আমি এক যাযাবর-১৪/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
( চতুর্দশ পর্ব)
শৌভিক কুন্ডা
শিলিগুড়ি জাংশন ছাড়ানোর কিছুক্ষণ পরেই গুলমা। ছবির মতো সুন্দর একটি স্টেশন। পেছনে অরন্য। সরু পায়ে চলা পথ ট্রেন রাস্তার পাশে। ছোট্ট কংক্রিটের সাঁকো। কিন্তু এবার গন্তব্য অন্য। তাই ছবিটিকে পথের পাশেই রেখে যেতে হয়। ওদিকের আসনে চারজন, দুই দম্পতি, আমারই বয়সী হবেন, প্রথমে বৌমা-শাশুড়ী, তারপর বাদাম চিঁড়েভাজা নিয়ে গল্পে ব্যস্ত। জঙ্গলের সৌন্দর্য, সবুজের হাজার শেডের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। এভাবেই সেবক এলো। ট্রেন পথে এদিকে আমিও প্রথম। দু চোখে, মনে শুষে নিচ্ছি দুপাশের সবটুকু। সেবকের লম্বা বিরতি পেরোতে পেরোতে, ও তল্লাট থেকে এবার ডলারের হিসেব ঢক্কানিনাদে কানে এলো। ইহার নাম ভিস্তা ডোম। যথেষ্ট দামে টিকিট কেটেছি। এসি কুর্শিতে গা এলিয়ে, কাচের জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে রেলদপ্তর, তাতে সকলেরই কিছু আসে যায় না। এবার আবার চিপসের প্যাকেট খুঁজে না পাওয়ার ক্ষোভ মিস্টির বাক্সোতে কিছুটা কমলো। গাছের দল ধাপে ধাপে কিভাবে উঠে যায় পাহাড়ের গা বেয়ে, সেটা এরা দেখতে চান না।
এক এক করে পেইন্টেড স্টেশনস হুইসল বাই। বাগরাকোট। নিউ মাল। চালসা। নাগরাকাটা। ক্যারন। বিন্নাগুড়ি। বানারহাট। দলগাঁও(বীরপাড়া)। মুজনাই স্টেশনের পেছনে হকির গোলপোস্ট বলে ভুল হ'ল, নাকি রাগবির? আসলে, সদ্য অবসর নিয়েছি যে স্কুল থেকে, সেখানকার আবাসিক ছেলেগুলো অনেকেই এসব অঞ্চল থেকে পড়তে যায় আমার স্কুলে। ওদের মুখেই এদুটো খেলার কথা শুনেছি। মাদারিহাট আসে। বিরক্তিকর বিরতি। হাসিমারাতে ডলারের দল নেমে গেলেন গাড়ি নোংরা করে, বাদামের খোসা, মিস্টির প্যাকেট ছড়িয়ে রেখে! ওঁরা এসেছেন জলদাপাড়া ঘুরতে, লাখ-ডলারের ফাঁক গলে এ তথ্যগুলো কানে এসেছিলো। অন্য যে পরিবারটির সাথে পথচলতি পরিচয়, তাঁদের গন্তব্য শেষ স্টেশন, আলিপুরদুয়ার। আমি তার আগের স্টেশন রাজাভাতখাওয়াতে। স্থানীয়রা বলেন ভাতখাওয়া। যাবো সান্ত্রাঁবাড়ি। বক্সাভ্যালি হোম-স্টেতে বুক করে রেখেছি। ফোনে ফোনে যোগাযোগ থেকেছে ওখানকার তত্ত্বাবধায়ক সঞ্জীব রায়ের সাথে। সেইমতো পেয়ে গেছি অটোচালক বিট্টুর নাম্বার। সে রাজাভাতখাওয়া থেকে আমাকে নিয়ে যাবে সান্ত্রাঁবাড়ি। ট্রেন আধঘন্টা দেরিতে পৌঁছলো। ভিস্তাডোমে খাবার পাওয়া মুশকিল খুব। কফি আর চিপস শুধু। তা-ও চিনি ছাড়া কফি না। সুতরাং ক্ষিধে বেশ চাড়া দিয়েছে। ট্রেন থেকে নামতে না নামতেই বিট্টুর ফোন, স্টেশনের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে বনবিভাগের বুকিং কাউন্টার। বিটিআর বা বক্সা টাইগার রিজার্ভ বনাঞ্চলের কোর এলাকার প্রবেশদ্বার এই রাজাভাতখাওয়া। এই চেকপোস্ট পেরোতে গেলে অনুমতিপত্র নিতেই হবে। সেসব জোগাড় করে অটো ছুটলো সাঁ সাঁ করে। দুদিকে জঙ্গল রেখে প্রায় ২০ কিলোমিটার রাস্তা। মাঝে ২৮ মাইল বস্তিতে দু চারটি দোকান আর তার কয়েকগুণ বেশি সংখ্যায় হোম-স্টে! তাদের ছাড়াতে ছাড়াতে বোঝা যায় ওপরের দিকে উঠছি। তবে গরম যথেষ্ট। ম্যানেজার কৌশিক আর কেয়ারটেকার সঞ্জীব গেটের মুখেই দাঁড়িয়ে। আন্তরিক অভ্যর্থনা আরও উষ্ণতা পেলো চায়ের কাপে। ঘরের, ওয়াশরুমের পরিচ্ছন্নতায়। কিন্তু স্পষ্টতই, নামে শব্দটা থাকলেও এটি আদৌ হোম-স্টে নয়। রিসর্টই বলা উচিৎ। বিশাল চত্বর জুড়ে বেশ কয়েকটি কটেজ, ধাপে ধাপে ছড়ানো ছেটানো। নীচ থেকে ওপরের দিকে উঠতে সুন্দর রঙ করা সিঁড়ি। আর গাছ। নানা কিসিমের গাছ। তবে ফুলের গাছ খুব কম, মূলত ফলেরই। কারণটা পরে সঞ্জীবের মুখ থেকে জেনেছি। হোম-স্টে যাপনের অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে, এ ধরনের সভ্যতার ছোঁয়া ছাড়ানো অঞ্চলে মাছ খাওয়াকে যতটা পারা যায় এ্যাভয়েড করাই ভালো। সেমতোই সঞ্জীবকে বলে রেখেছিলাম। তাই দুপুরের পাতে ডাল, বেগুনভাজা, বাঁধাকপি, আর স্কোয়াশ ঘন্ট। সঞ্জীবের ঝাল দেওয়ার হাতটা একটু বেশিই। ভাগ্যিস তেলের ক্ষেত্রে তুলনামূলক কম উদার সে! তবে ক্ষিধের পেটেমুখে ঝালের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে খুব খারাপ লাগে নি। বেশ পরিশ্রম হয়েছে বাস-ট্রেন-অটো মিলে সফরের এ অংশে। সুতরাং এ বার এসি চালিয়ে ব্ল্যাংকেট টেনে শুতে না শুতেই দিব্য ঘুম এসে গেল!
(চলবে)
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴