অন্তহীন আকাশের নীচে/১৪
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ১৪
দেবপ্রিয়া সরকার
-------------------------------
সন্ধে গভীর হয়ে পা বাড়াচ্ছে রাতের দিকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চোখে পড়ছে সান্ধ্য আড্ডার ছবি। সওয়ারি স্বয়ংদ্যুতির অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অপেক্ষাকৃত কম গতিতে বাইক ছোটাচ্ছ ইন্দ্রায়ুধ। এই শহর আর তার অতীত-ঐতিহ্য নিয়ে স্বয়ংদ্যুতির কৌতূহলের শেষ নেই। ইন্দ্রায়ুধও সাধ্যমতো চেষ্টা করছে তার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। কখনও কখনও কথা বলতে বলতে তার খুব কাছাকাছি চলে আসছে স্বয়ংদ্যুতি। তার দেহের আলতো ছোঁয়ায় শিহরণ খেলে যাচ্ছে ইন্দ্রায়ুধের শরীরে। কানের কাছে মুখ এনে স্বয়ংদ্যুতির অনর্গল বলে যাওয়া কথা শুনতে শুনতে অদ্ভুত এক ভাললাগা ঘিরে ধরছে ইন্দ্রায়ুধকে। ভীষণ ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তটাকে মুঠোয় বন্দি করে রাখতে।
সাগরদিঘির পশ্চিম দিকে টেম্পল স্ট্রিট ধরে কিছুটা যাওয়ার পর একটা পুরনো দিনের গাছগাছালি ঘেরা বাড়ির সামনে এসে স্বয়ংদ্যুতি বলে উঠল, স্টপ স্টপ! পৌঁছে গিয়েছি। এটাই আমার দিদার বাড়ি। ভাল করে চিনে রাখো। আগামীকাল আসতে হবে কিন্তু। কোনও অজুহাত শুনব না।
-টুপুর! এতক্ষণে তোর ফেরার সময় হল?
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল স্বয়ংদ্যুতি। পরিচিত গলার স্বর শুনে পেছন ফিরে দেখল অরুন্ধতী রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বড়সড় চোখ পাকিয়ে একবার তাকে দেখছে আর একবার ইন্দ্রায়ুধকে। সঙ্গে রয়েছেন রাধাকান্ত। তাদের দেখেই হাসিমুখে স্বয়ংদ্যুতি বলল, আরে দিদিভাই! তোরা কোথায় গিয়েছিলি?
রাধাকান্ত এগিয়ে এসে বললেন, টাপুরকে নিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওকে আমাদের পুরনো বাড়িটা দেখাব। কিন্তু গিয়ে দেখলাম বাড়ি গুঁড়িয়ে ওখানে মাথা তুলেছে এক পেল্লায় আবাসন। রায়বর্মণরা স্হানীয় লোক, মনে করেছিলাম ওরা হয়তো বাড়িটা অক্ষত রাখবে। শুনলাম তারাও নাকি বাড়ি ঘরদোর সব প্রমোটারের কাছে বেচে দিয়ে শিলিগুড়ি চলে গিয়েছে।
রাধাকান্তর গলা থেকে ঝরে পড়া বিষাদ ছুঁয়ে গেল সকলকে। স্বয়ংদ্যুতি বলল, মন খারাপ করে কী আর করবে বাবা? সমস্ত পুরনো জিনিসই হারিয়ে যাচ্ছে একটু করে। বাড়ির আর কী দোষ?
-তবে কী জানিস টুপুর একটা বিষয় দেখে খুব ভাল লাগল। বাড়িটার নীচের ফ্লোরে একখানা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কোচিং সেন্টার করেছে কয়েকজন যুবক। ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে সেখানে। বাবা ছিলেন সেই রাজ আমলের শিক্ষক। পড়াশুনোর প্রতি গভীর নিষ্ঠা ছিল তাঁর। আজ বাড়িটা না থাকলেও সেই জায়গায় যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে সেটা দেখে ওপর থেকে হয়তো খুশিই হচ্ছেন বাবা।
এতক্ষণ নিঃশব্দে রাধাকান্তদের কথা শুনছিল ইন্দ্রায়ুধ। এবার বাইক থেকে নেমে রাধাকান্তকে চমকে দিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল সে। বলল, আপনি রাধাকান্ত জেঠু, তাই না? আমি ইন্দ্রায়ুধ। বাবার মুখে আপনার নাম বহুবার শুনেছি।
ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়েছেন রাধাকান্ত। বললেন, আরে থাক থাক আবার প্রণাম টনাম কেন? মাফ করবেন ভাই, আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না! আর আপনার বাবা...
রাধাকান্তকে মাঝ পথে থামিয়ে ইন্দ্রায়ুধ বলল, আমার বাবা স্বর্গীয় সরোজেন্দ্র দে সরকার আপনার সহপাঠী ছিলেন। জেনকিন্স স্কুলে আপনারা একসঙ্গে পড়তেন শুনেছি।
-ওহো! তুমি সরোজের ছেলে! খুব ভাল লাগছে তোমায় দেখে। তবে সরোজের নামের আগে স্বর্গীয় শব্দটা শুনতে হবে, আশা করিনি। তোমার বাবা আমার থেকে বয়সে সামান্য ছোট হলেও আমরা একসঙ্গে লেখাপড়া করেছি। ক্লাসে প্রতিযোগীতা চলত আমাদের। একবার সরোজ ফার্স্ট তো আমি সেকেন্ড, পরেরবার আবার ঠিক তার উল্টোটা। পাশ করার পর সরোজ চলে গেল ইউনিভার্সিটিতে আর আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে শুরু করলাম আমলাগিরি। কোচবিহার এলে দেখা হত মাঝেমধ্যে। তখন তো এতো ফোন টোন ছিল না। যোগাযোগের সুতোটা সরু হতে হতে একসময় ছিঁড়ে গেল। আমিও কোচবিহার আসা কমিয়ে দিলাম, তাই ওর চলে যাওয়ার খবরটা পাইনি। কী হয়েছিল সরোজের?
-ক্যানসার। কোলনে। ট্রিটমেন্ট হয়েছিল প্রচুর কিন্তু বাঁচাতে পারিনি।
-ওহ্! ভেরি স্যাড!
মূহুর্তের মধ্যে আবহাওয়াটা ভারি হয়ে গেল। ইন্দ্রায়ুধের বিষন্ন মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল স্বয়ংদ্যুতি। পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বলল, জানো বাবা ইন্দ্র খুব ভাল ছাত্র। ইউনিভার্সিটি টপার। হিস্ট্রিতে পি এইচ ডি করছে। আমাদের হেড ডিপ অনির্বাণ স্যার তো ওর প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ!
-বলিস কী! তা পি এইচ ডি ছাড়া আর কী করছ এখন?
-সি এস সির প্রিপারেশন নিচ্ছি। আগামী সপ্তাহে কলকাতায় ইন্টারভিউ। এর পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টারেও পড়াচ্ছি। একটু আগে আপনি যে সেন্টারটার কথা বলছিলেন তার সঙ্গে আমিও যুক্ত।
-বাহ্! খুব ভাল ইয়ংম্যান। উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট ফর ফিউচার। তা আগামীকাল আসছ তো? এই টুপুর ওকে নিমন্ত্রণ করেছিস?
-হ্যাঁ বাবা বলেছি। কিন্তু উনি ব্যস্ততার অজুহাত দিচ্ছেন।
একটু বাঁকা স্বরে কথাটা বলল স্বয়ংদ্যুতি। ইন্দ্রায়ুধ আড় চোখে তাকালো তার দিকে। রাধাকান্ত বললেন, কেন? অজুহাত দিচ্ছে কেন?
ইন্দ্রায়ুধ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না না তেমন কিছু নয়, আসলে কোচিংয়ে পরপর ক্লাস থাকে আমার, তাই বলছিলাম...
-উঁহু সেসব তো শুনব না। আগামীকাল তুমি আসছ দ্যাটস্ ফাইনাল। জমিয়ে আড্ডা দেব আমরা, কেমন?
ইন্দ্রায়ুধের পিঠ চাপড়ে ঘরে ঢুকে গেলেন রাধাকান্ত। অরুন্ধতী এগিয়ে এসে তার ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ইটস্ নাইস মিটিং ইউ ইন্দ্রায়ুধ। আমি টাপুর। আগামীকাল তবে দেখা হচ্ছে আমাদের।
একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হেসে অরুন্ধতী ভেতরে চলে গেল। স্বয়ংদ্যুতি বলল, আর তো কোনও এক্সইউজ ধোপে টিকবে না ইন্দ্রবাবু, কাল আসতেই হবে আপনাকে।
-আসব।
লাজুক হেসে উত্তর দিল ইন্দ্রায়ুধ, তারপর স্টার্ট দিল বাইকে। যতক্ষণ সে দৃষ্টি পথের সীমায় থাকল ততক্ষণ তাকে দেখতেই থাকল স্বয়ংদ্যুতি। ইন্দ্রায়ুধও রাস্তার মোড়ে বাঁক নেওয়ার আগে একবার পেছন ফিরে চাইল। স্বয়ংদ্যুতি তখনও দাঁড়িয়ে আছে দেখে উচ্ছ্বাসের ঢেউ খেলে গেল তার মন জুড়ে। উথাল-পাথাল আনন্দের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফিরল ইন্দ্রায়ুধ। রাতে খাবার সময় মায়ের কাছে গল্প করল রাধাকান্ত এবং স্বয়ংদ্যুতির। আগামীকাল ঊষারানীর জন্মদিনের নিমন্ত্রণের কথাও মাকে জানিয়ে রাখল আগে ভাগে।
ইন্দ্রায়ুধের মন আজ আর নিজের বশে নেই। বারবার তার দখল নিচ্ছে স্বয়ংদ্যুতি। চোখ বন্ধ করলেই গতকাল থেকে তার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তের ছবি ফিরে ফিরে আসছে। স্বয়ংদ্যুতির চোখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন কোনও এক অতল খাদে তলিয়ে যাচ্ছে সে। তার উচছ্বলতা, অনর্গল কথা বলার ধরন সবকিছুই ভীষণ ভীষণ ভাল লাগছে ইন্দ্রায়ুধের। মোবাইল ফোনে ইউটিউব খুলে সে স্বয়ংদ্যুতির চ্যানেলটা খুঁজে নিল। কোচবিহার আসার আগেই স্বয়ংদ্যুতি তাকে কয়েকটা ভিডিওর লিংক পাঠিয়ে রেখেছিল। সেগুলো দেখতে দেখতে একটা আচ্ছন্নতা ঘিরে ধরছিল তাকে। ঘোর ভাঙল শব্দ করে হোয়াটস্ অ্যাপে মেসেজ আসায়। আজ রাজবাড়িতে তোলা বেশ কিছু ছবি পাঠিয়েছে স্বয়ংদ্যুতি। ইন্দ্রায়ুধ এক এক করে সেসব দেখে লিখল, খুব সুন্দর হয়েছে ছবিগুলো।
ওপাশ থেকে উত্তর এল, সত্যি?
-একদম।
-কাল কখন আসছ?
-তুমি যখন বলবে।
-আমি তো বলব সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে আসতে। আসবে?
উত্তরে গোটা তিনেক হাসির ইমোজি পাঠাল ইন্দ্রায়ুধ। স্বয়ংদ্যুতি লিখল, তুমি বলেছিলে চিলা রায় সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন শেয়ার করবে। কবে পাঠাবে সেগুলো?
-এক্ষুনি পাঠাচ্ছি। একটু অপেক্ষা করো।
ল্যাপটপ থেকে ঝটপট বেশ কিছু ডকুমেন্ট কপি করে ইন্দ্রায়ুধ মেইল করে দিল স্বয়ংদ্যুতিকে। তারপর হোয়াটস্ অ্যাপে ফিরে এসে লিখল, পাঠিয়ে দিলাম। দেখে নিও।
স্বয়ংদ্যুতি বোধ হয় ইন্দ্রায়ুধের মেসেজের অপেক্ষাতেই বসেছিল। তাই ঝটিতি উত্তর দিল, কী বলে যে ধন্যবাদ দেব? তোমায় যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। মাত্র একদিনের পরিচয়েই তোমার মেহনতের ফসল আমার হাতে তুলে দিলে? অবিশ্বাস্য!
ইন্দ্রায়ুধ লিখল, শুধু চিলা রায়ের বীরত্বের কাহিনিই নয়, মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণের সাহিত্যপ্রীতি, নৃপন্দ্রনারায়ণ ভূপবাহাদূরের প্রজাবাৎসল্য ও সুশাসন, মহারানী সুনীতি দেবী এবং ইন্দিরা দেবীর মতো আধুনিকমনস্ক নারীদের কথা তোমার ভ্লগের মাধ্যমে সারা দেশের মানুষের কাছে যদি পৌঁছতে পারে তবে সেটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
-তোমার মতো মানুষ আমি আর একটাও দেখিনি ইন্দ্র। যার কাছে নিজের রিসার্চ, কেরিয়ারের থেকেও বড় হয়ে উঠেছে জন্মভূমি আর তার ইতিহাসকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া!
আবারও একটা হাসির ইমোজি পাঠাল ইন্দ্রায়ুধ। তারপর লিখল, গবেষণার বিষয় হিসেবে কোচ-কামতারাজইতিহাসকে বেছে নেওয়ার পেছনে আমার উদ্দেশ্যই ছিল বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে থাকা ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে জানা এবং তাদের জনসমক্ষে নিয়ে আসা। কিন্তু আমার ক্ষমতা সীমিত। থিসিস আকারে আমি যা লিখব তা অবশ্যই কোনও একটা জার্নালে প্রকাশিত হবে এবং সেটা পৌঁছবে অল্পসংখ্যক মানুষের কাছে। তাই যখন অনির্বাণ স্যার তোমার কথা বললেন আমি দ্বিতীয়বার ভাবিনি, একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ইউটিউবের থেকে ভাল প্ল্যাটফর্ম আর একটা নেই। তোমার ভিউয়ারস্ সংখ্যাও প্রশংসনীয়। কোচ রাজকাহিনি নিয়ে তুমি যে কনটেন্ট তৈরি করবে সেটা হবে একেবারে ইউনিক, আনটোল্ড স্টোরি। এই ভ্লগ তোমার চ্যানেলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
-তাই যেন হয় ইন্দ্র। মেইলের ডকুমেন্টগুলো সব ডাউনলোড করে ফেললাম। এখুনি পড়া শুরু করব। এখন চলি? শুভ রাত্রি।
ফোন বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল ইন্দ্রায়ুধ। অনেক চেষ্টা করেও ঘুম আসছে না। অস্থির হয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে সে। তার সমস্ত চেতনা জুড়ে বর্ষার প্রথম মেঘের মতো ছেয়ে আছে স্বয়ংদ্যুতি। তার কথার অনুরণন, হাসির ঝংকার টুপটাপ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে ইন্দ্রায়ুধের শ্রুতিতে। মোহময়ী দু’খানা চোখ, সোনালি চুলের গোছা, হালকা গোলাপি আভাযুক্ত ঠোঁটের ছবি ভেসে উঠছে মনের আরশিতে। রাতটাকে বড্ড লম্বা মনে হচ্ছে ইন্দ্রায়ুধের। এমন অসহনীয় রাত আগে কখনও তার জীবনে আসেনি।
বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় ছটফট করে উঠে বসল সে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল মেঘ ছিঁড়ে ভাঙা চাঁদ উঠেছে আকাশে। একটা রাতচরা পাখি ডাকছে কোথায় যেন। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে এগিয়ে চলছে আর ইন্দ্রায়ুধ অপেক্ষা করছে এই নির্ঘুম রাতের শেষে সকাল হবার। নববর্ষের নবীন ভোরে নিজেকে সে নতুন করে চিনবে আজ। সাক্ষী হবে নতুন এক সূর্যোদয়ের।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴