বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-১৪/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং
পর্ব-১৪
ড. রূপন সরকার
দার্জিলিং শহরের পরিকাঠামো বৃৃদ্ধি তথা পরিষেবা প্রদানে যে প্রতিষ্ঠাটি সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল সেটি ছিল দার্জিলিং পৌরসভা। এই দার্জিলিং পৌরসভা ভূমিষ্ঠ হয় ১৯৫০ সালের জুলাই মাসে। এটিই ছিল বর্তমান উত্তরবঙ্গের প্রথম পৌরপ্রতিষ্ঠান এবং শিমলার পর দ্বিতীয় পার্বত্য পৌরসভা। প্রথমদিকে পাঙ্খাবাড়ির নিচ থেকে উত্তরে সিকিম সীমান্ত পর্যন্ত মোট ১৩৯ স্কয়ার মাইল এলাকা নিয়ে পৌর এলাকা গঠিত হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তীতে পৌরসভার সীমারেখা ছোট করে শহরের মাত্র ৮.৮৫ স্কয়ার মাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়। এই সীমারেখা তৈরি হয় দক্ষিণে জোড়বাংলো, উত্তরে সেন্ট জোসেফ কলেজ, আর পূর্বে কোলকাতা রোড থেকে শুরু করে চৌরাস্তা, ভুটিয়া বস্তির পশ্চিম দিক দিয়ে সেন্ট জোসেফ কলেজ পর্যন্ত। প্রথমদিকে ডেপুটি কমিশনারকে চেয়ারম্যান করে ২৫ জন সদস্য নিয়ে পৌরসভা গঠিত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সরকারি ও বেসরকারি সকল সদস্যই সরকার দ্বারা মনোনীত হতো। পরাধীন ভারতে স্বাভাবিকভাবেই পৌরসভায় ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। বেসরকারি মনোনীত প্রতিনিধিদের মধ্যেও বেশিরভাগই ইউরোপীয় নাগরিক ছিল। পরবর্তীতে কিছু ভারতীয় প্রতিনিধি মনোনীত করা হয়। ১৯১৬ সাল থেকে সদস্য মনোনয়নের বদলে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮৩২ সালের পৌর আইন অনুসারে দার্জিলিং পৌরসভার মোট ২৮ জন সদস্যের মধ্যে ২১ জন নির্বাচিত হয়ে আসতেন এবং ৭ জন ছিলেন সরকার দ্বারা মনোনীত সদস্য। এই ৭ জনের মধ্যে ৩ জন হতেন সরকারি আধিকারিক। সদস্যরা নিজেরা ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতেন আর ডেপুটি কমিশনার পদাধিকারবলে পৌরসভার চেয়ারম্যান হতেন। ১৯৪০-৪১ সালে পৌরসভার সদস্যদের মধ্যে ৮ জন ছিলেন ইউরোপীয় নাগরিক। স্বাভাবিকভাবেই ঔপনিবেশিক সময়কালে পৌর প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতীয় সদস্যদের খুব একটা ভূমিকা থাকতো না।
তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পৌরসভা তার সীমারেখার মধ্যে পৌর পরিষেবা পৌছে দেওয়া ও শহরকে যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন রাখার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর ছিল। কারণ ভ্রমণকারিদের আকর্ষণের কেন্দ্র যেমন ছিল দার্জিলিং শহর, তেমনি শহরে ইউরোপীয় নাগরিকদের বসবাস পৌরসভাকে দায়িত্বপূর্ণ করেছিল। পৌরসভার দায়িত্ব বৃৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে পৌর এলাকাকে ওয়ার্ডে ভাগ করা হয় এবং পরিবর্তীতে একটি নতুন ওয়ার্ড যুক্ত করা হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডের সমস্যা বোঝার জন্য সদস্যদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হয়। কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ওয়ার্ডের সমস্যা নিয়ে পৌরসভার মিটিংয়ে আলোচনা চলতো। ওয়ার্ড কমিটি ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের পরামর্শ দানের জন্য আলাদা আলাদা কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। এই কমিটিগুলি বিভিন্ন বিভাগে পরামর্শ প্রদান করতো। যেমন এসেসমেন্ট, অডিট এন্ড ফিনান্স কমিটি, লিগাল, এক্সেকিউটিভ এন্ড ওয়ার্ক সাব কমিটি, সেনিটেশন এন্ড কনজার্ভেশন সাব কমিটি, হসপিটাল এন্ড ডিসপেনসারি কমিটি, এই কমিটিগুলি নির্দিষ্ট বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি নিয়ে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পৌরসভার মিটিংয়ে উত্থাপন করতো। এই সমস্ত সিদ্ধান্ত ও পরামর্শকে বাস্তবরূপ দান করার জন্য পৌরসভার নিজস্ব পরিকাঠামো ছিল।
১৮৬৫ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দার্জিলিং পৌরসভার মিউনিসিপাল এস্টাব্লিশমেন্টের একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার তথা অফিস সেক্রেটারি (মোট বেতন বাবদ খরচ ৩০০ টাকা) ছাড়াও একজন মিউনিসিপাল রাইটার (মোট বেতন বাবদ খরচ ৩০ টাকা), দুজন পিওন (১৪ টাকা), একজন ড্রাফটি (৩ টাকা), দুজন দোভাষী (১৫ টাকা), একজন মুন্সি (১০ টাকা), একজন কালেকটিং পিওন (১২টাকা) নিয়ে মোট ৯ জন কর্মচারী ছিল। পৌরপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার মতো বাজার প্রশাসনের জন্যও পৌরসভার নিজস্ব কর্মচারী ছিল। এরা ছিলেন একজন চাপরাশি (৬টাকা), তিনজন চৌকিদার (১৫ টাকা), ৮ জন সুইপার (৪৮ টাকা) এবং দেশীয় বসতিযুক্ত এলাকার জন্য চার জন সুইপার (২৪ টাকা) নিয়ে মোট ১৬ জন কর্মচারী ছিল। রাস্তার কাজ তদারকির জন্য তিনজন ওভারসীয়ার (৯০ টাকা), দশজন চাপরাশি (৭০ টাকা), একজন জমাদার (১২ টাকা), একজন সিরদার (৮ টাকা) নিয়ে মোট ১৫ জন কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। পাঙ্খাবাড়ি এস্টাব্লিশমেন্টের জন্য ট্রানজিট এজেন্ট (৪০ টাকা), একজন গোডাউন চাপরাশি (৬ টাকা), একজন বাজার চাপরাশি (৬ টাকা), চারজন সুইপার সহ ছয় জন কর্মচারী ছিল। পৌর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড়দশকের মধ্যে দার্জিলিং পৌরসভার এক দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করতে পেরেছিল।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴