শূন্য আমি পূর্ণ আমি
পর্ব : ১৩
অমর চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^
সুজন পাঠক, শীতকাল এলেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। একসময় তো শতাধিক পেনিসিলিন নিয়েছি। আজ অবশ্য ওরাল এন্টিবায়োটিক নিই।ফলে শীতের সময় বড় কষ্ট। লেখায় টান পড়ে।আজও একটু সংক্ষিপ্ত এবং এক সফল মানুষের গল্পে শেষ করব। ১৯৭৮ সাল, আমি গ্র্যাজুয়েট হয়ে চাকরি খুঁজছি। শেষে টিউশন ও সাংবাদিকতা। সেই সময় খুব বড়লোকের ছেলে মেয়েরাই পয়সা দিয়ে টিচার রাখতে পারত। আমার নিজের পড়ার জন্য প্রাইভেট টিউটর! তখন পরীক্ষায় আসা প্রবাদ বাক্যে এটাই লিখেছিলাম, এ হল আকাশ কুসুম কল্পনা! টিউশনির পয়সায় রাখতে শুরু করলাম দৈনিক যুগান্তর ও অমৃত সাপ্তাহিক পত্রিকা। ভাগ্যিস, যুগান্তর আর অমৃত রাখতাম! তাই তো যুগান্তর-এর কার্টুনিস্ট অমল চক্রবর্তীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক হয়। অমলদা এখন দৈনিক প্রতিদিন পত্রিকায় অমল আলোয় নামে ছবি আঁকেন। ওনার কথা পরে বলব। অমৃত না রাখলে হয়তো পেতাম না দারাশুকোর প্রণেতা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে। আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক ঈশ্বরীতলার রূপোকথার 'শাহজাদা দারাশুকো'। রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, সমরেশ বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়,
গৌরকিশোর ঘোষ আমার প্রিয় লেখক তালিকায় চির উজ্জ্বল থাকবেন। সেই অমৃত পত্রিকার শেষ পাতায় একটি বিজ্ঞাপন ছিল - সিনেমা যাত্রা ও সংস্কৃতির এই পাক্ষিকের জন্য সাংবাদিক প্রতিনিধি চাই। ব্যস্ দিলাম এপ্লাই করে। কারণ আমি ততদিনে বুঝেছি রাজনৈতিক জগৎ নয় আমার জায়গা সংস্কৃতির জগৎ। কলকাতায় যাবার ডাক পেলাম। আবার কষ্ট করে কলকাতা।যাবার টিকিট পেলাম, আসা জানি না! পৌঁছলাম বেহালার ১০৮/বি-এর বাড়ি। সামনে একটা ছোট্ট প্রেস। একজন বসে আছেন। আমি বললাম, অঞ্জন চৌধুরী? বেটেখাটো মোটা একজন মানুষ, হাসিটা মিষ্টি । বললেন - হ আমি অঞ্জন। আরে তুই তো পোলাপান তরে আমি আপনি লিখেছি!আর একটি ছেলে ছিল বলল, যা তর বৌদিকে ক গিয়া কুচবিহার থিকা আমার ভাই আসছে। চাল নেয় যেনো। অঞ্জনদা আমার প্রিয় অঞ্জনদা, জয়শ্রী বৌদি, চুমকি রুমকি বাবু অর্থাৎ সন্দীপ চৌধুরী। কি দারিদ্র কি দারিদ্র। বড়লোকের ছেলে অঞ্জন চৌধুরীর ধর্মতলায় পারিবারিক প্রেসের ব্যবসা। শুধু সাহিত্য সিনেমা আর বৌদির টানে বেহালায় ছোট্ট একটা ঘরে। বৌদি ছেলে মেয়ে নিয়ে খাটে আমি আর অঞ্জনদা মেঝেয়। শুয়ে কিন্তু ঘুম নেই। শোন আমি তো চুমকীতে লিখলাম উত্তমকুমার তোমার চোখের জলে টালিগঞ্জের ঋণ শোধ করতে হবে কিন্তু পত্রিকা কে পৌঁছে দেবে! বেহালার এক সাহসী ছেলেকে পত্রিকা দিয়ে পাঠালাম। এরমধ্যে একটা লেখায় রণজিৎ মল্লিকের অভিনয় নিয়ে লিখেছিলাম রণজিৎ চলে আসে আমার দশফুট বাই দশফুটের এই ভাড়া বাড়িতে। তো সেইসময় রণজিৎ মল্লিকের দেবী চৌধুরানীর সেট পড়েছে এন.টি ওয়ানের এক নম্বর ফ্লোরে। তো ছেলেটি স্টুডিও গিয়ে রণজিৎদাকে বলে। রণজিৎদা দেখিয়ে দিলেন পাশের ফ্লোরের মেকাপ রুমে আছে দিয়ে এসো।ছেলেটি নক করাতে উত্তম কুমার বলেন এসো।ছেলেটি পত্রিকাটা টেবিলে রেখে দৌড়। উত্তম কুমার বলেন ছেলেটাকে ডাকো। ও কি আর আছে! এমন ছিল উত্তম কুমারের ব্যক্তিত্ব। পরে উনি রণজিৎ মল্লিককে বলেছেন অসাধারণ লিখেছেন ছেলেটাকে এনো তো! শুয়ে শুয়ে এমন হাজারো গল্প। তখন মঞ্চে দাপিয়ে মিস শেফালী, সম্রাট ও সুন্দরী, বারবধূ। তথ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অঞ্জনদা লিখলেন, বাংলা নাটক এখন Aদের দখলে। এক পরিচালক গুন্ডা দিয়ে তুলে নিয়ে হাত কেটে নিতে চেয়েছিল। সাহস কাকে বলে অঞ্জনদাকে দেখেছি। সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অপর্ণা সেন কারো পছন্দ নয় চুমকী। কোচবিহার সার্কিট হাউসে এক সাক্ষাৎকারে জটায়ু সন্তোষ দত্ত আমাকে বলেছিলেন চুমকী শ্মশানে যাবে আপনারা হবেন শববাহক। এইরকম পত্রিকা চুমকী আর দুঃসাহসী সম্পাদক অঞ্জন চৌধুরী। চোখে স্বপ্ন সিনেমা বানানোর। কিন্তু পরদিন কি খাবেন জানেন না! মাথার ওপর মা কালীর ছবি। আমিও কর্মহীন। বললেন ওই যে উনি আছেন সব হবে।পরে স্টুডিওতে দেখেছি অঞ্জনদার অফিস ঘরে মাথার ওপরে বিশাল মাতৃমূর্তি। তখন অঞ্জলি হিট ছবি চলচ্চিত্র উৎসবে দেখাচ্ছে। কিন্তু সেদিন যার ঘরে খাবার ছিল না সেই মানুষ স্বপ্ন দেখতেন সিনেমা বানাবেন। এলেন ত্রাতা রণজিৎ মল্লিক। আমি যেদিন গেলাম তার পরদিন রণজিৎ মল্লিক এলেন হাতে স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের বিদেশি বই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল আমি ছাতা ধরে ভেতরে আনলাম। বই ছাড়াও আরো অনেক কিছু দিলেন। তৈরি হচ্ছেন ভাবী চিত্রনাট্যকার অঞ্জন চৌধুরী। রণজিৎ মল্লিক উত্তরবঙ্গ এবং দেবী চৌধুরানী নিয়ে আমার কাছে শুনলেন। পরে ভবানীপুরে বিখ্যাত মল্লিক বাড়িতেও গেছি। ট্রামে সেকেন্ড ক্লাসে আমি আর অঞ্জনদা । অঞ্জনদা দেখালেন ঐ যে মানুষটি যাচ্ছেন ওঁর নাম বিভূতি লাহা (অগ্রদূত) উনি উত্তম কুমারকে কত হিট ছবি দিয়েছেন। আজ দেখ কি অবস্থা! অমর একটা কথা বলি ভাই এই জগতে আসার চেষ্টাও করবি না। তবে আমি যদি বানাই ডাকব। কিন্তু আমার কি হবে দাদা!
অঞ্জনদাকে নিয়ে এত লিখছি কেন? এই মানুষটির কাছ থেকে জেনেছি ধৈর্য নিষ্ঠা থাকলে সাফল্য আসবেই। হ্যাঁ এসেছিল তখন আমি আর যাইনি। ততদিনে আমি শিক্ষক। চিঠিতে পত্রিকায় জানছি উত্তম কুমার মারা যাবার পর টালিগঞ্জ শুনশান। প্রযোজক নেই। একটা দুটো ছবি হচ্ছে আর মুখ থুবড়ে পড়ছে। হঠাৎ শোনা গেল একটা ছবি সুপারহিট। নাম লাল গোলাপ। ছবির চিত্রনাট্যকার অঞ্জন চৌধুরী। পরপর বোধন, শঠে শাঠং। টালিগঞ্জে প্রযোজক আসছে। অবশষে শত্রু চিত্রনাট্য সংলাপ পরিচালনা অঞ্জন চৌধুরী।এই শত্রুর একটা ইতিহাস আছে। এর প্রথম নাম ছিল 'হব ইতিহাস' পরিচালক শুভেন্দু চ্যাটার্জী। পুলিশ অফিসার শুভংকর সান্যাল শুভেন্দু চ্যাটার্জী ভিলেন যে চরিত্র মনোজ মিত্র করেছেন সেই চরিত্রে উত্তমকুমার। কিছু শট নেওয়া হয়েছে। ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সুখেন দাস। বর্ধমান পাল্লা রোডে শুটিং। আমার কাছে সেই স্টিল ছবি আছে। সেই ছবি পরে অঞ্জনদা করেন। পাঁচ লক্ষ টাকার ছবি কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। পুলিশ ব্যারাকে দেখানো হত শত্রু। শোলে ছবির মতোই এই ছবির ক্যাসেট সর্বত্র বেজেছে। টালিগঞ্জের বেতাজ বাদশা অঞ্জন চৌধুরী। কত নতুন ছেলেদের কাজ দিয়েছেন।হরনাথ চক্রবর্তী, বাবলু সমাদ্দার, সুভাষ সেন অঞ্জন ঘরানার। পড়ে রইলাম আমি।