আমি এক যাযাবর-১৫/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
(পঞ্চদশ পর্ব)
শৌভিক কুন্ডা
দু'দিন ধরেই খেয়াল করলাম, এখানে বিকেল নামে একটু আগে, আমার শহরের তুলনায়। বাতাস, চারপাশ, এরাও অতএব নরম হয়ে আসে। আলোও। আর সে নেভা নেভা আলোয় এই ঢালু, ক্রমশ ছড়িয়ে যাওয়া জমিন কেমন যেন মায়ায় ভরে ওঠে!
সবুজের নানা রকম এখানে। আর শেষ বেলার সূর্য সেই শেডগুলোতে আরও আরও প্রাণ মিশিয়ে দেয়।
আগের দিন জানিয়েছিলাম, এ চত্বরে ফুলগাছের তুলনায় ফলের গাছ অনেক অনেক বেশি। সঞ্জীব জানালো এর কারণ। জ্যোতি বাবু, এই সম্পত্তির প্রথম অধিনায়ক, পাখি ভালোবাসতেন। তাই, জমি হাতে পাওয়ার পর তাঁর প্রথম কাজ ছিলো এই প্রসারটিকে ফলের গাছে ভরিয়ে দেওয়া। পাখিরা আসবে ফল খাওয়ার জন্য! সেইমতো এই বক্সা ভ্যালি হোম স্টে'র জমিন জুড়ে আম, নিম, সুপুরি, ডুমুর, পেয়ারা আরও অনেক অনেক ফলের গাছ। আমি যে কটেজটাতে ছিলাম, তার মাথাতে ছাতা ধরে ছিলো প্রাচীন এক যজ্ঞডুমুর। বিকেল একেবারে নিভে এলে, সাঁ সাঁ শব্দ তুলে ঝাঁক বেঁধে হর্ণবিলরা আসে। যজ্ঞডুমুর গাছটার ডালে ডালে বিশ্রাম তাদের। ফল ঠুকরে খায়। ঠোঁট ফসকে, কখনো বা বাতাসের জোর বাড়লে ফলগুলো টিনের চালের ওপর টপ টপ শব্দ করে ঝরতে থাকে। আগেই বলেছি এ দু'দিন এই বিরাট ক্যাম্পাসে সঞ্জীব ছাড়া আর মানুষ কেবল আমিই, তাই অকিঞ্চিৎকর সে শব্দও ব্যাপ্ত নৈ:শব্দকে চমকে দেয়, টুকরো টুকরো করে ফেলে মাঝেমধ্যেই।
সঞ্জীব এমনিতে খুব বেশি কথা বলে না। কিন্তু মনের মতো মানুষ জুটলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতে পারে ভালোই। সেভাবেই জানতে পারি, ও জন্মসূত্রে বিহারের, আগে থাকতো আসামে। এখন এই হোমস্টের দায়িত্ব নিয়েই বহুকাল। সপ্তাহে একদিন, রাজাভাতখাওয়াতে যায়, হাট বুধবার সেখানে। ঐ দিন সঞ্জীবের ছুটি। সংসার আছে রাজাভাতখাওয়াতেই। ওর বৌ ওখানকার 'টিকিটঘর'এর সামনে হাতের কাজের পসরা নিয়ে বসে। এইসব টুকিটাকি জানকারি হয়। আমিও এ তল্লাটে নূতন নই। পুরনো মানুষদের কথা হয়। তাদের অনেককেই চেনে সঞ্জীব। দ্বিতীয় সন্ধ্যেয় ওর ডাকে দরজা খুলে দেখি সাথে আরও একজন দাঁড়িয়ে। মিটমিট করে হাসছে। সঞ্জীব বলে, "পল্টুকাকার কথা বলছিলেন স্যার, এই যে দেখেন, ধরে আনলাম! এখন তো পাশের রিসর্টেই কাজ করে।" ২৮ মাইলের বক্সা ওয়াইল্ড হোমে কাজ করতো পল্টু। বহুবার গেছি সেখানে। অসাধারণ বললেও কম বলা হবে পল্টুর রান্নার হাতকে। অনেকদিন পর দেখা হ'ল। বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা হ'ল তিনজনায়।
সঞ্জীবকে বলাই ছিলো, রোদ নিভে এলে সান্ত্রাঁবাড়ি যাবো। খুব বেশি দূর নয় হোমস্টে থেকে। চা খেয়ে দু জনে হাঁটা শুরু করলাম। সান্ত্রাঁবাড়ি মোড় সীজনে জমজমাট থাকে। এখন ট্যুরিস্ট তেমন নেই। তাই একেবারেই ফাঁকা । মোমো খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু সঞ্জীব আবার ফিরে গিয়ে থুকপা খাওয়াবে বলেছে। অতএব কেবল 'নমক-চায়'! বসে থাকতে থাকতেই স্থানীয় মানুষের একটি দল এলো। জোরজারি নয়, বিনীতভাবে চাঁদা চাইল। আগামীকাল পাহাড়ের মাথায় ডিমাকুঁয়া'তে পুজো হবে। বৃষ্টি আনার পুজো! সরল মানুষের সরল বিশ্বাস।
ফেরার পথে সঞ্জীবকে বলি, "এই যে এত বড়ো চত্বরে দিনের পর দিন একা থাকো, অসুবিধে হয় না?" ঘাড় নাড়িয়ে জবাব দেয়, "না স্যার, আমার উল্টা এইটাই ভালো লাগে! ভীড় যত কম হয়, ততই ভালো। শান্তি লাগে। গাছপালা গুলারও বিরক্তি কম হয়!" তারপর কি মনে পড়ে ওর, একটু চুপ করে থেকে বলে ফের, "কিন্তু আপনে আসবেন, স্যার। বর্ষায় আসেন না! দেখবেন সব কেমন সবুজ, ঝকঝক করতে থাকে!"
রাতে সত্যিই বৃষ্টি নামে। টিনের চালে রিমঝিম ঝমঝম। দুটো একটা পাখি ডেকে ওঠে। কাল রাজাভাতখাওয়ায় যাবো। অনেক দিন পর তারা দাজুর সাথে দেখা হবে।
(চলবে)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴