পইলা সাঞ্ঝির কথা/১৪
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ১৪
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
বঙ্কেট
শেষ রাতের হঠাৎ বৃষ্টিটায় ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল। সর্দি তেমন না লাগলেও গলায় একট অস্বস্তি। কান্তেশ্বর আর বাচ্চাগুলো বেরিয়ে যেতেই বসমতী রসবালার বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। একটু তেলানী চা খেতেই হবে। দেখে বাচ্চাসহ একটা বউ উঠোনে বসে গল্প করছে। পাশেই বিমলের মা বসে বঙ্কেট খাচ্ছে। বসমতী একটু ইতস্তত করে বলে,
“সাগাই কুনদিন আইচ্চে কইনা মাই? কোনেক তেলানী চা খাবার আসিলুং যে!"
রসবালা তড়িঘড়ি বলে,
“বইসখেনে দি। করছোং।"
বসমতী বসতে বসতে বলে,
“মুকখান চিনা চিনা নাগেছে। তে কোটেকার সাগাই মাই তুই?"
রসবালা মুখে আশ্চর্যভাব ফুটিয়ে বলে
“চিনিন নাই? হামার মাইন না সকি যে। ইয়াক না তুই দেকিছিত দি! মাইর সতে।"
বসমতী ভালো করে তাকায়। সস্তার একটা চকচকে সিন্থেটিক শাড়ি পরনে, যেটাকে সবাই উলি শাড়ি বলে। মলিন চেহারা। অযত্নে ফর্সা গাত্র বর্ণ তামাটে। হ্যাঁ, এবার চিনতে পারে। এর নামও সুশীলা। মুহূর্তে একটি হাসিখুশি প্রাণচঞ্চল কিশোরী মুখ ভেসে উঠল মনে। রসবালা বলে,
“ইয়ার আগোত বিয়াও হইসে, ফিরা বছর হামার মাইর। হামার মাইর যে অংটা কোনেক কালা আছিল, ঘর বর বনিতে খানেক সোমায় নাইগসে।"
বসমতী মাথা নাড়ে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
“ছাওয়া কয়টা মাই তোর?"
মেয়েটি একটু হেসে উত্তর দেয়,
“ এই দুকিনায় পিসাই। বড়টা মাই আর বাচ্চাটা বাউ।"
বসমতী দেখে মেয়েটা মায়ের মতোই সুন্দর হয়েছে দেখতে। নাকে একটা পেতলের নথ, পায়ে মোটা করে পরা আলতা, তাতে আবার ফুলের ছবি আঁকা। হাতে এক গোছা রঙ বেরঙের চুড়ি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব প্রাণচঞ্চল বাচ্চা। ছোট ভাইটা তুলনায় কতকটা শান্ত। হাট থেকে কেনা খসখসে খেজুর পাতার পাটি পেতে বসতে দিয়েছে রসবালা। মেয়েটা দুদিকে পা ছড়িয়ে থেবড়ে বসেছে। ভাইটাকেও টেনে ওরকম করে বসিয়ে দিয়েছে। তারপর আঙুলগুলে পেতে খেলতে শুরু করে দিয়েছে
'অস কস সিঙিরা বুলবুলি মস তক'
একটা করে আঙুল ভাঁজ করে রাখে, আবার অন্য আঙুলগুলো দিয়ে খেলে। শেষের দিকে ভাইয়ের আঙুলগুলো খুলে ফেললে আবার ভাঁজ করতে থাকে। আবার খুলে যায়, আবার ভাঁজ করে। শেষে মারামারি লেগে যায়। সুশীলার ধমক খেয়ে ঠান্ডা হয়। তারপর শুরু হয় আপন মনেই হাত পা নেড়ে নেড়ে গান,
"আয় রে অলি কুসুম তুলি
বাবুর বাগানে,
তুলব ফুল গাঁথব মালা
পরব দুজনে।"
বসমতী ওর মায়ের দিকে তাকায়। কেমন দারিদ্র্য পিড়ীত শীর্ণ চেহারা। অথচ কি হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল ছিল মেয়েটি! সুশীলার সঙ্গে খুব ধুমধাম করেই 'সখি' পাতিয়েছিল। তিনদিন ধরে নানা দেব-দেবতার পুজো। তারপর একেবারে বিয়ের মতোই বাজনা বাজিয়ে জল ভরা, ছবির মতো চোখে ভাসছে এখনও।
"একখান হাতোত শাকা নাই মাই? চুড়ি পিন্দিসিস?"
বিমলের মায়ের কথায় বসমতী ভালো করে তাকায়। বাঁ হাতটায় শাখা নেই, শাঁখার মতো দেখতে প্লাষ্টিকের একটা শাঁখা চুড়ি।
"হ্যাঁ আবো। শাঁকাখান সেদিন আপনে খুলি পইচ্চে।"
কথাটা শেষ হল কি হল না, পাশ থেকে মেয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে মুখ ভেংচিয়ে বলল,
"ভালে তো মিছা কাথাখান কলু মা। আপনে খুলি পইচ্চে না বাবা ডাঙে ভাঙি দিসে!"
সুশীলা অপ্রস্তুত হয়ে মেয়েকে ধমকে উঠল,
"বড় মানসির কতার মইদ্যত কি অত কতা কওয়া মাই তোর?"
ধমক খেয়ে মেয়ে চুপ করলেও ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। বিমলের মা বুড়ি কেচ্ছার একটা গন্ধ পেয়ে নড়ে চড়ে বসে। তারপর সুশীলার অপ্রস্তুত ভাবকে পাত্তা না দিয়ে বলে,
"উয়ার বাপ ডাঙাইসে? কেনে ডাঙাইসে তে আরো?"
সুশীলা দৃশ্যতই লজ্জা পায় কিছুটা। তারপর বলে,
"হুটা ছাওয়ার কাথা বাদ দেক তো আবো। বেইন্নায় পাজি হইসে।"
বিমলের মা উত্তরে কিছু বলে না, অপেক্ষা করে। মুখ থেকে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে। ছেঁড়া-ফাটা মলিন কাপড়টা থেকে যত্ন করে বঙ্কেটের ছাই ঝাড়ে। সুশীলা এসব অসহায়ভাবে দেখে, তারপর একটু ইতস্তত করে বলে,
"অই যে শাক ভাত মজা নাই হয়। উয়ার বাপের আগখান খিবে আবো।"
পাশ থেকে কটকটি মেয়ে বলে ওঠে,
"ডাইলোত নুন বেশি হইসে।"
বিমলের মা এবার মেয়ের স্মরণাপন্ন হয় আরো বিস্তারিত জানতে।
"ডাইলোত নুন বেশি হইসে তে তাতে তোর বাপ ডাঙাইল মাই"?
মেয়ে উৎসাহ পেয়ে মহানন্দে বলতে শুরু করে,
"মোর বাবা আছে না, মোর বাবা? হেনা বড়মা।"
বসমতী এর মধ্যে মেয়েটার বুদ্ধি দেখে অবাক হয়। ওর মা আবো ডাকলে ওর যে বড়মা হবে সেটা ওকে শিখিয়ে দিতে হল না। চেনেও না, অথচ কি সুন্দর বড়মা ডাকছে।
"মোর বাবা সেদিন কছে ডাইল আর মাছের ভাজা খাবার মোনাছে। তে বাবা হাটখোলা থাকি একপোয়া কালাই কিনি দিয়া নদী থাকি মাছ মারি আনিসে। তে মার ফমে ছিল না, শাক চড়ে দিয়া ছাগোলোক জল দিবার গেইসে খোলানোত। আসিয়া ডাইলোত দুইবার নুন দিসে। তে কেনে বাবার আগ উঠিবে না, হেনা বড়মা!"
অকাট্য যুক্তি। সুশীলার সাবলীল হাসিখুশি মুখটা কেমন চুপসে যায়। বসমতীর এসব কথা ভালো লাগে না, অন্য কথা পাড়ে।
"পরার বাড়িৎ কায় কায় আছে মাও?"
"সোগায় না আছে বারে। শ্বশুর-শাশুড়ি। ভাসুর-দেওর। তে সোগায় বেগল খাই।"
বিমলের মা আবার বলে,
"বুড়া-বুড়ি আন্দি খায় না কোনো পাকে চাপিসে?"
মিনতি হেসে বলে,
"না খায় আন্দি। বুড়িটার হামার মাতা ঘুরে নগদ নগদ। হামারে পাকে খায়।"
বসমতী এর মধ্যে হাঁক পাড়ে,
"চা কি চড়ালু কইনা?"
গোয়াল ঘর থেকে উত্তর আসে,
"চড়াছোং দি, শিন্ডা ভাঙি নিগাছোং। আগিনাতে চড়াইম। আখার পাড়খান মুচিলুং, শুকায়ে নাই এলাং।"
উঠোনের এক পাশে থাকা বাইরের উনুনটায় আগুন দিয়ে কড়াই বসিয়ে দেয় রসবালা। সামান্য সর্ষের তেলে রসুন, পেঁয়াজ, শুকনো লংকা, একটু পাঁচফোড়ন তেজপাতা দিয়ে সাঁতলে জল দেয়। দিয়ে পরিমানমতো লবন দিয়ে দেয়। টগবগ করে ফুটে উঠলে নামিয়ে দস্তার বাটিতে ঢেলে পরিবেশন করে। ঘর থেকে একটা থালা নিয়ে আসে হাতে করে। দেখা যায় ওতে নুন লংকা পেঁয়াজ দিয়ে চালভাজা মাখা। সবার মাঝখানে এগিয়ে দিয়ে বলে,
"হাতোত চাইট্টা করি নিয়া চোবাও দি, সাকালে ভাজিসুঙ, সেমটি গেল বোদায়।"
রসবালা নিজেও এক মুঠ হাতে নিয়ে চা খায়। বিমলের মা রসবালাকে জিজ্ঞেস করে,
"সাগাইগিলা যাবে না নবে?"
রসবালা চালভাজা চিবোতে চিবোতে বলে,
"না দিম যাবার। ছাওয়াটা আইসে না! মেলা দিন পরে কুদিবা আসিল!"
সুশীলা আঁৎকে ওঠে। ও জানে থাকার উপায় নেই। মরীয়া হয়ে বলে,
" না নোইম বারে। তোমার জাঙোই আগ হবে।"
মেয়েটাও গলায় সুর খেলিয়ে মিষ্টি করে বলে,
"হামরা নোমু না। মোর বাবার খিব আগ। নাতেন ধরি ডাঙাবে।"
সুশীলা ধমকে ওঠে,
"আরো বড় মানসির মুকে মুকে কাথা মাই?"
কিন্তু থাকতেও পারে না। উঠে পড়ে। রসবালা জোর করে রাখে এই বলে যে সন্ধ্যায় ছোট ছেলে ভ্যানে করে দিয়ে আসবে। মিনতি নিমরাজী হয়ে কিছুটা নীরুপায় হয়েই যেন থেকে যায়। এই অন্তরের টান সেও উপেক্ষা করতে পারে না। বসমতী জিজ্ঞেস করে,
"সাগাইলাক কি খোয়াবু তে। এলানি তো হাট বাজারও নাই!"
রসবালা রান্নাঘরে যেতে যেতে বলে,
"ডেকি একটা থুসুং খাবারে জইন্যে। তে ওইটায় আজি হবে এলায়।"
মিনতি জিজ্ঞেস করে,
"তোমরা মুরগী পুষেন না? হামার ওদি এলা সোগায় মুরগি পুষির ধইচ্চে। কাহো কাহো ডিমা ডুমি সব খায়।"
রসবালা বলে,
"মুই পুষোং তে অসুক আইচ্চে। সব মরি গেইসে। একটা পোনোস ও নাই। থাকিলে কি তলপের হাটোৎ দাম পাওয়া যায়।"
তারপর একটু থেমে বলে,
"এইলা না পুষায় ভাল মাও। বাচ্চা দুকিনা ফুটাবুতে সুলসুলিয়ায় সার। ভালে নানাগে।"
সুশীলা অবাক হয়ে বলে,
"কেনে, নরসিঙের পাত দিলেই না পালায়?না দ্যান তোমরা?"
"হুটা না দেই। কিন্তুক ভেজাল খান কেমন ক তো! গরম জল করি কেতা উসাও, ধও। মনটায় না যায়।"
কথা ঠিক। সুশীলা হেসে ফেলে। বিমলের মা এবার উঠতে উঠতে বলে,
"যাং, চাইট্টা খড়ি জোড়াং মুইও। তোমার না কোটাখান আছে তে দে তো মাই। শুকান ঠাইল কয়টা পাড়াং গছবাড়ি খান থাকি।"
রসবালা তড়িঘড়ি বলে,
"বইসোখেনে মা। চাইট্টা খায়া যান এলায়।"
"না খাং বা মুই হাঁসের মসং, বুকখান গ্যারগেরাবে এলায়।"
আঁকশি বাঁধা লম্বা কঞ্চিটা তেলাকুচা আর পটলের মাচা থেকে পেড়ে নিয়ে বুড়িটা হেলতে-দুলতে রওনা দিল। সেদিকে তাকিয়ে সুশীলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। রসবালা মুখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
"এইটা বুড়ি মানসির ভাল দেকিরে পায় না। একেনা আল পাইলে হইল, নাগি নয় পাছোত। নে মাই তুই কাপড়খান পাল্টালে পাল্টা। মোরে একান কাপড় পিন্দেক।"
বসমতী বাড়ি যাওয়ার উদ্যোগ করতেই রসবালা বলে,
"দাদা কালি হাট কইচ্চে দি? দুইটা পিঁয়াজী আছে তে দে তো!"
"কইচ্চে না। নিগা আসি।"
বসমতীর কথার উত্তরে রসবালা বলে,
"তে তুই যা। মুই এত্তকোনা আদা উকুরি আনি থুয়া যাছং।"
বলে কলপাড়ের দিকে পা বাড়ায়। বসমতীও বাড়ির দিকে চলতে থাকে। গরু-বাছুর নাড়া-চাড়া করে আর একবার গা ধুয়ে নেবে তাড়াতাড়ি। বাচ্চাগুলো স্কুল থেকে ফিরে এলে খেতে দিতে হবে।
..................................................................
আবো - দিদা
খোলান - বাইরের উঠোন
সেমটি যাওয়া - সিমিয়ে যাওয়া
কুদিবা - কোন দিক দিয়ে বা
ডেকি - ডিম পাড়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠা হাঁস বা মুরগি।
সুলসুলিয়া - হাঁস-মুরগির শরীর বাহিত এক ধরণের ক্ষুদ্র পোকা।
নরসিঙের পাত - কারি পাতা
বুক গ্যারগেরাবে - কফের কারণে ঘরঘর শব্দ হওয়া।
..................................................................
ছবিঋণ : রীতা রায়
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴