নানা রঙের গানগুলি-১৪/শৌভিক কুন্ডা
নানা রঙের গানগুলি (১৪)
শৌভিক কুন্ডা
--------------------------------
তখন বয়স বছর দশেক হবে আমার। জ্বর হয়েছিলো, মনে পড়ছে। পাড়ার পুজো মন্ডপ থেকে ভেসে আসছিলো "রানার, গ্রামের ডাকহরকরা..…."। প্রথমে এইভাবে কথায়, তারপর সুরের পথে
".....তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে...."।
আমার ঘোর লাগা মনে, শরীরে ছড়িয়ে যেতে লাগলো সেই সুর, সেই অসম্ভব স্বর! না, কথাগুলো তখনও অবধি খুব মন দিয়ে সবটা শুনি নি।
যে টুকু শুনেছি, ভেতরে ঢুকতে পারি নি। কিন্তু, একটা ছবি ঢুকে পড়ছিলো আমার জ্বোরো চেতনায়। পরে আঁকারও চেষ্টা করেছিলাম বল্লমের ডগায় লন্ঠন ঝোলানো রাতের হরকরাটিকে। চাইনিজ ইংক।
আমাদের থেকে বেশ অনেকটা বড়ো এবং ঐ পুজোর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন গৌতম দা। গৌতম চক্রবর্তী। তখনকার জলপাইগুড়ি শহরে অনেকেই চিনতেন তাঁকে। খুব ভালো ভলিবল খেলতেন। আর, নাটক। প্রতি বছর শারদীয় উৎসব যে অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শেষ হত, পাড়ার পুজোর বাঁশ-তক্তার মঞ্চের সেই বিজয়া সম্মিলনী অপেক্ষায় থাকতো, কখন "'গৌতম দার রানার" হবে! আলো নিভতো প্রথমে, আর এতক্ষণের গুণগুণ ঐ স্যুইচ টিপেই যেন
থামিয়ে দিতো কেউ এক ঝটকায়। একটা আবছা আলোর বৃত্তে মঞ্চে ফুটে উঠতেন গৌতম দা। না, রানার। মালকোঁচা ধুতি, কালি মাখা খালি গা, মাথায় লাল ফেট্টি, হাতে বল্লমে ঝোলানো লন্ঠন।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ
মাটি ভিজে গেছে ঘামে
রাত্রির কালোনিকষ খামের ভেতর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রানারের। আমরা, যারা দেখছি, তাদেরও। গৌতম দার শরীরী বিভঙ্গ ধুঁকে পড়ছে, কোনমতে শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে রানার শহরে পৌঁছনোর মরিয়া তাগাদায়। তারপর আলোর মায়ায় পাড়ার পুজোর মঞ্চটি ভোরের আধোছায়া পেরিয়ে লালিমা বৃত্তে চোখ মেলে। মূকাভিনয়ে সেই বৃত্তের ভেতর চলতে থাকে রানারের অবিশ্রান্ত পা টেনে টেনে এগিয়ে যাওয়া, যতক্ষণ না আবার সব আলো একে একে নিভে যায়! কয়েক মুহূর্ত পৃথিবী নিঝঝুম হয়ে থাকে। তারপর লাখো পায়রা ডানা ঝাপ্টে ওঠে দর্শকদের উল্লাস হয়ে।
গৌতমদা কোন্ অভিমানে আত্মহত্যা করেছিলেন, জানি না। জীবনের স্বপ্নগুলো বিক্রি করে দিয়ে এমন ঠিকানায় চলে গেলেন, যেখানে কারও চিঠি কক্ষনো পৌঁছতে পারবে না। আমার কাছে এই বয়সে পৌঁছেও তাই 'রানার' উচ্চারিত হলে বেঁচে ওঠেন সুকান্ত নয়, হেমন্ত নয়, গৌতমদা। জলশহর পাহাড়ি পাড়ার গৌতম চক্রবর্তী।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴