ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-১৪/মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১৪)
মৈনাক ভট্টাচার্য
----------------------------------
সোমনাথ হোরের ব্রোঞ্জঃ ভিয়েতনামের মা
তখন সত্তরের মাঝ দশক। বাংলায় বিপর্যস্ত নকশাল আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের রাজৈনৈতিক বাতাসে তবু তখন জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত কিংবা হরেকৃষ্ণ কোঙারদের ঘিরে মিষ্টি এক কমিউনিস্ট হাওয়া। সেই হাওয়ায় কান পাতলে তখন চারিদিকে শ্লোগান শোনা যেত-‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম’। বিশ্বায়নের কমিউনিস্টরা ভিয়েতনাম যুদ্ধ বীজয় থেকে মুক্তিঘ্রাণ খুঁজে পাচ্ছে। ব্যর্থ নকশাল আন্দোলন অথবা বাংলার মেধাবী এক প্রজন্ম শেষ হয়ে যাওয়া তখন অতীত। আশাবাদী বাঙালি মুক্তি খুঁজে পেতে চায় ভিয়েতনামের জয়ের ভেতর দিয়েই। আমাদের মত অনেক শহুরে শৈশব সেই সময়ে বাংলার দেওয়াল স্লোগানে মুক্তিসূর্যের প্রতিরূপ হো চি মিনকে বাঙালিই ভেবে বসেছিল। শিল্প সাহিত্যে যে এর প্রভাব পড়বে সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কবি সামসুর রহমান লিখে ফেলেছেন-
...গোল বাধাল কারা?
বর্গি নাকি তারা?
কিংবা ...
বাজপাখিরা জেনো
পণ করেছে যেন
ঝাপটা মেরে জোরে
তেড়ে এসে ওরে
ডানে কিংবা বাঁয়ে
তীক্ষ্ম নখের ঘায়ে
উপড়ে নেবে গ্রাম,
পুড়ছে ভিয়েতনাম।
‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’ এ কবি নবারুন ভট্টাচার্য লিখলেন নবারুনিয় ঢং-এ
... কিছু কিছু শব্দ উন্মাদ ও কালা হয়ে গেছে
কোনো কোনো শব্দকে হাত বেঁধে
হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে
অথচ এই শব্দগুলোকে সাজাতে না পারলে
ভিয়েতনামের কবিতা হবে না
শব্দ আমার কাছে চুইংগাম
মৃত বুদ্ধিজীবীর টেলিফোন নম্বর
মনোপলি দৈনিকের অশিক্ষিত
সম্পাদককে খুশি করার পাসপোর্ট বা প্রসাধন নয়
শব্দগুলোকে আমি গ্রেনেডের মতো
সাম্রাজ্যবাদী ক্যাবারের মধ্যে ছুড়ে দিতে চাই
শব্দগুলোকে আমি
রাস্তার বাচ্চাদের মধ্যে
আপেল আর বিস্কুটের মতো বিলিয়ে দিতে পারি
কিন্তু শব্দগুলো আমার হাতে চেটোর মধ্যে ফেটে যাচ্ছে
আমি লিখতে পারছি না...
সোমনাথ হোর কমিউমিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী একজন শিল্পী। নিজেও তিঁনি ভিয়েতনাম সংগ্রামের সাথে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন একজন পার্টি কমরেড হিসেবে। এমন কি এই আন্দোলনে একবার গুলিবিদ্ধও হতে পারতেন। তাঁর শিল্প ভাবনায় ভিয়েতনাম নাড়া দেবেনা তাই বা কি করে হয়। সোমনাথের ভাষায়-“যখন ভিয়েতনামের যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমাদের দেশের বুর্জোয়া সংবাদপত্র গুলো আগা গোড়াই ভবিষ্যৎবাণী করেছে ভিয়েতনাম কিছুতেই আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকতে পারবে না। আমাদের কিন্তু ধারণা ছিল ভিয়েতনাম জিতবেই। কেননা এই রকম লড়াকু একটা জাতকে কেউ হারাতে পারে না। সত্যিই শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ এ তাই ঘটলো। আমার মনে হল, আমি এই ভিয়েতনাম আন্দোলনের উপর একটা কাজ করব। আসলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেকদিন আগে থেকেই কাজটার কথা মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম। তার জন্য বেশ কিছু ছোট ছোট স্কেচও করেছিলাম। আমেরিকার পরাজয়ের সাথে সাথে মনে একটা আলাদা জোড় পেলাম। কলকাতা থেকে কিছু জিনিসপত্র এনে আরম্ভ করে দিলাম কাজটা।” ভিয়েতনাম জয়ের এই আনন্দে ১৯৭৫-এই শিল্পী শুরু করলেন একটা কাজ। এক ভিয়েতনামি মায়ের পেট বোমায় ক্ষত বিক্ষত। উড়ে গিয়েছে মায়ের শরীরের উপরের অংশ। এই মাতৃরূপে কোনও লালিত্য নেই, মাধুর্য নেই। তবু মায়ের বুকে আছড়ে পড়েছে এক শিশু। সেই শিশু হয়ত জানে না মায়ের এই ক্ষতের কথা। কিন্তু এত কিছুর ভেতরেও সন্তান হাত উঁচু করে আছে। এ যেন রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত এক প্রজন্মের ভেতর থেকেও আর এক প্রজন্ম হাত উঁচু করে জয়ের স্বপ্নকে আবাহন করছে, এ যেন ভিয়েতনামেরই জীবন থেকে উঠে আসা এক টুকরো বাস্তবতা। এর সাংঘাতিক প্রভাব দর্শকের গভীরেও ছাপ ফেলতো কোন সন্দেহ নেই। সোমনাথ তো এমনই বিশ্বাস করতেন -শিল্প যদি একেবারে জীবন থেকে উঠে না আসে তাহলে তা যে শৌখিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সে যাই হোক কাজটা শেষ করতে বছর দুই লেগে গেল। শেষ করলেন ১৯৭৭এর ৩রা নভেম্বর। নাম দিলেন- ‘ভিয়েতনামের মা’। শিল্পী সোমনাথ হোর এবং ভিয়েতনাম এই দুই নামের মোহ জড়িয়ে থাকা ১৯৭৭এ শিশু চুরির মত কলঙ্কিত অপরাধের আর এক আধার হয়ে রয়ে গেল এই কাজের ইতিহাস। কাজটা সেই রাতেই চুরি হয়ে গেল। সন্তান হারানোর মত শোকে ভেঙ্গে পড়লেন শিল্পী। এই কাজ চুরির ব্যাপারে নাম জড়িয়ে গেল তাঁর এমন কিছু স্নেহভাজনের যা তিঁনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তাই এই চুরির ব্যাপারে কোন রকম থানা পুলিশও করলেন না। কিন্তু পুলিশ ডায়েরি করা হল কলা ভবনের পক্ষ থেকেই। পুলিশ অপরাধীকে ধরেও ফেললেন। এরপর বিশ্বভারতীর ঊর্ধতন কতৃপক্ষের তরফ থেকে হয়ত কোন রকম প্রভাব বিস্তার হওয়ায় ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া হল। শিল্পী মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না। কেননা কিছু কাজের প্রতি শিল্পীর বাড়তি স্নেহ, অপত্য সন্তান স্নেহের চেয়েও বেশি হয়ে ধরা দেয় যখন কাজটার ভেতরে থাকে একটা স্বতঃস্ফুর্ততা। এই কাজটায় ছিল শিল্পীর অন্য রকম এক আবেগ। ‘ভিয়েতনামের মা’ তাঁর কাছে তাই ছিল শুধু একটা কাজ নয়, একটা দায়বদ্ধতা। সেই সময় এখনকার মত হাতে হাতে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর রেওয়াজ না থকলেও রক্ষে, শিল্পীর স্নেহভাজন কেউ একজন অতি আবেগে কাজ শেষ হতেই ছবি নিয়ে রেখেছিলেন। তাই কাজ হারালেও দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত ছবি দেখে আমাদের আশ সামান্য হলেও অন্তত মেটে এই ছবিতে।
এই শিল্প চুরির ব্যাপারে ইচ্ছে করলেই শেষ দেখে ছাড়তে পারতেন শিল্পী। কেননা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ছিলেন তাঁর একদা আন্দোলনের সহযোদ্ধা। জ্যোতিবাবুরও এই কমরেড শিল্পীর প্রতি বরাবরই ছিল অতি দূর্বলতা। এই শিল্প চুরি যাওয়ার ব্যাপারটা যদিও শিল্পীর কাছে শুনেও ছিলেন জ্যোতিবাবু। হয়ত শান্তিনিকেতনের সম্মানার্থে কোন পক্ষকেই অতিরঞ্জিত করতে চাননি। ছেড়ে দিয়েছিলেন পুলিসের উপর।
কাজটি চুরি যাওয়ায় শিল্পী সোমনাথ এতটাই শোকাহত হয়েছিলেন যে প্রায় ৭-৮ বছর ভাস্কর্য সৃষ্টি করাই ছেড়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু যে শিল্পীর সৃষ্টির বিষয় হয়ে ওঠে অ্যাবস্ট্রাকশন বা বিমূ্র্তকরণের অত্যন্ত কঠিন এক বিষয় ‘উন্ডস’ বা ‘ক্ষত’ নামের সিরিজ, যেখানে জীবনের মূলমন্ত্র শিল্পীর ভাবনায় ধরা দেয় মানবিকতার সামনে মানুষের স্বাধীনসত্তার এক চরম বিপর্যয় হিসেবে। শিল্পী যখন নিজেই বলেন-“কিছু কথা আমি কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় বলি না, কিছু কাজ আমি নিজের ইচ্ছেয় করি না। সেগুলি আমার ভিতরের এক গুপ্ত জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে, যা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’’ সেই শিল্পী হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন কিভাবে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে তাঁর একটার পর একটা প্রিয়জনের মৃত্যু যেমন কবির শোক ছাপিয়ে সৃষ্টিকে অমর করে রেখেছে। সেই শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় সোমনাথ সৃষ্টহীন ভাবে বসে থাকবেন কেমন করে। তাই তাঁর সৃষ্টি আবার নিজের গতিতেই প্রবাহিত হতে থাকে, আবার বয়ে চলতে থাকে জীবন দর্শনের ‘ক্ষত’র মতো এক ক্ষতের ভেতর দিয়েই......।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴