বাংড়ি তিতি ও হাউড়ি শেষে
পর্ব-১৪
মিশা ঘোষাল
************
টোটোপাড়া যেতে :
সে এক চোরাবালির পথে (২)
টোটোপাড়া
থেকে ফিরতি পথে যখন তিতি পেরিয়ে আমরা নদী রাস্তায় এসে পৌঁছলাম, বাংড়ির
ভাঙাচোরা রাস্তা তখন একটি বিপজ্জনক চেহারা নিয়েছে। বাংড়ির সেই খাড়া পথকে
বাইপাস করে নদীপথেই নেমে আসছিলাম আমরা টোটোপাড়া থেকে। তখন বিকেলের আলো
ম্লান হয়ে এসেছিল। ঝিরঝির বৃষ্টির ছাট আর উথালপাতাল বাতাসে ছিল বন্দী
আমাদের সফর। তিতি নদীর রাস্তায় জমেছিল ছিল অল্প অল্প জল। ছোট ছোট স্রোতধারা
তিরতিরিয়ে ছুটছিল তখন সেই পথ দিয়ে। কিছুটা মুজনাই আর কিছুটা জল তোর্ষা
নদীতে মিশবে বলে। উত্তরের জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের দিকে নদী-নদী হয়ে আমাদের
গাড়ি অনেকটাই চলে এসেছিল সেদিন।
হঠাৎ ঐ বিশালাকার
কালো কুচকুচে বাইসনকে দেখতে পেয়ে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে গিয়েই হয়েছিল যত
বিপত্তি! সামনে বাইসন আর আমাদের আটকে থাকা গাড়ির চাকা ঢুকে যাচ্ছে
চোরাবালির গভীরে!
এ এক গভীর সঙ্কটময় মুহূর্ত ছিল তখন!
বৃষ্টির তীর্যক ছাট আমাদের গাড়ির জানালা দিয়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল আমাদের!
আমাদের
নিয়ে ভিড়ে ঠাসা গাড়িটি যখন চোরাবালিতে ঢুকে একেবারে গেড়ে বসে গেছে,
বিকেলের আলো তখন ম্লান হয়ে এসেছিল। রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা তখনও চলছিল।
আকাশে ছিল জলদ মেঘের সম্ভার, যা অনবরত বৃষ্টি ভেজা কথা শোনাচ্ছিল... এমনি
সময় হঠাৎ ঐ বিশালাকার বাইসনের দেখা!
গাড়িতে আমরা তখন নিশ্চুপ ও নির্বিকার-
নট নড়ন চড়ন হয়ে বসে থাকলাম! ভয়ে পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবার জোগাড়! তবুও কারো মুখে কোনো কথা নেই! সবাই স্পিকটি নট...
কারণ
চেঁচামেচি করলেই বাইসন তেড়ে আসতে পারে ! তাই ভয়ে জড়সড় হয়ে আমরা গাড়ির
মধ্যেই বসে থাকলাম আর চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে বিপদমুক্তির উপায়ের কথা
ভাবতে লাগলাম । নিশ্চুপে যেন বনদবতাকেই ডাকতে লাগলাম বার বার এই ঘোর বিপদ
থেকে আমাদের উদ্ধার করবার জন্য।
টোটোরা
অরণ্যের পূজারী। সমগ্র প্রকৃতিকেই পূজা করে টোটোরা। ওদের দেবতা তাই
'হিস্পা', 'সেংঞ্জা', 'কালিখোলা' প্রভৃতি। আমিও এই ঘোর অরণ্য ও চোরাবালির
রাস্তায় ওদের মতই বনদেবতাকেই স্মরণ করছি বারবার। আর একমনে আমার
ইষ্টদেবতাকে প্রণাাম জানিয়েছি এরকম বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য। এভাবে টান
টান উত্তেজনা ও ভয়ানক বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির মধ্যে ঈশ্বরের কাছে
বিপদমুক্তির জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আর কিইবা করার থাকতে পারে তখন!
এভাবে
কিছুক্ষণ এই জোড়া-বিপদের মধ্যে থাকার পর দেখা গেল বাইসনটি আস্তে আস্তে
মাথা চাড়া দিয়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকেই ! ভয়ে পা ঠাণ্ডা হবার যোগাড় যখন -
ঠিক তখনই দেখা গেল বাইসনটি আস্তে আস্তে সোজা ইউ-টার্ন নিয়ে নিল, আর সোজা চলে যেতে লাগল জঙ্গলের ভিতর...
যাবার সময় কিছু লতাপাতা, গাছগাছালি টেনে নামিয়ে খেল আর মটমটিয়ে ভাঙল সামনের ডালপালাগুলি...
কিছুক্ষণ
এভাবেই চলল। বনের খাবারদাবার উদরস্ত করে তারপর জিভ দিয়ে চেটে পুটে ঝোরার
জল পান করতে করতে এগিয়ে গেল বাইসনটি। যাবার সময় আরও কিছু লতাপাতা গাছ
থেকে টেনে নামিয়ে নিয়ে সাবাড় করতে করতে ঢুকে পড়ল অরণ্যের গহীনে !
এতক্ষণ
আমাদের দম বন্ধ ভাব আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল। সেইসঙ্গে ছিল এই
অভয়ারণ্যের ভিতরে বুনো একটি জন্তুর কান্ডকারখানা একেবারে সচক্ষে অবলোকন
করার রোমাঞ্চকর অনুভূতি!
বাইসন চলে গেলে সবার মুখে প্রায় একইসঙ্গে কথা ফুটে উঠলো ...
'উরি ব্বাবা'!
'বাঁচলাম!'
ইত্যাদি...
আর এবার যেন আমি একটু বেশি করেই প্রাণভরে প্রশ্বাস টেনে নিলাম !
পিছন থেকে মধু বলে উঠল,
'এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম আমরা, অনেক কৃপা ভগবানের'...
একদম
পিছনের সিঠে সুভাষদা ও আরও দুজন আদিবাসী চা শ্রমিক বসে ছিল আমাদের গাড়িতে।
গাড়িতে বসে থেকেই সুভাষদা বলে উঠল, 'একটু দেখে নিই আগে, ও (বাইসন) কতদূর
গেল! আবার ঘুরে আসে কী না! তারপর গাড়ি থেকে সবাই আমরা নামব।'
কারণ গাড়ি ঠেলার আগে গাড়িটি হালকা করে নিতে হবে। নাহলে এই চোরাই বালি উঠতে দেবে না আমাদের গাড়িটিকে।
পিছন থেকে ঠেলা দিয়ে তারপর চোরাবালি থেকে চাকা তোলার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের।
সুভাষদা
টোটোপাড়ায় ব্যবসা করতে আসা একজন প্রাত্যহিক কর্মী। মরসুমি সবরকম সবজি ও
ফলের ব্যবসা করেতে টোটোপাড়ায় আসেন সুভাষদা রোজ। পাহাড়ি কলা, রাই শাক,
লঙ্কা, লেবু, আদা, এলাচ, সজিনা, কমলালেবু, আনারস ও সুপারির ব্যবসা করতে
প্রতিদিনই প্রায় টোটোপাড়ায় আসেন সুভাষদা । মাঝে মাঝে তাই তিনি আমাদের
স্কুলের গাড়িতে করেই ফিরে যান মাদারিহাটে আমাদের সাথেই।
সুভাষদা বলল, 'ম্যাডাম,আপনি গাড়িতেই বসে থাকেন, আপনার নামার দরকার নেই।
আমরা যা করার করে নেব। আগে পাথর ফেলে বালির রাস্তাটা শক্ত করতে হবে। সেই হনুমানদের মতন!'
মাষ্টারমশাইরা
সবাই অনিচ্ছা সত্বেও ভদ্রলোকের মতো এক এক করে নেমে পড়ল টোটোপাড়ার নদীর
রাস্তায়। পাথর ফেলার কাজে। এক দুটি করে পাথর তুলে ফেলতে লাগল গাড়ির বসে
যাওয়া চাকার সামনে। সুভাষদার সাথে নদীর রাস্তায় বাধ বানাতে লেগে গেল সবাই ।
আমি ও মিঠু গাড়িতেই বসে থাকলাম। কৃষ্ণ কোদাল, বেলচা নিয়ে এগিয়ে গেল রাস্তা
বানাতে। এ যেন এক মহা আড়ম্বরে অরণ্যপথে চলার একটি রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর
চলচ্চিত্রের নির্মাণ!
আমারা মেয়েরা গাড়ি থেকে নামিনি।
মিঠু বলল, 'এই রাস্তায় আজ আমাদের আসাই ভুল হয়েছে। হান্টাপাড়া চা বাগানের
মধ্যে দিয়ে শক্ত বাঁধের রাস্তা ধরে হান্টাপাড়া চৌপথীতে ওঠা যেত! ঐদিক
দিয়ে গেলে গাড়ি ফাঁসত না।'
আমি বললাম, 'আগে বললে না কেন? তাহলে এই চোরাবালির নদীর রাস্তায় গাড়ি নামাত না!'
এইসব
কথার মধ্যেই সুভাষদা দেখি ওনার ব্যাগ থেকে 'দা' বের করে জঙ্গল কাটতে
শুরু করে দিয়েছে। অনেক কাচা-পাকা বুনো কুল ওখানে ফলে আছে ঝোপে ঝাড়ে।
কাঁটাযুক্ত সেই ডালপালাগুলো কেটে কেটে ওই পথেই গাড়ি টেনে তোলার উপায় করছে
ওরা...
সামনে ছিল একটি চালতা গাছ। সবুজ সবুজ চালতার
ফল ধরে গাছের ডালে ঝুলে আছে দেখতে পেলাম ! সুভাষদা দেখি রাস্তা পরিস্কার
করতে করতেই বুনোকুল ও চালতা টপাটপ তুলে ওনার ব্যাগে পুরতে শুরু করল।
এইসব দেখে মিঠু বলে উঠল, 'সুভাষদা, আমাদের জন্যও দুটো চালতা তুলে এনো।'
রাস্তা বানিয়ে এবার জিপের পিছন থেকে ঠেলা মারতে লাগল ছেলেরা সবাই একসাথে...
চিঞ্ছু ওঁরাও বলে একটি ছেলে উঠেছিল আমাদের গাড়িতে সেদিন, ওকে জোর গলায় বলতে শোনা গেল-
'মারো ঠেলা,হেইসা'...
'জোর লাগাকে,হেইসা'...
কৃষ্ণ এবার গাড়িতে উঠে পড়ল, সিটে বসে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে স্টার্ট দিল গাড়ি...