ধূমপাড়ার গোধূলি/অমিত কুমার দে
ধূমপাড়ার গোধূলি
অমিত কুমার দে
----------------------
তিন দশকের আগের একটা গোধূলি ঝেঁপে এল বুকের ভেতর। কালাপানি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঝাঁকে ঝাঁকে মোষ খয়ের-বনকে ধুলোয় ঢেকে ফিরছে তাদের বাথান-ঘরে। টানা টানা স্বরে ডেকে চলেছে অনেক ময়ূর। মোষেদের গলায় বাঁধা নানান আকৃতির ঘন্টা রকমারি বেজে চলেছে।
কুমারী আর কুসুম ছেত্রী, আমার দুই কিশোরী ছাত্রী, আমায় বন আর বাথান দেখাতে নিয়ে এসেছে। ওদের আমি বুঝিয়ে চলেছি ‘গোধূলি’ শব্দের মানে। শুধু কি ওদের বোঝাচ্ছি? নিজেও সত্যিকারের বুঝছি ‘গোধূলি’ কাকে বলে!
তেইশের মার্চের এক চৈত্র গোধূলিতে নাথুয়ায় আশিস বলল – চলো দাদা, তোমাকে ধূমপাড়ায় একটা মন্দির দেখিয়ে নিয়ে আসি, তোমার খুব ভালো লাগবে!
স্টিয়ারিংয়ে বসে তিরিশ বছর আগের রাস্তায় যেতে যেতে বুক কেমন করে উঠছিল। কালাপানি নদী, মোষবাথান ডাকছিল পাগলের মতো। যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্য ডুবে যাবার সময় আমি কুসুম কুমারীকে বলেছিলাম আমায় নেপালি গান শোনাতে!
শেষবেলাকার পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। কী যত্ন করে তৈরি করা একটি মন্দির। দুর্গা ও শিব অবস্থান করছেন ডুয়ার্সের অনাবিল নৈ:শব্দে। পুরোহিত এসে শুধু জানিয়ে গেলেন – “জুতো খুলে ভেতরে ঢুকবেন।”
নি:স্তব্ধ মন্দিরে ঢুকতেই মন শান্ত স্নিগ্ধ হল! কিছু দূরেই ডায়না নদী। নদীয়ালি হাওয়া টের পাচ্ছি। কত ফুলের গাছ রঙ ছড়িয়ে আলো করে রেখেছে প্রাঙ্গণ।
পুরোহিত জানালেন এ মন্দিরের মালিক এখানের লোকবাহাদুর ছেত্রী ও সিকিমের অর্জুন ছেত্রী। দেবদেবীর মূর্তির দিকে করজোড়ে বসে থাকা আরো পাঁচটি মূর্তি – লোকবাহাদুরের বাবা-মা বোমবাহাদুর ও সলিমায়া ছেত্রী, তাঁর প্রয়াত প্রথম পত্নী লীলামায়া ছেত্রী এবং অর্জুন ছেত্রীর পিতা-মাতা। এই মূর্তিগুলোও কী জীবন্ত! কিছুদূরের মন্দিরের দুর্গা ও শিবের দিকে নিবিড় প্রণতি নিবেদন করছেন তাঁরা। এভাবে পরলোকগত প্রিয়জনদের শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা আমি জীবনে এই প্রথমবার দেখলাম। অভিভূত হলাম।
লোকবাহাদুর নামটা শুনতেই স্মৃতি ঝেঁপে এল। শ’খানেক মোষের বিশাল বাথানের মালিক লোকবাহাদুর তো আমার ছাত্রী কুমারীর বাবা। প্রথম মোষের দুধ খেয়েছিলাম তাঁর বাড়ির উঠোনে বসে। ত্রিশ বছর আগে। তিনি এখনো আছেন জেনে কী আনন্দ হল।
মন্দির থেকে বেরিয়ে চললাম লোকবাহাদুরের বাড়িতে। সেই ৩০ বছর আগের কাঠের ঘরগুলো রূপান্তরিত হয়েছে আধুনিক বিল্ডিং-এ। তবে সুবিশাল উঠোনটা রয়ে গেছে। সম্ভবত লোকবাহাদুরের বৌমা, ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত। তাঁকে বললাম – লোকবাহাদুর আছেন? একটু দেখা করতে চাই।
খবর গেল লোকবাহাদুরের কাছে। দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন পঁচাশি বছরের লোকবাহাদুর ছেত্রী। নিমেষেই চিনে নিলেন ৩০ বছর আগে দেখা মাস্টারমশাইকে! তাঁর পুত্র শান্তনুও আমার ছাত্র ছিল। সে কিছুতেই বিশ্বাস করবে না – এই তার সেই অমিত-স্যার। - “আমাদের অমিত-স্যারের গালে দাড়ি ছিল, তিনি আর একটু লম্বা ছিলেন। আমাদের দিয়ে প্রথম স্কুলে নেপালি গান নাচ করিয়েছিলেন তিনি।” আমি শুনতে শুনতে ভাবছিলাম – সেই আমি কি তবে মৃত? ওটা কি আমার পূর্বজন্ম ছিল?!
সেই মোষ-বাথান আর নেই। মোষ পোষার লোক পাওয়া যায় না। মানসিকতাও বদলে গেছে অনেক। - লোকবাহাদুর বলছিলেন। আংরাভাসা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের ধূমপাড়া গ্রামে (বানারহাট থানা) অনেক বদল এসেছে। বাথান প্রায় সবই উঠে গেলেও নেপালিদের সংখ্যা বেড়েছে। বাড়ির পেছনেই নদীর পাড়ে তৈরি হয়েছে নিউ দীঘা পিকনিক স্পট। আশিস স্বগতোক্তি করল – “ডুয়ার্সের স্থাননামে কত বৈচিত্র, অথচ এই জায়গাটির নাম নিউ দীঘা দিতে হল কেন? ডুয়ার্সের গন্ধমাখা একটা নাম দেওয়া যেত না?”
লোকবাহাদুরের বাড়িতেও ছেলেদের আলাদা আলাদা ঘরবাড়ি। তবে সবগুলোই রিসর্ট রিসর্ট আকারের! মনে হচ্ছিল – ওরা চাইলে বেশ হোম-স্টের ব্যবস্থা হতে পারে! কিন্তু তেমন ভাবনা পেলাম না। শান্তনু নিয়ে দেখাল – তার পোষা রকমারি ছাগল - অস্ট্রেলিয়ান বোর, রাজস্থান রোহিনী, তোতাপুরী, যমুনাপুরী ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশেই করকনাথ মুরগির খামার।
লোকবাহাদুর ছেত্রীকে বললাম – “হাতি আসে?” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর – “দেখবেন নাকি?” এমন যেন খামারে গোটা কয় হাতি বাঁধা রয়েছে!! জানতে চাইলাম – “তার মানে?” বললেন – “রাতে থাকুন। নিশ্চিত, হাতি দেখে যেতে পারবেন। রোজ আসছে।” জানালেন – হাতির দলের আসা-যাওয়া বড্ড বেড়েছে। ৭০ বছর তিনি এখানে বাস করছেন। আগে দেখতেন হঠাত এক দুটি হাতি জনালয়ে আসত। কিন্তু এখন প্রায় প্রতিদিন দল ধরে হাতি এসে ঘুরে বেড়ায়। কোনও কিছু চাষআবাদ করা যায় না। সন্ধের পর বাইরে বের হওয়া চিন্তার।
বৌমা যত্ন করে চা বানিয়ে এনে দিলেন। সেই ঘন মোষের দুধের চা না হলেও আন্তরিকতায় খামতি পেলাম না। মন্দিরের জন্য দুর্গার ছবি দিয়ে রীতিমতো অভিজাত ক্যালেন্ডার বানিয়ে পাঠিয়েছেন রংপোর অর্জুন ছেত্রী। উপহার পেলাম।
ওঁদের কাছেই শুনলাম আমার প্রিয় ছাত্রী, যে প্রত্যন্ত নাথুয়ার স্কুলে গরগর করে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলত কবিতা শোনাত, সে স্বামীকে হারিয়ে এই গ্রামেই ফিরে এসেছে। অসুস্থ হয়ে রয়েছে এখানে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে। কিন্তু অন্ধকার, রাস্তায় হাতির সম্ভাবনার কারণে সে ইচ্ছেয় রাশ দিতে হল। দিন দশেক আগেই রাত্রিবেলা খুট্টিমারি জঙ্গলের রাস্তায় আমার গাড়ি আটকে দাঁড়িয়েছিল দু’খানা দাঁতাল।
মনে মনে নিজেকে বললাম – খুব তাড়াতাড়ি আবার আসতে হবে এখানে।
---------------------------------------------------------------------------------------------
শান্তনু ছেত্রী : ৯৬৭৯১৫৪১২০
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴