দাঁড়াবার জায়গা/চোদ্দ
সমর দেব
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
সে
ছিল এক গ্রীষ্মের দিন, স্পষ্ট মনে আছে। স্কুল ছুটি। এমন দিনগুলো সাধারণত
কেমন বিবর্ণ লাগত। তবু, আমাদের বাড়িটা যেখানে সেই এলাকাটা প্রচুর
খানাখন্দ, পুকুর, ঝোপঝাড়, খোলামেলা সবুজে ঘেরা বলেই প্রায়ই তাতে মজে
যেতাম। আমাদের খুব পছন্দের ছিলো কাচপোকা, সোনালি ডানার গোলাকৃতি পোকা।
ঝিলিক দিয়ে ওঠা দুটো সোনালি ডানাই ছিল তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সমবয়সী
মেয়েরা সকলেই কাচপোকা ধরে দিলে তার ডানা ছিঁড়ে কপালে টিপ পরত। তখন ভয়ানক
উজ্জ্বল হয়ে উঠত অন্য সময় নেহাতই সাধারণ মেয়েটির মুখ। ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে,
পাতার ওপরে বসে থাকত কাচপোকা। আমরা খুব সহজেই দু-আঙুলে ধরে ফেলতাম তাদের।
সে ছিল এক মজার খেলা। যেমন বর্ষার প্রথমদিকে নিচু জায়গায় হঠাৎ জমে ওঠা জলে
উল্লাসে ক্রীড়ারত ব্যাঙেদের লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়া। আমাদের ক্রমাগত ছোঁড়া
ঢিলের আঘাতে কতজন আহত হত, কতজন মারা পড়ত, থোড়াই কেয়ার! সবই ছিলো খেলা
মাত্র! আজ যখন রাজনৈতিক বৃত্তে শুনি ‘খেলা হবে’, আমার মনে পড়ে যায় আমাদের
শৈশবের নির্বোধ নৃশংসতার জান্তব উল্লাসের কথা। এ যেন আদি মানবের শিকার
শিকার খেলা। আমাদের রক্তের গভীরে কি আজও ঘুমিয়ে আছে হান্টার-গ্যাদারার আদি
মানব! বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে তার ঘুম ভাঙে হয়তো। তখন সে তার সন্নিহিত
বাস্তব, তার ইগো ভুলে যায়। তার ভেতরে জেগে ওঠে আদি মানবটি। যেমন স্টোন
ম্যান। আধুনিক মানুষের মধ্যেও গভীর রাতের অন্ধকার নির্জনতায়, কোন রহস্যে
জেগে ওঠে প্রস্তর যুগের আদিম মানুষ। তখন সম্ভবত, হাতে অত্যাধুনিক
আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও সেটা ফেলে দিয়ে পাথরই সে তুলে নেবে হত্যার অস্ত্র
হিসেবে। একসময় খবরের কাগজে এরকম স্টোন ম্যান নিয়ে বেশ কিছু খবর দেখেছিলাম।
কলকাতার ফুটপাথে হত্যালীলায় মেতে উঠেছিল স্টোন ম্যান। আধুনিক যুগের মানুষ
হলেও সেই বিশেষ মুহূর্তে সে প্রস্তর যুগেরই মানুষ হয়ে উঠত। আমাদের
শৈশব-কৈশোরেও কি তেমন ঘটনা ঘটত? কি জানি। অথবা, স্যাডিজম। হতে পারে।
বেশ
মনে আছে, আমাদের সুভাষ একদিন সম্পূর্ণ নতুন একটা খেলার আমদানি করেছিল। বড়
মজাদার সেই খেলা! আমরা যাকে রক্তচোষা বলি, সেই গার্ডেন লিজার্ড ছিল খেলার
প্রধান উপকরণ। একটি লম্বা পাটকাঠির ডগায় লাগানো হত ছোট্ট, আলগা ফাঁস। সুতো
দিয়ে সেই ফাঁস বানাতাম আমরা। তারপর, ঝোপেঝাড়ে খানিক অনুসন্ধান। খুব বেশি
খোঁজাখুঁজির দরকার হত না। একটা রক্তচোষা দেখলেই দূর থেকে পাটকাঠির ডগাটা
ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হত তার মাথার কাছে। তারপর ঝট করে তার গলায় ফাঁস
পড়িয়ে দেওয়া। তখন সে সুতোর প্রান্তে ঝুলতে থাকে। নড়াচড়ার প্রশ্নই নেই।
কারণ তার গলায় আরও এঁটে বসতে থাকে সুতোর ফাঁস। পুরো প্রক্রিয়াটা এতই সহজ যে
আমরা ছ-সাত বছর বয়স থেকেই সেটা রপ্ত করে ফেলেছি। এই দানবীয় খেলাটাও বেশ
মজার খেলা বলে আমাদের কাছে বিবেচিত হয়েছিল! একবার এই খেলাটার এক বিচিত্র
প্রয়োগ করেছিলাম। তার ফলাফলও ছিলো বেশ উল্লেখযোগ্য। স্কুল ছুটি। যথারীতি
সকালের তথাকথিত পড়াশুনো এবং তারপর খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়া গেল পাড়া
বেড়াতে! বাড়ির উল্টোদিকেই ছোট্ট ঝোপে দিব্যি বসে আছে এক রক্তচোষা! মাঝে
মাঝেই মাথা তুলে দেখছে আমাকে। দেখতে দেখতে তার ধুসর মাথাটা ক্রমশ লাল হয়ে
উঠতে থাকল। আরও লাল হতে হতে একেবারে রক্তবর্ণ হয়ে গেল। তখনই খেলার প্রবল
ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মুহূর্তেই জোগাড় হয়ে গেলো একটা লম্বা পাটকাঠি।
তার মাথায় যথারীতি একটা সুতো বেঁধে বানানো হল ফাঁস। তারপর খুব সন্তর্পণে
ঝোপের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মাথা দিয়ে ফাঁসটা গলিয়ে দিয়েই একটা জোর ঝটকা।
প্রাণীটি সুতোয় ঝুলতে থাকল পাটকাঠির মাথায়। সেভাবেই এদিকে যাই, ওদিকে যাই।
‘পাগলা’র বাড়ির পাশের গলিতে কীভাবে যেন ঢুকে পড়েছি। খানিকদূর গিয়েই
দুপাশে নিচু জমি, মাঝখানে প্রশস্ত আলপথ। সেখানে আপনমনে ঘাস চিবোচ্ছিলো একটা
কালো রঙের ছাগল। কি খেয়াল হতে পাটকাঠিটা দোলাতে দোলাতে ছাগলের পিঠের ওপরে
প্রাণীটাকে রাখতেই ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল। পরিত্রাহী চিৎকার করে ছাগলটা
ভয়ানক ছুট লাগাল। তাতে তার গলার দড়ি ছিঁড়ে গেল। উন্মত্তের মতো সে ছুটে
পালাল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘটনাটা ঘটে গেলো। হুলুস্থুলের মধ্যে আমিও
উল্টোদিকে পিছিয়ে আসি অনেকটা। হাতের পাটকাঠি এবং তার মাথায় লটকে থাকা
রক্তচোষা কোথায় যেন ছিটকে গেল। সেখানে আর বেশিক্ষণ দাঁড়ানো সুবিধের মনে
হয়নি। ফলে, আমিও সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে আসি। অনেক পরে বুঝেছি, গলায় ফাঁস
লাগানো অবস্থায় ঝুলন্ত রক্তচোষাটা মুমূর্ষূ হয়ে পড়েছিলো। ছাগলের পিঠের
স্পর্শে সে পায়ের আঙুলে খামচে ধরেছিলো ছাগলের পিঠ। হঠাৎ করেই পিঠে
রক্তচোষার এই খামচে ধরার ঘটনায় ছাগলটা ভয় পেয়েছিল। তার পক্ষে বোঝা অসম্ভব
ছিল ঘটনাটা আসলে কী। ভয়ে সে চিৎকার করে উঠেছিল এবং প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুট লাগিয়েছিলো। ঘরে ফেরার পর কথাটা কাউকে বলিনি।
জানতাম, বললে মার খেতে হবে। প্রথমে খুব হাসি পেয়েছিলো। পরে, বুঝতে
পেরেছিলাম ঘটনাটা। রক্তচোষাটার প্রাণ বাঁচাতে এই একটি পথই খোলা ছিলো। পায়ের
কাছে ছাগলের পিঠের অবলম্বন পেয়েই সে তাই খামচে ধরেছিল। তখন মনে হল, আমাদের
কাছে যেটা খেলা ওদের কাছে সেটা মৃত্যু। ব্যাপারটার নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতার
কথা ভেবে খুব পাপবোধ হয়েছিলো, খুব অনুশোচনা। ফড়িং নিয়েও প্রায় একই ধরনের
খেলা একসময় আমাদের খুব আনন্দ দিয়েছে। কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই ফড়িঙের লেজে
সুতো বেঁধে খেলাটা ভুলেই গেছিলাম। এদিন ফের মনে পড়ল। মনে পড়লো সে খেলার
নৃশংসতার বিষয়টাও। বাড়িতে তখনও ঈশ্বর সম্পর্কিত, স্বর্গ-নরক সম্পর্কিত,
পাপ-পুণ্য সম্পর্কিত তেমন কিছু শুনিনি কখনও। যেমন ভূত-প্রেতের ব্যাপারটাও
শুনিনি সেভাবে। ভূত-রাক্ষস ইত্যাদি মজার গল্পই ছিল। ফলে, মনে পাপ-পুণ্য,
স্বর্গ-নরকের কোনও ছায়াপাত ঘটেনি কখনও। যেমন, ভূতের ভয়ও ছিল না। কিন্তু,
একটি প্রাণীর ওপরে অত্যাচার, তার জেরে তার মৃত্যুর মতো ঘটনায় মনে গভীর ছাপ
পড়েছিল। এঘটনার পর বেশ কয়েক রাত ভয়ানক সব স্বপ্ন দেখেছি। প্রতিটি স্বপ্নেই
দেখেছি, কেউ আমার গলা টিপে ধরেছে। কখনও দেখেছি, আমার গলায় কেউ ফাঁস লাগিয়ে
দিয়েছে, ফলে আমি শ্বাস নিতে পারছি না। আতঙ্কে ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছি।
সে-সময়ই প্রতিজ্ঞা করেছি, আর কখনও এমন খেলা খেলব না। পাড়ায় কেউ কেউ তখনও
এরকম খেলায় মজে গেলে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তারা আমাকে এক কথায়
নস্যাৎ করে দিয়ে বলেছে, ‘ভুদাই!’
সত্যই, ভোদাই-ই
ছিলাম, আমরা কেউ কেউ! সেটা সারা জীবনে বহুবার নিজের কাছেই প্রমাণিত।
জঙ্গলের কাচপোকা, সরীসৃপ বা ব্যাঙের মতো নিম্নস্তরের উভচর নির্যাতন বা
হত্যার মতো আপাত নিরীহ ব্যাপারেই এই ‘নির্বুদ্ধিতা’ সীমাবদ্ধ নয়। আমরা কেউ
কেউ ‘ভোদাই’ ছিলাম বলেই জীবন তার উপযুক্ত শোধ তুলেছে! না, এনিয়ে কোনও
গ্লানিবোধ নেই, কোনও শোক-তাপ নেই, হাহুতাশ নেই। পূর্বাপর বিশ্লেষণে বুঝি,
যে নীতি, আদর্শ আমাদের চালিত করেছিল, সেটা সময়ের সঙ্গে মানান সই ছিল না।
আরেকটু পাকা বুদ্ধি থাকলে সময়টাকে আরও সঠিকভাবে অনুধাবন করা যেতো বোধহয়।
এখন বুঝি, আমাদের অনেক চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপ বয়সোচিত ছিলো না।
তাই বলে গড্ডলিকায় গা ভাসানোও কি আদৌ সমর্থনযোগ্য! ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার
করতে হলেও আমরা কেউ কেউ যে সঠিক পথেই ভেবেছি সে সম্পর্কে কোনও দ্বিধা নেই।
আজকাল তো দেখি, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা শহিদ ক্ষুদিরামকেও বোকা ভাবে!
এবং সেটা তারা প্রকাশ্যেই দ্বিধাহীন উচ্চারণ করে! আমাদের প্রজন্মের যারা
নিজেদের পালে হাওয়া ধরে সহজে উৎরে যাবার পথ মাড়ায়নি, তারাও যে বোকা তাতে
আর সন্দেহ কী! যেমন, আমাদের ঠিক আগের প্রজন্মটি।
বিষয়টি
আপাতত মুলতুবি থাক। পরবর্তীতে নিশ্চিত ফিরে আসবো বিষয়টিতে। তবে, জীবনে
বহুবার নিজেকে ভোদাই বলে প্রমাণ করেছি। অনেক দৈনিক কাগজে কাজ করেছি, কারণ
সেটাই আমার পেশা। কখনও অর্ধশিক্ষিত সম্পাদক, কখনও প্রায় মূর্খ কাগজ মালিকের
শ্রীমুখ নিসৃত বাণীও বুঝিয়ে দিতে কসুর করেনি আমি কত ভোদাই! একাংশ সহকর্মী
যখন সম্পাদক বা মালিকের পদলেহন করে সুবিধে আদায় করেছে তখন পত্রিকার
স্বার্থে আমার পদক্ষেপ হালে পানি পায়নি! যে-সম্পাদকীয় বা উত্তর-সম্পাদকীয়
লেখার জন্য ভালো কোনও কাগজে পুরস্কৃত হবার সম্ভাবনা ছিল, সেই একই কাজে এঁরা
উল্টোটাই করেছেন এবং এমন পদক্ষেপ করেছেন যাতে আমি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছি! বছরের পর বছর আমার বেতন বাড়েনি, আমার পদোন্নতি হয়নি! ব্যাপারটা
এরকম নয় যে, পত্রিকার পলিসির সঙ্গে মতবিরোধ ঘটেছে। বরং, যতটা সম্ভব
জার্নালিস্টিক এথিক্স মেনে চলেছি বরাবরই। সেকারণেই এবং সম্ভবত ভোদাই বলেও,
অযথা পদলেহনের মতো ঘৃণ্য উপায় এড়িয়ে গেছি বরাবরই।
মনে
আছে, একটি পত্রিকায় কর্মীসংখ্যা ভীষণ রকমের কম থাকায় রবিবারের পাতার
অতিরিক্ত দায় চাপে আমার ঘাড়ে। তো, লেখার জন্য সম্মান দক্ষিণার ব্যাপার
ছিলো না। ভালো লেখা দূরের কথা, চলনসই লেখা জোগাড় করাও তেমন সহজ ছিলো না।
যেসব লেখা জমা পড়তো সেসব পাঠকের পাতে দেবার অযোগ্য। ফলে, প্রায়ই ছদ্মনামে
একাধিক লেখা নিজেই দিতাম। একদিন পাবলো নেরুদাকে নিয়ে একটি লেখা স্বনামেই
দিয়েছি। পরদিন বিকেলের দিকে সম্পাদক মশাই অফিসে এসেই চোখ পাকিয়ে আমাকে
বললেন, ‘এটা একটা দৈনিক পত্রিকা। এখানে পাড়ার কালুদা, ভুলুদাকে নিয়ে এসব
...(লেখার অযোগ্য একটা অশ্লীল শব্দ) লেখা কে দিতে বলসে? পারবা না, তো চাকরি
ছাড়ো’। আমি তখন বুঝতে পারছি না, হাসব না কাঁদব। দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক
নেরুদার নাম শোনেননি! মনে আছে, একদিন পদার্থবিদ্যার একটি গবেষণার ফল নিয়ে
একটি খবর এসেছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সপক্ষে নতুন প্রমাণ।
স্বভাবতই খবরটি আমি করেছি। পরদিন সম্পাদক মশাই এসে বললেন, ‘এইসব কী?
আইন...আইন...কী একটা নাম দেখলাম, কে দিতে বলসে এই খবরটা?’ এরকম বিচিত্র
অভিজ্ঞতা আমার সমস্ত কর্মজীবন জুড়ে। এসব ঘটনা অবশ্য অনেক সময়ই বেশ উপভোগ
করেছি। তবে, জীবনে সেরা সম্পাদক হিসেবে পেয়েছি অঞ্জন বসুকে। তাঁর কাছে আমার
কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। হাত খুলে কাজ করতে দিয়েছেন। মতপার্থক্য হলে
যুক্তিতর্কের মাধ্যমে নিষ্পত্তি সম্ভব হয়েছে। প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ, আমার
দেখা যোগ্যতম সম্পাদক বলেই তাঁর কাছে শেখার মতো ব্যাপারও ছিল, সে সুযোগ
নিয়েছি। তিনিও অধস্তনের কাছে শিখতে দ্বিধা করেননি। এমন উদার একজন সম্পাদক
আমার কর্মজীবনের সেরা সম্পদ। কর্মজীবনে অঞ্জনবাবুর সান্নিধ্য আমাকে জানিয়ে
দিয়েছে আমি মোটেই ভোদাই নই। তিনি বলেছিলেন, ‘নিউজ ডেস্কে আপনার মতো কাউকে
পাইনি কোনওদিন’!