শালসিঁড়ি-১৩/বিমল দেবনাথ
শালসিঁড়ি-১৩
বিমল দেবনাথ
^^^^^^^^^^^^^
অপরূপার ফোন বেজে উঠে – ডিং ডং ডিং ডং
অপরূপা ছুটে গিয়ে ফোন তুলে বলে-
- হ্যালো বিকাশ।
- হ্যাঁ, বলছি।
- কেমন আছ? কার কী হয়েছে?
বিকাশের গাড়ি ছুটছে বনের দিকে। মাথার মধ্যে শুঁয়োপোকার মতো কিছু যেন ঘুরপাক খাছে। কিছু ভালো লাগছে না। গাউর এমনিতে খুব দুর্বল তার উপর যা ধকল গেল - বাঁচবে কিনা কে জানে।
- না না আমাদের কারো তেমন কিছু হয়নি। এই যা সব সময় হয় আর কী।
শালসিঁড়ির সৈনিকরা কত কী গোপন করে পরিবারের কাছে; আপনজন সুজনদের কাছ থেকে। আশঙ্কা মনের আগুন; যত বাড়বে তত মন জ্বলবে হৃদয় পুড়বে। আপনজনদের মনে কে আগুন লাগাতে চায়। চেপে যায় জীবনের কত চাপ। চাপে চাপে কত মন কয়লা হয়ে যায়। আবার সেই কয়লাকে জ্বালিয়ে আলো নেয় তাপ নেয় অনেকে। সেই আলো অপরূপাদের বিশ্বাসে চিড় ধরায়।
- টিভিতে যে দেখাল!
- আরে ওদের কথা ছাড়। ওরা একটু বাড়িয়ে বলে। একটু আধটু রঙ না চড়ালে টি আর পি কি বাড়বে।
- তুমি এখন কোথায়?
- আমি বনের দিকে ছুটছি। ট্র্যাংকুইলাইজিঙ্গের পর গাউরের শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। জানি না এখন গাউরটা কেমন আছে। পোস্ট ট্র্যাংকুইলাজেশন দেখভাল ভালো না হলে অনেক সমস্যা হবে। এখন রাখলাম। - ফোন কেটে দেয় বিকাশ।
বিকাশের কথার গভীরতা এতটা ছিল যে অপরূপা নিজেদের কথা বলতেই পারেনি। একদিকে ছেলের জ্বর অন্যদিকে গাউরের শরীরের তাপমাত্রা। দুই তাপে কত অপরূপা প্রতিদিন পুড়ে যায় বিকাশদের অজান্তে। শরীরের রূপের সাথে আস্তে আস্তে ফিকে হয় মনের রঙ। থাইরয়েড হাইপারটেনশন সহ কত কী রোগ হয় অলঙ্কার।
ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসা চিত্তে মনে পড়ে কত কথা- সেবার চাবাগানে চিতাবাঘ বের হয়েছিল। সন্ন্যাসীবাবুরা গিয়েছিল চিতা বাঘটিকে ধরে আনতে। চা গাছের ভিতরে বিদ্যুতের ঝলকের মত চিতাবাঘ দেখা যায় আবার পর মুহূর্তে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। যখনই চিতাবাঘ দেখা যায় তখনই হাজার হাজার লোকের চিৎকার হয়ে ওঠে গগনভেদী। আবার যখন চোখ থেকে হারিয়ে যায় তখন চারদিকে নেমে আসে আশঙ্কা ও আতঙ্ক। কিছু ছেলে আছে যারা অতি উৎসায়ী এবং বেয়াড়া। কোনো কথা কানে নেয় না। ‘কই’ ‘কই’ করে চিতাবাঘ দেখতে গিয়ে আহত হয়েছে কয়েক জন চিতাবাঘের থাবায়। চিতাবাঘের থাবায় লোক যত আহত হয় তত বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে জনতা। বনকর্মীদের প্রাণ হয়ে উঠে ওষ্ঠাগত। সামনে থেকে লড়তে হয় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। সেই দিন সন্ন্যাসীবাবু ছিলেন দলনেতা। সবাই চিতার উপর নজর রাখছিল সতর্কভাবে। কিন্তু কিছু নাছোড়বান্দা ছেলে যেন চিতাবাঘের ল্যাজ টেনে ধরে বের করে আনতে চায়। ছয় ফুট উচ্চতার সন্ন্যাসীবাবু বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একা এগিয়ে যায় চাবাগানের দিকে। হুঙ্কার দিয়ে বার করে দেয় সবাইকে - কারণ চিতাবাঘ যে কোনো মুহূর্তে অতি গোপনে এসে হঠাৎ আক্রমণ করতে পারে। সেই দিন তখনো পর্যন্ত চিতাবাঘ তিন জনকে আহত করে ফেলেছিল। আবার কাউকে আহত করলে বনকর্মীদের উপর আক্রমণ হতে পারে আরো তীব্র । বিকাশ বলছিল-
- বুঝলে অপরূপা
- কী
- আমাদের এই হল করুণ অবস্থা।
- কী।
- আমরা জানি না লোকজন আমাদের কেন আক্রমণ করে। আমরা তো মানুষকে সাহায্য করতেই যাই-
- কেন করবে না। বন্য জন্তু মানুষ মারবে; মানুষের সম্পদ নষ্ট করবে; মানুষ কী করবে।
- আচ্ছা বলত; এই বন্যপ্রাণ যে বনের বাইরে আসে সেখানে কি আমাদের হাত আছে। নেই। বন্যপ্রাণ কী আমদের কথা শুনে চলে। না। বন্যপ্রাণী চলা-ফেরা করে ওদের প্রয়োজন মতো। দরকারে। সেখানে আমরা কী করতে পারি বলত।
- সে যাই বল, তোমাদের কিছু করা উচিৎ।
- কী করা উচিৎ বলে মনে হয় বল।
- সে জানি না বাবা। তোমরা কিছু একটা কর।
- সেই; কেউ জানে না তোমার মতো। আমরাও জানি না। জানি না বলেই আমাদের কত কী করতে হয়। আমাদের মতো করে করতে গিয়ে কত কী হারাতে হয়।
- কেন কী হয়েছে।
- জানো না কী হয়েছে।
- সে কি করে জানব। খবরের কাগজে কত কী লেখা হয়। তোমরা তো ঘরের লোককে বাসী খবর দাও। সে কত দিন আগের ঘটনা আজকে বলছ। বল কী হয়েছিল।
- সেদিনের ঘটনার পর সন্ন্যাসীবাবুর একটা পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল।
- কেন।
- সন্ন্যাসীবাবু চাবাগানের ভিতর একা দাঁড়িয়ে ছিল। বন্দুক নিয়ে - যাতে কিনা কেউ চা বাগানে না ঢুকতে পারে। কিন্ত দ্যাখা গেল হঠাৎ সন্ন্যাসীবাবু পড়ে গেলেন। চারিদিকে হাসির উল্লাস। কেউ দেখতেই পায়নি উল্কার গতিতে কোথা থেকে হঠাৎ চিতাবাঘ সন্ন্যাসীবাবুর পায়ে কামড়ে ধরেছে। স্টাফরা ‘গেল’ ‘গেল’ করে ছুটে যাবার আগে গুলি করল কিন্তু লাভ হল না। ততক্ষণে চিতাবাঘের কামড়ের টানে হাঁটু থেকে পা-টা ঝুলে গেছে। হাসপাতালে নিয়ে যেতেই পা-টা কেটে বাদ দিতে হল - সন্ন্যাসীবাবুর প্রাণ বাঁচাতে। ছয় ফুট উচ্চতার একজন সুদর্শন শক্তপোক্ত মানুষ খোঁড়া হয়ে গেল। বল অপরূপা, সন্ন্যাসীবাবুর কি দোষ; ওখানে যুদ্ধ বাঁধেনি; দাঙ্গা লাগেনি; তা হলে কেন ওর পা-টা গেল। অপরূপার মনে হল বিকাশের চোখের জল ওর হাতে পড়ছে। অপরূপা চমকে ওঠে। অংশু জিজ্ঞাসা করে -
- মা; বাবা আসবে।
অপরূপা দেখে দুই প্রহরের জোৎস্না আমগাছের ছায়া হয়ে ঘরের দুয়ারে পড়েছে। এই ছায়া মায়া বাড়ায়। উঠানে শ্বশুরঠাকুরের লাগানো আম গাছ মনে করায় কত কথা।
- বৌমা এই বাড়ি জমি আমি করেছি তোমার নামে; দেশের বাড়ি বেচে। আমার পাগল ছেলের চোখে যে রঙ তুমি দিয়েছ তা ধরে রেখ গাছের মতো করে। এই পুঁতলাম আম গাছ - তোমাদের রঙকে চির সবুজ করে রাখার জন্য। ছায়া পাবে আমার উত্তর পুরুষ। অপরূপার মনে হয় এ যেন ছায়া নয়- শ্বশুর মশাই পাহারা দেয় তাঁর নাতিকে, প্রিয় বৌমাকে। অপরূপা ভাবে মায়া কী বিচিত্র; মায়ার জন্য কত মিথ্যা বলতে হয়। অপরূপা বলে -
- হ্যাঁ, বলল কাজ শেষ করে আসবে।
- কখন???
- আজ তো রাত হয়ে গেছে। কাল সকালে আসবে হয়তো!
- কেন? বাবা তো অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে। মনে নেই সেবার আমরা যখন বাবার কোয়ার্টারে যাই বাবা রাত্রি চারটায় কোয়ার্টারে ফিরেছিল। তাহলে আজ রাতে কেন আসতে পারবে না?
- বোকা ছেলে আমার। বাবার কোয়ার্টারে থাকা তো ডিউটিতে থাকা। মিঠুদি…
- আসছি বৌদি। বল।
- অংশুর খাওয়া দাও।
মিঠুদি অংশুর খাওয়া নিয়ে আসে। বলে –
- আমি যাই তাহলে বৌদি।
- মিঠুদি, আজ থেকে যাও। অংশুর জ্বরটা একদম যাচ্ছে না। আজ রাতটা থেকে যাও।
বিয়ের পর অপরূপা কত রাত একা একা কোয়ার্টারে থেকেছে। মনে কষ্ট হয়েছে অনেক। ভয় পায়নি কখনো। আজ মন যেন কেমন করছে। সময়টা যে একদম ঠিক নয়। রাত-বিরাতে কখন কী হয়! মিঠুদি বলে-
- ঠিক আছে বৌদি। দরকারে ডাকবে।
অপরূপার মনে পড়ে একবার বিকাশ কোনো কাজে বাইরে ছিল। রাতে হঠাৎ প্রচণ্ড হৈ চৈ। যোগেনদা ডাকছে - ম্যাডাম ম্যাডাম দরজা খুলুন। অপরূপার একদমই ভয় লাগেনি। দরজা খুলে দ্যাখে যোগেনদা দরজার বাইরে পরিবার পরিজন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী হয়েছে বলতে বলে-
- ঘরে এত বড় সাপ ঢুকেছে।
- কী বল, সাপ ঢুকেছে।
বৌদি বলে-
- সে কী যেমন তেমন সাপ। মস্ত বড় সাপ। পিছনের দরজার তলা দিয়ে এসে ঢুকল তারপর কোথায় গেল আর দ্যাখা গেল না। কত করে বললাম ঘরের পিছন দিকটা একটু ভালো করে পরিষ্কার করতে।
- তারপর?
- তারপর আর কী। ঘরে যত শুকনো লংকা ছিল সেগুলো একটা গামলায় রেখে আগুন জ্বালিয়ে বেরিয়ে এলাম। বৌদি, আজ তোমার ঘরে থাকব।
আংশু তখন হয়নি। অপরূপা একা। অপরূপা ভাবে ভালোই হল। বিকাশ তো আসবে না। রাত্রিটা ভালো গাল-গপ্প করে কেটে যাবে।
- আরে ঠিক আছে ঠিক আছে। এসো ভিতরে এসো।
অপরূপা মিঠুদিকে ডাকে-
- মিঠুদি।
- বল।
- থালাটা নিয়ে যাও। খাওয়া-দাওয়া করে নিচের ঘরে শুয়ে পড়।
- তুমি খাবে না।
- সে আমি নিয়ে খেয়ে নেব।
অপরূপা ভাবে; সেদিন সাপের কথা শুনে তাঁর কোন ভয় লাগেনি। আজ টিভির কথা শুনে কেন এত ভয় লাগছে। অপরূপার মনে হয় আজকাল মানুষগুলো সাপের থেকেও বেশি বিষাক্ত এবং মেরুদন্ডহীন। রাতটা যেন ভীষণ ভয়ের। চাঁদ উঠে গেছে অনেক উপরে। আমের ছায়া গিলে নিয়েছে আমগাছ। দুয়ার যেন পাহারাহীন। অপরূপার খেতে ইচ্ছে করে না ঘুম আসে না। এই রকম কত রাত কেটেছে কত ঘটনার জন্য। অপরূপা ভাবে বনের পশুগুলো কেন বনের বাইরে বেরিয়ে আসে। ওরা লোকালয়ে না এলে এত ঝমেলা দ্বন্দ্ব হত না।
অপরূপার কতদিন পরে আবার মনে পড়ে হীরামনির কথা। হীরামনি তখন অপরূপার অবসরের সাথী। বিকাশ ছিল আস্থা প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। কোন প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি খালি চোখে দ্যাখা যায় না। শালসিঁড়ির মূলের মত। গাছের মূলের কার্যকারিতা বোঝা যায় পাতায় ফুলে ফলে। মানুষের বাহ্যিক হাব-ভাব গঠন আদব-কায়দা ব্যবহার তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর নির্ভর করে ফুটে ওঠে। অপরূপার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি নিজের শিক্ষা ও বিকাশ। খুব শক্ত বিশ্বস্ত গভীর দৃঢ়। শালসিঁড়ি দোষ মুক্ত মাটি জল আলো পেলেই নানা রঙের ফুল দেয় নানা স্বাদের ফল দেয়। মানুষের মনের মানুষ থাকলে ভালোবাসা থাকলে প্রেম থাকলে কত কী রঙিন ঘটনা ঘটে। অপরূপার তখন ভরা যৌবন- বর্ষার ভরন্ত পুকুর। হিরামনি কয়লার গন-গনে আগুন- চোখে বুকে। কলসি উপচে গা ভিজে থাকে রসে। দুই যুবতি খাস গল্প করে খোস গল্প করে আর হাতে হাতে কাজ করে ঘরে।
- বৌদি নতুন শাড়িটা এমন দলা-মচা করে ফেলে রেখেছ কেন। আহা কী সুন্দর শাড়িটা। কবে এনেছে। কালকে। কই দেখাওনি তো।
হীরামনি শাড়ি ভাঁজ করতে থাকে। গুনগুন করে গান করতে থাকে –
“আরে চল গৌরী তোকে লেই যাবো মোর গাঁও…”
- কী গো বৌদি কিছু বলছ না যে।
অপরূপা অভিমানে গম্ভীর স্বরে বলে -পরশু।
- কালকে তো দেখালে না।
- কী করে দেখাই। দেখলিনা তোর দাদা কালকে সকালে কেমন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল।
হিরামনি ওর ভালো মানসিকতা ভালো কাজকর্ম এবং ভালো মানুষ হবার জন্য অপরূপা ও বিকাশের কাছে বোন হয়ে উঠেছে। হিরামনির কখনো এই বাড়িটিকে পরের মনে হয় না। অপরূপা বিকাশ ওকে বোনের মত ভাবে।
- হুম। তাই তো দেখলাম। কোথায় রেইড করতে গেছে।
- দেখনা সেই যে গেল এখন এলো না।
- আসবে কী গো বৌদি! আমি আসবার সময় আফিসে শুনছিলাম বাবুরা বলছিল আরো স্টাফ পাঠাতে। ব্যারাকের থেকে আর পুলিশ পাঠাতে। ঔখানে অনেক কাঠ নাকি পাইছে। আর টি তে বলছিল আরো পাঁচটা ট্রাক পাঠাতে।
- লোকগুলোর আর কী কোন কাজ নাই। খালি গাছ কাটে।
- গাছ কাটে কী গো বৌদি; লোকগুলো বৌ পিটায় হাড়িয়া মদ খায় আর রাতে জংগলে যায় গাছ কাটতে।
- তুই জানলি কী করে।
- সে কী গো বৌদি আমাদের গ্রামে কতগুলো লোক আছে; জোয়ান বুড়া। ওরা প্রায়দিন রাতে যখন তখন জংগলে যায়; গাছ কেটে লিয়ে আসে। কক্ষনো সাঁঝে সাঁঝে কক্ষনো শেষ রাতে।
- তোর দাদাকে বলিস না কেন- ধরে জেলে পাঠিয়ে দিত।
- না না বৌদি সেটা করিস না।
- কেন?
- আমি যখন তোর ইখানে কাজে লাগি তখন আমার কাকাকে কতগুলা ছেলে আসে ধমকায়। আমি যেন কনো কথা তোমাকে না বলি। ওদের কথা দাদা জানতে পারলে আমাকে উঠায় নিয়ে যাবে- আরো কত কী সব খারাপ কথা বলেছে। পড়ার কতগুলা বৌ আছে - ওরা জংগলে যায় ছোট ছোট চারা গাছ লতা পাতা নিয়ে আসে। ওরাও আমাকে ভয় দেখায় আমি কিছু বললে আমাকে মারবে বলেছে। ওরা খুব খারাপ। তাছাড়া আমি কেন বলব। আমার বাপ নাই মা নাই কাকার ঘরে থাকি। কেন গ্রামের পরধান বলতে পারে না। ওর ঘরের সামনে দিয়ে নিয়ে যায় ও তো কিছু বলে না। গেরামের লেখাপড়া জানা ছেলেগুলা ওরা তো সব জানে ওরা ধরতে পারে না বলতে পারে না। আমি বলব না বৌদি।
- তুই তো সব বলে দিলি। আমি দাদাকে বলে দিব।
হীরামনি শাড়িটা রেখে ছুটে যায় অপরূপার কাছে। অপরূপাকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে…
- বৌদি, দাদাকে কিছু বলিস না। কয় দিন পার আমার শাদি হবে।
অপরূপার হীরামনির শরীরের উষ্ণ ছোঁয়া ভালো লাগে। সারা রাতের একাকীত্ব অপরূপার শরীরের সমস্ত তাপ শুষে নিয়েছে। এই বনে হীরামনি ওর প্রিয় সখি। যৌবনে প্রিয় মানুষের ছোঁয়া বড় আরামের। বিকাশের ছোঁয়ার উষ্ণতা উত্তাল ভালোবাসা প্রেমের- লাল গোলাপ। হীরামনির ছোঁয়া ভালোবাসা বড় আদরের- জড়িয়ে রাখে মাধবীলতার মত। বলে-
- ছাড় তো। অত আদিখ্যেতা করিস না।
- না ছাড়বো না। আগে বল বলবে না।
- আঃ ছাড়। ভেবে দেখবো। কাজগুলো শুরু কর। কখন আবার দাদাবাবু এসে পড়বে।
হীরামনি ঘর ঝাড়পোছ শুরু করে। গুনগুন করে গান করে –
“ …গোরি তর হাত লাল আইখ কাজল,
কারেলা কামাল
গরি তরে লাজকে কমর পায়ের কে পায়েল
করেলা ঘায়াল…”
- বৌদি তুমি কালকে সন্ধ্যায় শাড়িটা পিন্ধেছিলে।
- কেন পড়ব না। কত সুন্দর শাড়ি। ভাবলাম উনি বিকেলে ফিরে এসে ঐ শাড়ি পরা অবস্থায় দেখলে খুশি হবে। না সারা রাত এলেন না।
- তুমি কি করলে বৌদি।
- কী আর করব। তোর মতো জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিলাম- সারা রাত।
- আমি আবার কী স্বপ্ন দেখলাম বউদি।
- কেন; এই গান করছিস… “আরে চল গৌরি তোকে লেই যাবো মোর গাঁও’’।
- তুমি আমাদের গান বুঝ বৌদি।
- কেন বুঝব না। এত প্রেমের গান। গাঢ় প্রেমের গান। জানিস তো প্রেমের ভাষা এক হয়।
- আমার কাকি বলে নাকি- চিটা গুড়ের মত।
- চিটা গুড়!!!
অপরূপা হীরামনি মিষ্টি করে খিল খিল করে হেসে উঠে। বাইরে গাছে কোথায় যেন ইষ্টি-কুটুম ডাকে। দূর থেকে যেন কুক্কু ডাকে কৃষ্ণ কই কৃষ্ণ কই করে। অপরূপা বুঝতে পারে না কেন বিকাশরা এত সুন্দর ডাকের পাখিকে ব্রেইন ফিবার বলে। হীরামনিকে জিজ্ঞাসা করে-
- হীরামনি তোর মানুষটা কেমন রে।
- বলব সব বলব। আগে বল তুমি কালকে রাতে কি ভাবছিলে।
- কী আর; সেই কলেজের কথা। ক্লাসরুমের কথা। ক্লাসে না করার কথা। আর এই বনের সরকারী কোয়ার্টারে একা একা থাকার কথা। তুই অতসত বুঝবি না। নে কাজগুলো শেষ কর।
হঠাৎ রাতের নীরবতা কেটে যায় অংশুর কষ্ট ডাকে
- মা…
অপরূপা দেখে অংশুর অনেক ঘাম হয়েছে। মনে মনে ভাবে-যাক প্যারাসিটেমলটা কাজ করেছে। জ্বরটা ছাড়ল। জানি না আবার আসবে কিনা। বলে-
- অংশু ওঠ তো বাবা; ঘামটা পুঁছে দিই
অপরূপা অংশুর সারা শরীর পুঁছে দিয়ে; ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। গভীর রাত আরও গভীর হয়ে উঠে। উঠানের আমগাছে রাত জাগা পেঁচা ডাকে। অপরূপা ভাবে ওটা কী পেঁচা… লক্ষ্মী পেঁচা???
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴