৃদু হাস্যময় মুখচ্ছবি। আপন মনে হেঁটে চলেছেন ভিক্টোরিয়া কলেজের দিকে। তিনি অধ্যাপক মনোময় মুখার্জী। তাঁকে দেখতাম আর ভাবতাম, একদিন প্রচুর লেখাপড়া শিখে এই মানুষটির মতো হব। সেই স্বপ্ন ছুঁতে পারিনি। অধ্যাপক হতে পারিনি। তবে ঐ মানুষটির ছবি আমার মনে গাঁথা হয়ে গেছিল। আর তিনি যেন অজান্তেই আমার মধ্যে জ্ঞানতৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়ে গেছিলেন। অধ্যয়নের নেশাটুকু জাগিয়ে দিয়ে গেছিলেন। কিন্তু হলে কি হবে, ভাগ্যের মার যে বড় নির্মম, সুবর্ণ। যাকে মারতে শুরু করে, নিঃস্ব না করে ছাড়ে না। ভেবেছিলাম স্বপ্ন সাকার হয়নি তো কি হয়েছে, লেখাপড়া চালিয়ে যাব। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বই-ই হবে আমার সঙ্গী। অথচ দেখ, ভাগ্য আমার দৃষ্টিশক্তিটাই কেড়ে নিল...'
সুবর্ণর সাথে কথোপকথনের সময় সেই বিকেলের কথা মনে পড়ছিল সত্যপ্রিয়র। যে বিকেলটা হঠাৎ করে একটি স্বপ্নাবিষ্ট কিশোরকে এক ঝটকায় টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বাস্তবের আয়নার সামনে। বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে দ্রুত হেঁটে আসছিল একটি প্রাণবন্ত কিশোর। বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসছে তখন। নিঃশব্দে বাড়ির বারান্দায় পা রাখতেই বন্ধ দরজার ওপার থেকে কানে ভেসে এলো মায়ের গলা,
-'....সব অদৃষ্ট। না হলে আমার কপালেই এত কষ্ট কেন দিদি! জীবনে কোনও দিন স্বচ্ছলতার মুখ দেখলাম না। বিয়ের পর থেকে জোড়াতালি দিয়েই মুখ বুজে সংসার করে গেলাম। তবু হাসিমুখেই থেকেছি। কখনও মুখ ফুটে ওঁর কাছে কিছু চাইনি। । সংসারে অভাবের কথা ছেলেদেরও বুঝতে দিইনি। কোনও আঁচ আসতে দিইনি ওদের গায়ে। আজ দু'বছর হতে চলল, আপনার ঠাকুরপোর মাইনেপত্র বন্ধ। সব জেনেও বিপদের দিনে আমাদের ফেলে বিশুটাও বউ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। কিভাবে চলছে আমাদের একবার খোঁজও নেয় না। ওদিকে সতু কুচবিহারে যাদের কাছে থাকে, থাকা খাওয়া বাবদ একটি পয়সাও পাঠাতে পারি না তাদের, একরকম তাদের দয়াতেই... '
-' ঠাকুরপোর ব্যাপারটা কোনও ফয়সালা হল নে এখনও পর্যন্ত? '
- কোথায় আর হল দিদি। কত চিঠিপত্র, কত কিছু। কিছুই তো হল না। উপরন্তু বাগান থেকে যেটুক জুটত সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। বললাম, একবার যাও। বড় সাহেবকে সব খুলে বল সংসারের অবস্থাটা। মানুষটা এমনিতেই চিরকাল মুখচোরা। নিজের ব্যাপারে কিছুই বলতে চায় না। তার ওপর রোজগারপাতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন গুম মেরে গেছিল। কত বলতাম, চিন্তা কোরো না। আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় কি! চোখের সামনে মানুষটা যেন তিল তিল করে....' কথা ফুরোয় না। মায়ের গলাটা কেমন যেন কান্নাভেজা শোনায় ভেতর থেকে।
অস্থির হয়ে কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে মায়ের কাঁপা কন্ঠস্বর শোনা যায় 'কে-এ-এ...?'
'আমি..ই..দরজা খোলো। '
'ও-মা। সতু এয়েচিস? এইমাত্তর তোর মা তোর কতাই বলচিল...আয় বাবা...' দরজা খুলে সস্নেহে কাছে টেনে নেন ভালজ্যেঠিমা। পাশের কোয়ার্টারের বাগানবাবু কানুজ্যেঠার স্ত্রী। কানুজ্যেঠারা বীরভূমের মানুষ। ছোট থেকে এই একটি পরিবারকে খুব কাছের বলে মনে হত সত্যপ্রিয়র। বিপদে আপদে কানুজ্যেঠা, তাঁর স্ত্রী আর তার ছেলেমেয়েরা সমসময় পাশে থেকেছে। কাজলিডাঙার বাসালাইনে বাবুদের মধ্যে একে অপরের প্রতি যথেষ্ট হৃদ্যতা থাকলেও 'স্কুল মাস্টার' কুমুদরঞ্জনের প্রতি কিছু মানুষের কিঞ্চিৎ অনুকম্পার ভাব মিশে থাকত। আসলে কাজলিডাঙ্গাই শুধু নয়, সেসময় প্রাইমারি স্কুল মাস্টারদের সর্বত্রই সামাজিকভাবে কিছুটা হেয়জ্ঞান করা হত। স্বল্পবেতনপ্রাপ্তি তাঁদের একটা সময় কুন্ঠিত করে রেখেছিল । পরবর্তীতে সহসা বেতন বৃদ্ধির কারণে তারাই আবার হয়ে উঠেছিলেন সকলের চোখে ঈর্ষনীয়। কেবল এই একটি পরিবারের কাছেই বরাবর একই রকম ব্যবহার পেয়ে এসেছিল কুমুদরঞ্জনের পরিবার।
সত্যপ্রিয় দেখে বিছানার ওপর বসে মা একটি ছেঁড়া ব্লাউজ সুঁই সুতো দিয়ে সেলাই করছেন। পাশের খুপরি ঘরে মশারিঘেরা তক্তাপোষের ওপর কুমুদরঞ্জন শুয়ে। চাদরে ঢাকা তাঁর পা দুটো চোখে পড়ছে। ঘরের জানালা দিয়ে ফিরে যাচ্ছে শেষ বিকেলের মনখারাপ করা আলো। ছেলেকে দেখে চটপট চোখের জল মুছে মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে সুনয়নী,
' ও মা, তুই কখন এলি, সতু ? '
-' এই তো মা, এইমাত্র। ' বলেই দৃষ্টি চলে যায় পাশের ঘরে, 'বাবা কেমন আছে মা? '
-জ্বর আসছে রোজ রে, এই সময়টায়। রক্তপরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন ডাক্তারবাবু। আজ রিপোর্ট আসার কথা। '
-'তোমরা মা-ছেলেতে গল্প করো। আমি চললুম। সতু, থাকবি তো কদিন বাবা...যাস বাড়িতে। তোর জ্যেঠামশায় তোর কথা খুব বলেন... '
পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোন পেরিয়ে দু-বাড়ির সীমানা সংলগ্ন বাঁশের গেটটা খুলে চলে গেলেন ভালজ্যেঠিমা। পেছন পেছন সুনয়নীও চলে গেলেন 'পাকঘরে'। সেখান থেকে আলো জ্বেলে নিয়ে এসে ঘরে রাখলেন। হ্যারিকেনের হলুদ আলোয় ঘরের দেয়ালজুড়ে নেমে আসে ছায়াময় বিষন্নতা। একটু আগে হঠাৎ শুনে ফেলা সাংসারিক সংকটের কথাগুলো ভারাক্রান্ত করে তোলায় ভারমুক্ত হতে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সত্যপ্রিয়। ঠাকুর ঘর থেকে মৃদুস্বরে গুরুবন্দনা ভেসে আসছিল। সন্ধেপ্রদীপ জ্বালার আগে গলায় আঁচল জড়িয়ে এভাবেই রোজ 'ভব সাগর তারণ' গান সুনয়নী। গাইতে গাইতে একটি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে হাতের তালুতে আড়াল করে নিয়ে যান তুলসি তলায়। ফিরে এসে সুর করে তিনবার শঙ্খে ফুঁ দেন । ধূপদানিতে করে প্রতিটি ঘরে ধূপের ধোঁয়া দেন। সত্যপ্রিয় লক্ষ্য করে আজও তাই করলেন মা। এত কিছুর পরেও তাঁর ঈশ্বর বিশ্বাসে এতটুকু চিড় ধরেনি। সেই একইরকম নিষ্ঠায় রোজকার নিয়মগুলো পালন করে চলেছেন। তাঁকে দেখে একটুও বোঝার উপায় নেই যে কি পাহাড় প্রমাণ অনিশ্চয়তা, অনটন বুকে করেও তিনি অবিচল রয়েছেন ।
আলো জ্বেলে সুনয়নী চলে গেলেন রান্নাঘরে চা করতে। পাশের ঘরে নিঃসাড় কুমুদের কোনও সাড়াশব্দ নেই। সত্যপ্রিয়র একবার ইচ্ছে হয় তাঁর কাছে যায়। গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, 'কেমন আছ, বাবা? ' কিন্তু জেগে ওঠা ইচ্ছেটাও কেন যেন দপ্ করে নিভে যায়। কথাগুলো শোনার পর থেকে মনের ভেতরটা ওলোট-পালট হয়ে গেছে। এত বড় একটা কথা তাকে বুঝতেও দেয়নি মা! পাছে তার পড়াশুনার ক্ষতি হয়, এই ভেবে ? কতদিন বেতন পান না বাবা? কীভাবে চলছে তবে সংসার! কিছুই তো তাকে জানতে দেননি সুনয়নী। কেনই বা বেতন পাচ্ছেন না? উনি কি কোনও অন্যায় করেছেন? জ্ঞানত অন্যায় করার মানুষ তো নন কুমুদরঞ্জন! তাহলে...? আর দাদা, সবকিছু জেনেও স্বার্থপরের মতো চলে যেতে পারল বাড়ি ছেড়ে! মনের ভেতর নানান প্রশ্ন উথাল পাথাল করছিল সত্যপ্রিয়র। সে মনস্থির করে ফেলে, মাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে এবার। দরকার পড়লে আর ফিরে যাবে না কুচবিহারে।
সে রাতে ডাক্তারবাবু রিপোর্ট নিয়ে এলেন। কাজলিডাঙার এল. এম. এফ ডাক্তার বিনয়ভূষণ মিত্র। হাতে টর্চ, গলায় স্টেথোস্কোপ। চোখে চশমা। ধুতি-পাঞ্জাবী পরা বেঁটেখাটো মানুষ। তিনি আসতেই সুনয়নী ঘোমটা টেনে নেন মাথায়। তারপর লন্ঠনটা নিয়ে গিয়ে কুমুদের ঘরে রেখে চেয়ারটা এগিয়ে দেন। এরপর মশারিটা তুলে খুব নিচুগলায় কুমুদকে ডেকে তোলেন। সত্যপ্রিয় লক্ষ্য করে কদিনেই বাবার শরীরটা বিছানার সাথে মিশে গেছে। বিনয়ভূষণ পকেট থেকে থার্মোমিটার বের করে কুমুদরঞ্জনের বগলতলায় দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,
' বিকেলে জ্বর এসেছিল? '
সুনয়নী মৃদু স্বরে উত্তর দেন, ' হ্যাঁ, সামান্য। '
খানিক বাদে জ্বর পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু সুনয়নীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'জ্বর বেড়েছে। যে ওষুধটা দিয়েছিলাম সেটি চলছে তো? '
সুনয়নী মাথা নেড়ে জানায়, 'হ্যাঁ'।
সত্যপ্রিয়র দিকে চোখ পড়তেই জিজ্ঞেস করেন, 'তুমি কবে এলে? '
-'একটু আগে' সত্যপ্রিয় কাছে গিয়ে প্রনাম করে তাঁকে।
-'থাক, থাক... তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়ছ?' জানতে চান বিনয়ভূষণ।
-' আজ্ঞে, ক্লাস টেন এ উঠলাম এবারে'
-' অ। তারমানে সামনের বছর ফাইনাল... বেশ...ভাল। তুমি একটু এদিকে এসো তো বৌমা। '
উঠে পড়েন ডাক্তারবাবু। সুনয়নীকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে জানান কুমুদরঞ্জনের খারাপ ধরনের ম্যালেরিয়া হয়েছে। সেসময় চা বাগান অঞ্চলে কয়েকটি অসুখ ছিল প্রাণঘাতী। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, আর রক্ত-আমাশয়। ম্যালেরিয়ার ওষুধ বলতে ছিল শুধু কুইনাইন। ট্যাবলেটে কাজ হচ্ছিল না দেখে পরদিন কুমুদের কোমরের নিচে কুইনাইন ইঞ্জেকশন দেয়া হল। প্রচন্ড যন্ত্রণাদায়ক সেই ইঞ্জেকশন সহ্য করতে পারেননি কুমুদরঞ্জন। কদিন বাদেই তা পেকে উঠল। যন্ত্রণায় ছটফট করে কাটল তাঁর কটা দিন বিছানায়। অবস্থা সঙ্গীণ দেখে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল কুচবিহারে অস্ত্রোপচারের জন্য। অপারেশনের পরেও সেরে উঠলেন না পুরোপুরি। শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন একেবারে।
কথাটা ততদিন পর্যন্ত মাথার ভেতর ঘুরপাক খেয়ে চলেছিল সত্যপ্রিয়র। একদিন সরাসরি জানতে চাইলে সুনয়নী প্রথমে বলতে চাননি কিছুতেই। পরে জানান, বছর দুয়েক আগে হঠাৎ করে একদিন সরকারি নির্দেশে আসে যে, চা বাগানের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের এখন থেকে সরকারি শিক্ষক বলে গণ্য করা হবে এবং তাঁরা সরকার তরফে বেতন পাবেন। এই নির্দেশ আসার সাথে সাথে বাগান থেকে বেতন দেয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নিয়মানুযায়ী বাগান কর্তৃপক্ষ স্কুল বোর্ডকে কুমুদরঞ্জনের নামটা সময়মতো না জানানোয় তাঁর নাম সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হয় না। এরপর বহুবার জানানো সত্বেও বাগান কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ায় স্কুল বোর্ডের বেতন থেকেও বঞ্চিত হন কুমুদরঞ্জন।
এরই মধ্যে প্রথম পুজো বোনাস নিয়ে চা বাগান অঞ্চলে দাবি উঠতে শুরু করেছে। সেসময় ইউনিয়নের সহায়তায় কাজলিডাঙার বাবুরা কেস করলেন শ্রম দপ্তরে। সেই কেসের নিষ্পত্তি হয় বেশ কয়েক বছর বাদে। এক লপ্তে বাহান্ন মাসের পুজো বোনাস হিসেবে প্রচুর টাকা পান কাজলিডাঙার বাবুরা। একমাত্র পেলেন না কুমুদ। কেননা বাগান তরফে তাঁকে বেতন দেয়া সবে তখন বন্ধ হয়েছে। এই ঘটনা ভীষণভাবে আঘাত করে কুমুদরঞ্জনকে। প্রতিবাদ করতে পারেন না। বরং আরো গুটিয়ে যান। হতাশায় ডুবে যেতে যেতে সামান্য মস্তিষ্ক বিকার ঘটে তাঁর।
সত্যপ্রিয়র আর ফেরা হল না কুচবিহার স্কুলে। বন্ধ হল পড়াশোনা। তবু বাড়িতে বসে বইপত্র যোগাড় করে পড়া চালিয়ে যেতে থাকে। আর সকলের অনুরোধে বাবুদের বাড়ি গিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়াতে শুরু করে। বিনিময়ে কিছু উপার্জনও হতে থাকে । সেই সামান্য টাকা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে কিছুটা হলেও অর্থকষ্ট লাঘব হচ্ছিল সংসারের। এরই মধ্যে জটেশ্বর স্কুল হাইস্কুলে উত্তীর্ণ হওয়ায় সেখানে ভর্তি হয়ে পরের বার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সত্যপ্রিয় ভাল নম্বর নিয়ে পাশও করে যায়। ঠিক এই সময় মনের সুপ্ত বাসনাটা আবার উড়াল দিতে শুরু করে । কিন্তু সেই উড়ান ফের থেমে যায় পারিপার্শ্বিকতার চাপে।
পাশ করার সাথে সাথে বাগানের শুভানুধ্যায়ী যারা, তাঁরা চাপ দিতে শুরু করেছিলেন সুনয়নীকে, 'সতুর আর পড়াশুনা করে কাজ নেই বৌমা, এবারে ও সংসারের হাল ধরুক। তুমি চাইলে বড়বাবু বড়সায়েবকে বলে ওর একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। '
সুনয়নী পড়েছিলেন দোটানায়। তিনি তাঁর ছেলের মনের বাসনা যেমন জানেন তেমনি সংসারের অচল অবস্থাতেও জেরবার অবস্থা তাঁর। তবু তিনি সত্যপ্রিয়র ইচ্ছের ওপরই ছেড়েছিলেন পুরো ব্যাপারটা। সেসময় বাড়িতে রোজ চা খেতে আসতেন সুখলালবাবু। তিনি যদিও বাগানের কর্মচারী ছিলেন না। ছিলেন কন্ট্রাক্টর। কুমুদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সূত্রে তিনি রোজ আসতেন।সকাল-বিকেল একটি নির্দিষ্ট সময়ে কুমুদ যখন চা খেতেন, তখন তিনিও আসতেন সুনয়নীর হাতে গরুর দুধে তৈরি সুস্বাদু চা খেতে। এই সুখলাল বাবুই নানাভাবে বোঝাতেন সত্যপ্রিয়কে। একদিন বললেন, 'দ্যাখো, এই ম্যানেজার মিঃ গল চলে যাচ্ছেন। উনি থাকতে থাকতে তোমাকে যদি চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয়া যায় ভাল হয়। নতুন যিনি আসছেন শুনেছি তিনি কড়া ধাতের লোক। তিনি তোমাদের অবস্থাটা বুঝবেন না। তাছাড়া স্কুলটাও বন্ধ আছে অনেক দিন হল। তুমি আর আপত্তি কোরো না। '
সত্যপ্রিয় তখনও পড়াশুনা ছাড়তে নারাজ। মনোময় মুখার্জির মতো হবার ইচ্ছেটা তখনও লালন করে চলেছে বুকের ভেতর। এরই মধ্যে শোনা গেল আর দুদিনের মধ্যে চলে যাবেন গল সাহেব। পরদিন সকালেই বাবুরা অনেকেই দলবেঁধে বাড়িতে এল সুখলালবাবুর সাথে। তাদের পাঠিয়েছিলেন বড়বাবু শ্রীনাথবন্ধু বোস। তারা এসে একসাথে সত্যপ্রিয়কে বোঝাতে লাগলেন। সকলের চাপে হার মানতে হল সত্যপ্রিয়কে। অনিচ্ছা সত্বেও রাজি হতে হল।
সকাল সাড়ে নটা নাগাদ বড়বাবু শ্রীনাথবন্ধু বাড়িতে ব্রেকফাস্টে যাওয়ার পথে সোজা চলে এসেছিলেন কুমুদ মাস্টারের বাসায়। এসে বাইরে থেকে সুখলালবাবুকে ডাক দিয়ে বললেন, ' সুখ'দা,খবর কী। ও রাজি হল ...?
সুখলাল বাবু ঘর থেকে বেরিয়ে জানালেন সত্যপ্রিয় রাজি হয়েছে অবশেষে। শুনে তিনি নির্দেশ দিলেন, ' তাহলে তো হয়েই গেল। টাইপ বাবুকে ডাকুন তো, আমি বলে দিচ্ছি কী করতে হবে। '
টাইপ বাবুকে ডাকা হল। শ্রীনাথবন্ধু তাকে বললেন, 'আপনি এক কাজ করুন, চটপট ওর বায়োডাটা জেনে নিয়ে টাইপ করে আমার টেবিলে রেখে আসুন। টিফিন সেরে গিয়ে আমি দেখে নিচ্ছি। আজই এ বেলায় ওটা বড়সায়েবকে দিতে হবে। '
পরদিন সত্যপ্রিয়কে ডাকা হল অফিসে। শ্রীনাথবাবু তাকে নিয়ে গেলেন ম্যানেজারের চেম্বারে। মিঃ গল দু চারটে প্রশ্ন করলেন তাকে। খানিক বাদে সত্যপ্রিয়র হাতে নিয়োগপত্র ধরিয়ে দেয়া হল। সত্যপ্রিয় কুমুদরঞ্জনের স্থলাভিষিক্ত হল কাজলিডাঙা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। তাকে বলা হল কদিনের মধ্যে ডি. আই অফিসে গিয়ে চিঠিটা জমা দিয়ে সরকারি নিয়োগপত্র নিয়ে আসতে।
চাকরি পেলেও মনে এক অদ্ভুত রিক্ততা নিয়ে ফিরে এসেছিল সেদিন সত্যপ্রিয়। ছাত্রজীবন এমন আকস্মিকভাবে থেমে যাওয়াটা মন থেকে মেনে নিতে বড় কষ্ট হচ্ছিল তার। সুনয়নী যেন বুঝতে পেরেছিলেন ছেলের মনোভাব। তাই তিনি সংযত রেখেছিলেন নিজেকে। সংসারে উপার্জন ফিরে আসার আনন্দ প্রকাশ করেননি তিনি বিন্দুমাত্র। আর হঠাৎ করে জীবনের নতুন বাঁকে এসে নিজেকে ধাতস্থ করে নিতে অনেকটা সময় লেগে যায় সত্যপ্রিয়র।