বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।। চোদ্দ।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^
চা-বাগানে ছায়াগাছের (Shade Tree) প্রয়োজন বা উপকারিতা অনেক।
চা-গাছের
পাতার তাপমাত্রা ঠিক মাত্রায় (৩৫ ডিগ্রীর নীচে) রেখে গাছকে যতটা বেশী
সম্ভব খাদ্য তৈরিতে সাহায্য করার কথা আগেই বলা হয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত রোদে
চা-গাছকে পুড়ে যাবার হাত থেকে বাঁচায়। সূর্যের আলোতে যে অতিবেগুনী রশ্মি
আছে তা চাগাছের ওপরে পড়ার হাত থেকেও কিছুটা বাঁচায়। এরা মাটির আর্দ্রতা
(ভেজা ভাব) উবে যাওয়া রক্ষা করে। আবার বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা সরাসারি মাটিতে
পড়া ঠেকায় – তাতে মাটি গুঁড়ো হয়ে ভূমিক্ষয় কম হয়।লিগুমিনাস জাতীয় ছায়াগাছের
ফল এবং ঝরে পড়া পাতা মাটিকে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ করে। ফলে মাটির উর্বরা
শক্তি বাড়ে, গাছে পাতা বেশী আসে।
আগে বীজ থেকে
চা-চারা তৈরি হত। ফলে গাছের একটা প্রধানমূল (Taproot) থাকত যা মাটির গভীরে
গিয়ে খাদ্য জোগাড় করতে পারত। এখন মূলতঃ কলমের চারা – এদের প্রধানমূল থাকে
না; পেঁয়াজ-রসুনের মত গুচ্ছমূল (fibrous root) সব - তারা মাটির ওপরের
স্তরেই থাকে।
ছায়াগাছ মাটির গভীরের খাদ্যকণাকে মাটির ওপরের স্তরে টেনে আনে – যা চাগাছের পক্ষে সুবিধাজনক।
ছায়াগাছের
তলার চাগাছে সাধারণ পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়। শিলাবৃষ্টিতে শিল সরাসরি
চাগাছের গায়ে পড়লে তার বাকল ফেটে গাছের বড় ক্ষতি হয়।তা ঠিক করার গাছ ব্যস্ত
হয়ে পড়ে; ফলে পাতার জোগান দেওয়া কমে যায়। ছায়াগাছ সেই শিলপড়া অনেকটা
ঠেকায়। অনেক সময় ছায়াগাছ ‘উইন্ডব্রেকার’-এর কাজও করে। এরা চা-বাগানের ভিতর
একটা ছোটমাপের-জলবায়ু (micro-climate)তৈরি করে যা চাগাছকে ভালভাবে বাড়তে
সাহায্য করে; ফলে পাতা বাড়ে; এসব কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা যায় না।এছাড়া কাজের
সময় চা-শ্রমিকদের মাথার ওপর ছায়া-ছাতা ধরে কিছু স্নেহও তো দেয় তারা...
তবে ছায়াগাছের কিছু খারাপ দিকও আছে।
তারা যেমন সাধারণ পোকামাকড়ের হাত থেকে চা-গাছকে রক্ষা করে অনেকটাই তেমনি আবার কিছু কিছু গাছ ক্ষতিকর কিছু বিশেষ পোকাকে আশ্রয় দেয়।
চা-চারা
মাটিতে পোঁতার পর পাঁচ বছর লাগে তার বড় হয়ে উঠতে। এসময়টা তাদের ছোটবেলা
(Young Tea)। সে সময়ে মাটির আর্দ্রতা ও অনুখাদ্যের ব্যাপারে ছায়াগাছ ছোট
চাগাছের প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে ওঠে।
তাই,
চা-চারা মাটিতে দেবার পর প্রথমে *র্যাটেলপড* (Rattlepod) জাতীয় ছোট গাছ,
যেমন আমাদের ঝুমঝুমি বা অতসী, লাগানো হয় চারার পাশ দিয়ে –সারি করে। এতে
ছায়ার কাজ যেমন হয় তেমনি তার ডাল-পাতা-বীজ থেকে মাটির নাইট্রজেন বাড়ে। এরপর
স্থায়ী (permanent) ও আধা-স্থায়ী (semi-permanent)গাছ একসঙ্গে লাগানো হয়।
আধা-স্থায়ী গাছ, যেমন ঘোড়া নিম, দ্রুত বেড়ে উঠে ‘ক্যানোপি’ (canopy) তৈরি
করে চাগাছকে ছায়া দেয়। ওদিকে স্থায়ী গাছ ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। তখন
আধা-স্থায়ী গাছগুলো কেটে বাগানের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
যে
বছর চা-চারা মাটিতে দেওয়ার পর, শিকড় মাটিতে লেগে গেলে, চারার মূল কান্ডটা
ছেঁটে বা ভেঙে ফেলা হয়। একে বলে ‘সেন্টার আউট বা থাম্ব প্রুনিং (Thumb
pruning)’।কখনও গাছের অগ্রমুকুল (terminal bud) কেটে নেওয়া হয়
(de-budding)। এরফলে কাটা জায়গার নীচে থেকে ডাল (সাধারণত তিনটে) বার হয়।
কিছুদিন পর আবার সে ডালগুলোকেও ওপর দিক থেকে ছেঁটে ফেলা হয়। এইভাবে
চার-পাঁচ বার মূল ডালগুলো ছেঁটে ছেঁটে ডালের সংখ্যা তিন,নয়,সাতাশ করে
বাড়ানো হয়- যাতে পাঁচ বছরের মধ্যে গাছটা বড় হতে হতে চারিদিকে গোল হয়ে ছড়িয়ে
পড়ে। একে বলা হয় ‘ গাছের গড়ন তৈরি করা’ (Frame Formation)। যত ডাল তত গড়ন
ভালো - তত পাতা বেশী।
এই
পাঁচ বছরে কিন্তু চারাগাছ থেকেও চা-পাতা তোলা হয় -তবে অল্প অল্প করে। পাঁচ
বছর পর পূর্ণতাপ্রাপ্ত (matured) গাছ।সে গাছ একশ বছরেরও বেশী পাতা দিতে
পারে। তবে, আগেই বলা হয়েছে, বীজের গাছ হলে ষাট বছর আর কলমের গাছ হলে চল্লিশ
বছর পর্যন্ত তার ইকোনোমিক বা কমার্শিয়াল ভায়াবিলিটি ধরা হয়।
চা
গাছের গায়ে নানারকম ছত্রাক এবং পোকামাকড় লাগে। তাদের কেউ গাছের কান্ড,ডাল
ফুটো করে গাছকে দুর্বল করে দেয়। কিছু পোকামাকড় কচি পাতা বা পাতার রস খেয়ে
পাতাকে নষ্ট করে দেয়- যেমন ‘চায়ের মশা (Helopeltis)’, ‘থ্রিপ্স (Thrips)’
ইত্যাদি; কেউ সব পাতা খেয়ে গাছকে ঝাঁঝরা করে দেয়, যেমন ‘লুপার (Looper)’
শুঁয়োপোকা।আবার গাছের অনুখাদ্যে জরুরী ধাতু ও রাসায়নিক যৌগের অভাব হলে
(যেমন বোরন, কোবাল্ট, তামা, লোহা,ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম, জিঙ্ক ইত্যাদি)
পাতার নানা অসুখ দেখা দেয়- পাতা হলদেটে হয়ে যায়, কুঁকড়ে যায়, পাত অপুষ্ট
হয়ে যায়। তাই মাটিতে সার ও গাছে-পাতায় স্প্রে করে এসব অনুখাদ্য গাছকে
জুগিয়ে দিতে হয়।
পোকামাকড়
ছাড়া আর সবচেয়ে বড় উপদ্রব আগাছা। গাছের গোড়ায় ঘাস ও অন্যান্য আগাছা জন্মায়
যা গাছের খাদ্য খেয়ে নেয়। সঙ্গে, সময় মত যত্ন না নিলে, সেসব আগাছা গোটা চা
গাছকেই জড়িয়ে-মড়িয়ে গাছের দম বন্ধ করে দেয়, যেমন ‘থ্যাত্থর লতা’ (বাগানিয়া
ভাষা) বা জাপানী লতা (Mikania micrantha) – খুব দ্রুত বাড়ার জন্য (২৪
ঘন্টায় ৩.১ থেকে ৩.৫ ইঞ্চি) যার আরেকটা নাম mile-a-minute vine। বন্ধ
চা-বাগানে প্রায়ই দ্যাখা যায় চা-গাছগুলো জড়িয়ে এরা প্রায় গোটা বাগানকেই
ঢেকে ফেলেছে।
রোগ-ভোগও অনেক রকম:
ব্লিস্টার ব্লাইট (Blister Blight)- ছত্রাক থেকে হয়; কচি পাতাগুলোতে হালকা বাদামী রঙের ফোস্কা পড়ে।
ডাই
ব্যাক ও ক্যাঙ্কার – পাতাগুলো হঠাৎ হলদেটে হয়ে মিইয়ে যেতে থাকে; গাছের
ডালের গা ডেবে গিয়ে গর্ত গর্ত হতে থাকে ((cankers)। ক্যাঙ্কারের ওপরের অংশ
সতেজতা হারিয়ে শুকিয়ে যায়।গরমকালে বেশী হয়। এটাও ছত্রাকের কারণে।
এছাড়া আছে ফ্লাওয়ার ব্লাইট, হর্স হেয়ার ব্লাইট, রুট রট (root rot) ইত্যাদি আরও হরেক রকমের রোগ-ভোগ।
------------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া