তোর্সার ঘরবাড়ি//চতুর্দশ পর্ব
মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
---------------------------------------
দুধ মিঠা দই মিঠা আরো মিঠা ননী
তারো চাইতে অধিক মিঠা মাও জননী"...
-ও
মাও তোর বিয়াক কি আনন্দ যে হবার নাগছে...লজ্জা পায় মেয়ে। বুড়ি তিত্তিরীর
মেয়ে সুমিত্রা কি ছাড়ান দেয়?- হা পিত্যাস বইস্যা আছি সব,তর বন্ধু ঐ
ঘনাটাও বইল্ বার ধরছে তর কথা।...ওই কি লাজ কিই যে শরম উয়ার।
- ঘনা এসেছে নাকি? ও তো কলকাতা নাকি বিহার কোথায় গিয়েছিল...যতবার এসেছি দেখিনি তো আর!
-আরে উয়ায় কি এমনি আইসব্যার দেয়? কইছি সাগাইয়ের বিয়া নাগছে। আসিবার লাইগবে। ব্যস্ ওও ছুটি পাইসে।
মিনির মুখ উজ্জ্বল। আহা! কতদিন পর সবার সঙ্গে দেখা হবে, মিলুও ছেলে নিয়ে এখানেই আছে। ঘনা এসেছে...কাল পাঠিয়ে দিও মাসি।
এই'মাও
জননী'র সন্তান ওরা। এই নদীই তো 'মাও জননী'। নদী মতৃক সংস্কৃতির বাতাবরণে
বেড়ে ওঠা একসঙ্গে এত মানুষ, চর পড়ে, ঘর তৈরি হয়। নদী ঝাপটে পড়ে প্রতি
বর্ষায় নদী মুখ বদলে যায়, উত্তাল হয় ঘর ভাঙে,মানুষ ভাঙে। মন নয়, দেহ। ওই
ওরা অনল নমিতা ওদের ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে উঠে গিয়েছিল, মনে মনে হয়ত বলছিল এ
চরে মানুষ তৈরি হয়না। ঐ চরুয়া করে রাখতে চায়নি নিজেদের বলেই ঐ ভাঙা মাটির
আর ছন ছাওয়া ঘর সে তুলসীতলা ছেড়ে উঠে এসেছিল পাকা রাস্তা ধরে নতুন হওয়া
তল্লীগুড়ি এলাকায়। কেউ জানলনা কোথায় ওরা সংসার পেতেছিল। কোন বড়ঘরের
মিত্রদের বাড়ির বৌ প্রাণ কাঁপিয়েছিল...কে জানল ওখানে ঐ কাঠ ধরে নৌকো
বানানোর শিল্প আর ব্যবসায় বিরাট খ্যাতিমান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, সব
স্বপ্ন ঐ নদীর কাছে গচ্ছিত রেখে ওরা ভাড়া বাড়িতে উঠে এসেছিল। ছেলেটা বড় বড়
এখন ধোপদুরস্ত। কাঠের ফানিচারের দোকান করে অনল। ঘর বাড়ি বদলে গিয়ে এখন সে
শহরের বাবু।কিন্তু বুকের মাঝবরাবর বসে থাকা সেই চর প্রাঙ্গণ সে নদী সে
রাতের জ্যোৎস্নায় তুমুল প্রেম এ শব্দকথা নমিতা আর ও ভুলবে কি করে! ঠিক
যখনই মন কেমনের বাতাস বয়ে যায় তখনই শোনে ঐ দূরে শববাহকের "বল হরি,
হরিবোল...',বুকে মুখ লুকিয়ে নেওয়া কিশোরী বউ তার এখন জমিয়ে সংসার করে। ছেলে
মানুষ করে। সে ঠিকঠাক মাষ্টারমশাইয়ের পড়া দিতে পারল কিনা দেখে। আজকের
বাজারে'বাবুসোনা'কে যে বাবু হতেই হবে। ভদ্র সমাজে মাথা উঁচিয়ে ওরা তখন বলবে
ঠিক, ঐযে যায় স্বপন রায়ের মা বাবা। কেউ বলবেনা ঐ বালিকাদায় বড় হওয়া চরুয়ার
কথা, নৌকো ঠেলার কথা।...শুধু গভীর রাতে ঘুম না আসা নির্জন জ্যোৎস্নায়
ভালোবেসে গড়ে তোলা বাড়ির ছাদে মন কেমন আর শূন্যতাবোধ চোখ ভিজিয়ে দেয় ঐ
একটুকরো ফেলে রাখা চরের ফেলে আসা বাঁশের বেড়ার ভাঙাচোরা ঘরটুকুর জন্য।
এভাবেই
তো ঐ মাও জননী মিনিদেরও ছেড়ে দিয়েছে অগাধ তলহীন এ পৃথিবীর মাটিতে। ওরা
একের থেকে অন্য, এক পালাপার্বণ ছেড়ে অন্য জলে, অন্য নৌকোয় গাঁটছড়া
বেঁধেছে।...সে বন্ধুত্ব আর তৈরি হয়নি যেমন সুতো বাঁধা তোর্সার ঘর...যেমন
ছবি নীলচে সবুজ কচুরীপানায় এখনকার নদী বরাবর হয়ে ওঠা সোঁতায় মিনি ওর আসন্ন
চলে যাওয়ার দিনগুলোর কথা ভাবে, হু হু করে বুক। খুব বেশিক্ষণ ভাবলে যে বাবা
মা ঠিক এসে দাঁড়ান।অভিজিত বাবু তাঁর কাঁপা হাত মেয়ের মাথায় রেখে কি যেন
বলতে চান। মিনির শরীর কেঁপে ওঠে। চলে যাওয়ার বিশ্রী এক অসম্ভব সত্যতায় ঐ
নদীর মুখ ঘোরানোর মত ই দূরে চলে যেতে হয়, হবেই মেয়েদের। ছেলেরাও দূরে যা
নানা কাজে, তারা জানে নীড় বাঁধা আছে তাদের স্থির মাটিতেই, যেখানে জন্ম
সেখানে ফিরবেই তারা, সেটাই নিজস্ব। মেয়েরা দিয়ে চলে যায়। শূন্য করে ভরে
দিয়ে যায়। আর ফেরে না। সত্যিকারের ফেরা হয় না আর। আসে অতিথি হয়ে অথবা চলে
যাবে বলেই আপ্যায়ণের এত আয়োজন। মাটি আর নদীর কান্না কেবল ওরাই শোনে। আর
কেউ না।
* * *
বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির শব্দ কি শোনা যায়/ বুকের ভিতর ঝরা কান্না নীরব তখন।
মদনমোহন
বাড়ির তোরণে রোশন চৌকি ঘরে বাজছে সানাই মনকেমনের। এর আগে সে বাজনার হৃদয়
আকুল করা সুর কখনো কি কোন উৎসব বাড়ির নিরালায় বেজে উঠেছে? মনে পড়ে না।
রাজনগর
যখন করদমিত্র রাজ্য তারপর স্বাধীনতা। কয়েকবছর পর এ রাজ্যের
অন্তর্ভুক্তিকরণ, তার পরপরই অভিজিত, মৃদুলের বাবা পাবনার সমস্ত পাট চুকিয়ে
এসেছিলেন এখানে খোলা নিরালা নির্জন প্রান্তরে। কোন কোন বিরাট মহীরুহ তাই
তার ভাইদের হয়ে উঠেছিল একান্ত নিজের। বাড়ির কর্তা জমানো পুঁজিতে কিনে
নিয়েছিলেন বিরাট আবাদযোগ্য জমি। সেখানে মিত্রের মত আরো অনেকেই বাসা
বেঁধেছিল। মল্লিক, বিশ্বাস, দত্ত, ঘোষ,ব্রহ্ম...এরাও কেউ পাবনা, ঢাকা,
ময়মনসিং, কেউ বরিশাল কেউবা বিক্রমপুর থেকে এখানকার ফাঁকা জমির পাট্টা বের
করে জায়গা নিয়েছিল।শ্মশান সংলগ্ন তখনকার জমিতে কত কি যে ফলন হয়েছিল। মনিষ
রেখে জন খেটে সে ক্ষেত হয়েছিল সুজলা সুফলা। তারপরইতো নদী এগিয়ে এসে, পাড়
ভেঙে ভেঙে।নিয়ে গেছে গোরুর গোয়াল, ফল সবজি ভরা জমি। কাছাকাছি কালীতলা
মন্দির আর নতুন গড়ে ওঠা প্রাইমারি স্কুল সব নিয়ে নতুন ভাবে জীবন শুরু। সে
কারণে মিত্রবাড়ির তোরণে ডেকোরেটার্সের তৈরি উঁচু মহলে সানাই বেজে
উঠল।সানাইয়ের সঙ্গে অন্যান্য সঙ্গত বাদ্যযন্ত্র। মনখারাপের তোর্সার জল
আর বাঁধে বেঁধে রাখা ফাটলে মোটা তারে বাঁধা পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে
আসে প্রতিধ্বনি। উঠোন আর অর্জুন হীন অর্জুন চত্বর পেরিয়ে কতটুকু পৌঁছয় সে
সুরলহরী মিনির কানে। রক্তিমদের বাড়ির কয়েকজন আত্মীয় আর কলেজ সহকর্মী এসেছে,
রাখা হয়েছে রাজনগরের জনবহুল ঘড়িমোড়, হরিশ পাল চৌপথী থেকে এগিয়ে পরে্য মোড়ে
নামকরা হোটেলে। শহরে রাসমেলার আতিশয্য। মিলিত মিশ্রিত আওয়াজ বাজনা
যাদুকর, সার্কাস আরো নানা জনতার কোলাহল আর ভীড়ে এখানকার প্রকৃতি 'হরবোলা'।
সে বড় মনকাড়া আওয়াজ মিনি আর মিনির বন্ধুদের প্রতি বছরের।... এবার সে আওয়াজে
প্রাণে কাঁপন ওঠে না। শুধুই ছেড়ে যাওয়ার শূন্যতা আর বেদনাটুকু। সে সব
ধ্বনি প্রতিধ্বনি বেশ দূরের এখন। খুব কাছে রাজকীয় মখমল ছাওয়া দুই চেয়ারে
একটু পর ই প্রজ্ঞা, রক্তিমের যৌথ যাপনের সই সাবুদ। অফিসের লোকজনের আনাগোনা।
শিলিগুড়ি কলকাতা থেকে অভিজিত মিত্রের অফিসের যাঁরা এসেছেন তাঁরা নিয়ে
এসেছেন রজনীগন্ধা আর লাল গোলাপের অপূর্ব স্বাস্থ্যকর সুগন্ধী দুটো মালা।
যা একটু পরই একে অন্যের গলায় পরাবে। সামনে অর্জুন চত্বর সাজ সাজ। খাওয়া
দাওয়া রান্না পর্ব। সব বাড়িতে। বিহার থেকে বহুদিনের মথুর ঠাকুর দুই
অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়ে উপস্থিত। দুপুরের একপ্রস্থ ভোজন পর্ব শেষে রাতের
আয়োজন। নিরামিশ, আমিষ দুইই। কলাপাতা, খুড়ি। আর সবচেয়ে ভালো মাছ, মাংস আর
পোলাও গন্ধ।...
মিনির পরণে কতদিন আগের আলমারিতে তুলে
রাখা বেনারসের বেনারসি। প্রতীতী সেই স্কুলের প্রিয় বন্ধু ওকে সাজিয়ে
দিচ্ছে।...কেন সাজাচ্ছিস এত? খুব স্বাভাবিক রাখবি।... মা কোথায় মা? মাথা
ঘুরছেতো! মাকে দেখছিনা যে! মনো আর সুমিত্রা মাসি তড়িঘড়ি এ বাড়ির ছোট বৌকে
খোঁজে...কোথায় কাকিমা...মিনি যে ডাকছে।..
হ ই হ ই।
জেঠিও ধারে টাছে নেই। ওদের কি মনখারাপ! একেবারে হাত ছেড়ে দেওয়ার মানুষতো মা
নন। তাহলে! প্রতীতী, পুলোমা ওকে একখিনা সুন্দর বড় ফুলদানি তুলে দেয়।
শাড়িতে পিন করে দিতে দিতে বলে...আরে! মাকে কি বিয়ের কাছাকাছি থাকতে হয়?...
ধুর্ আমি কি শালগ্রাম সাক্ষী করে
বিয়ে করছি নাকি?
আমার পরিচয়তো মানুষ। নো গোত্র নো কমিউনিটি। দু বাড়ির মতেই এটা হচ্ছে। আর
আমিতো সেই কোন কাল থেকে জানি ঐ হাতে হাত ঢেকে নতুন গামছায়,সংস্কৃত মন্ত্রের
অবুঝ কিছু উচ্চারণ আমার বিয়েতে হবেনা। শুধু তোর্সা ছোঁয়া বন্ধুরা সব এসেছে
দেখ।...মিলু ওর বোন মা সহ, রতু,রঞ্জু এমনকি ঘনাও এসেছে কতদূর থেকে দেখ। আর
এক পাড়া লোক। আমরা যারা তোর্সার বাঁধের এপাড় ওপাড় সবাই আছি আজ। ভালো
লাগছে।
একটু আগেই রক্তিমের মামা মামী এসে আশীর্বাদ
করে গেছেন। এখন খানিকটা উঠোনের হালকা হাওয়ায় আলোর এফোড় ওফোড় তল্লাটে ভেসে
আসছে বিসমিল্লার নাতির বাজানো সানাই সুর।...ইস্ একবার তোরণটা দেখতে পাব না?
কাল তো খুলেই ফেলবে। প্রতীতী বলল, চল্ দেখে আসি।... নিমগাছের ছায়ায় কে ও?
পুনু! গলার কাছে ব্যথা করে। মার সঙ্গে মনো দাঁড়িয়ে আছে না! খাওয়ার
পরিবেশনে লেগে গেছে ঘনাও। পাড়ার অন্যান্য ছেলেরা। বুকে্য ভিতর মোচড় দেয়।
....মালকোষ বাজছে। মিনির বুকে'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে' বেজে যায়। বাইরের
দরজায় সেজেগুজে দাঁড়ানোটায় কেমন লজ্জাবোধ হয়। মাথার ভিতর বিদ্যুৎ ঝেঁকে
ওঠে। দ্রুত ঘরে চলে যায় সে।
সিঁথির সিঁদুরের রোমাঞ্চ
ভাবনা তখন মিনির ভিতর ঝরনা তৈরি করছিল।পাড়ার মেয়ে বৌরা অদ্ভুত গল্পের টুকরো
তুলে নিচ্ছে এ বাড়ির অন্দর মহলে ঢুকে।...ওরে জানিসতো? মিনির বিয়েতে কিন্তু
কোন পুরুত নেই, জেঠামশায় শালগ্রাম শিলা এনেছিলেন, অভিজিতদা সোজা ঠাকুরঘরে
পাঠিয়ে দিয়েছেন।এখন সাক্ষীর স ই সাবুদ চলছে।...আরে আত্মীয়দের মধ্যে মন
কষাকষিও চলছে শুনেছি। হ্যাঁ হ্যাঁ সিঁদুর দান, জম্পেশ দুখানা মালা বদল সব
তোফা।আর যা খেলামনা! মনে থাকবে।
অভিজিত মিত্র কি ইচ্ছে করেই নিজেকে এত ব্যস্ত রেখেছেন?
* * *
যাও কইন্যা যাওরে/ অন্য নদীর পাড়.../লিইখ্যা রাইখ্য বুকের কথা/ দিয়া সারাৎসার...
বাঁশি
গায়। রাত পোহায় একরকম। বিকেল তিনটেয় খাওয়ার পাট চুকেছে। তোর্সার ধারের
হাওয়া বয় বিকেলের। কান্না্য জল কি নদী হয়, বাবার বুকে কি কাঁপন ধরে! মিনির
হাত ধরে কেউ। কোন পুরুষ,অন্য পুরুষ! সেকি বাবার মত, না কি তোর্সার মতো
বন্ধু, অজস্র শঙ্কার কালো ধোঁয়া না আনন্দের স্নিগ্ধ পাপড়ি! সে রাতে কি
আলেয়া জ্বলেছিল? শুধু ঝাপসা চোখে মিনি দেখেছিল বিকেলের নিভে আসা আলোয় ঘনা
হেঁটে উঠে যাচ্ছে বাঁধ বরাবর। পিছনে একবার ও না তাকিয়ে।সূর্যটার শরীরে
বিরাট ছায়া তখন।লাল গোলকটা আঁচলে বেঁধে নিয়ে চলল প্রজ্ঞা অন্য নদীর
কাছে...