ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর-১৩/ মৈনাক ভট্টাচার্য
ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১৩)
মৈনাক ভট্টাচার্য
--------------------------------------
লন্ডনের ইন্ডিয়ান নেহেরু মিয়জিয়ামে সোমনাথ হোরের ব্রোঞ্জঃ রবীন্দ্রনাথ
ভাস্কর্যের সংজ্ঞা কী? যে কোন শিল্পের সংজ্ঞার মতই এ এক বিতর্কিত ব্যাপার। সত্যি বলতে কী- যা নান্দনিক তাই তো শিল্প। শিল্পকে কখনও কোন ঘেরাটোপে আটকে রাখা যায়নি। সময়ের তাগিদে ভ নদীর মতো বয়ে চলতে চলতে নিজের আদল বদল করে নেয় । তবে সাধারণ ভাবে প্রচলিত অর্থে ভাস্কর্য একটি ত্রি-মাত্রিক শিল্পকর্ম। অর্থাৎ, জ্যামিতিশাস্ত্রের মতো ভাস্কর্যকে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা হতে হয়। ভাস্কর্যে আলোছায়ার এক মায়াযাদু থাকতে হয়, সর্বপরি ভাস্কর্যের একটা মনুমেন্টাল মূল্যায়ন থাকাও জরুরী। প্রসংগটা টানতেই হয়, ভাস্কর সোমনাথ হোরের নামটাই এমন। এই মানুষটা সম্বন্ধে ভাবতে বসলে অবচেতনেই এক ভাস্করের ছবি ভেসে উঠবে যাঁর শারীরিক ছন্দটাই প্রতিবাদী। সমস্ত জীবন মানুষের যন্ত্রণার ভাষা কাজের ভাষা হয়ে রয়ে গেছে তাঁর শিল্প উপলব্ধ ভাষায়। চিত্র শিল্পের প্রিন্ট মেকিং-এর ব্যাপারে উৎসাহ ছিল জীবনের শুরু থেকেই। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করার পর শান্তিনিকেতনের কলা ভবনে পড়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন বটে কিন্তু সে ছিল পরাধীন ভারতের ১৯৩৮ সাল। সাধারণ পরিবারের কাছে ছবি আঁকাকে পেশা করা সেই সময় এক অস্পৃশ্যতার সামিল। তাই তখনকার মত সে ইচ্ছে তাঁকে অবদমিতই রাখতে হয়েছিল। কিন্তু মনে প্রাণে যে শিল্পী তাঁকে আটকায় কার সাধ্যি। বেশ কিছুটা দেরি হল বটে ভর্তি হয়ে গেলেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে। নেশা লেগে গিয়েছিল কাঠ, ধাতু, পাথর, লিনোলিয়াম শিট ইত্যাদি জিনিসের উপরে নানা পদ্ধতিতে বিভিন্ন রকম ডিজ়াইন ফেলে সেখান থেকে ছাপ নেওয়ার। যার আক্ষরিক নাম প্রিন্টমেকিং । মেধায় জোর ছিল, তাই ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। নিজের উদ্যোগে নিজেই সৃষ্টি করলেন প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্ট। ১৯৫০এই দেশের প্রধান প্রিন্ট-মেকার হিসেবে নামও করে ফেললেন। কলাভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ দিনকর কৌশিক গ্রাফিক এবং প্রিন্ট-মেকিং বিভাগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শান্তিনিকেতনে নিয়ে এলেন সোমনাথ হোরকে। শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় সোমনাথের জীবনধারা যেন ধীরে ধীরে আর এক খাত দিয়ে বয়ে নিয়ে চলার জন্য তৈরি হতে থাকল ভেতরে ভেতরে। তাঁর মনের ভেতর যে ক্ষতচিন্তা এত দিন চিত্র শিল্পে রূপ পেয়েছিল, সে চিন্তা সত্তরের দশকের এসে নতুন আঙ্গিকে রূপ পেতে থাকল ভাস্কর্যে। আমরা পেলাম ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের এক নুতন যাত্রপথ, নতুন এক মাত্রা। আমাদের বোধ হয় দূর্ভাগ্য রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থেকে সোমনাথ হোরের এই সব ভাস্কর্য দেখে যেতে পারলেন না, পারলে সোমনাথ হোরের পরিচিতির ব্যপ্তি আরও অনেকটাই ছড়িয়ে দিতে পারতেন। কেননা প্রথম দেখায় রামকিঙ্করের ভাস্কর্য তো রবীন্দ্রনাথ চিনে ফেলেছিলেন। সেটাই তো রামকিঙ্করকে রামকিঙ্কর হয়ে উঠবার প্রব্যজ্যা পারানি।
সোমনাথ হোর খুব ভাল করে জানতেন ভাস্কর্যের সংজ্ঞা। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় যে ভাবে নিজের কবিতাকে প্রচলিত সংজ্ঞায় না ফেলে তাকে পদ্য বলতেন, সোমনাথ হোরও অকপট ছিলেন নিজের কাজ সম্বন্ধে; বলতেন-“ ভাস্কর্যকে ঠিক ভাস্কর্য মাধ্যম হিসেবে আমি নেইনি। ওটা এসে গেছে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এসে গেছে। ওটাকে এখনো আমি ব্রোঞ্জই বলি। ভাস্কর্যের প্রথাগত দিকগুলো সম্পর্কে আমি কিন্তু অজ্ঞ, তার আঙ্গিকের দিক, টেকনিক্যাল দিক আমি ঠিক জানি না। ভাস্কর্য হয় পাথর কেটে নয়তো মাটি দিয়ে। আমি যেটা করি সেটা মোম দিয়ে।( কেননা ব্রোঞ্জ করতে গেলে একটা কাজকে মোমে করতেই হবে। যা কিনা ডোকরার মতই ‘হারানো মোম ঢালাই’ পদ্ধতির মত) তারপর এরকম করতে গিয়ে অনেক তফাৎ হয়ে যায় এখন আমার নিজের সম্পর্কে না বলে স্বভাবতই আমাকে বলতে হয় যারা খুব প্রথাগত দিক থেকে বিভিন্ন দেশে ভাস্কর্যের কাজ করেছেন সেই সব বড় বড় শিল্পীদের কথা তাদের সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের দেশের ভাস্কর্যের একটা বিশেষ ধারনা আছে”। সোমনাথ হোর তাঁর যাপনের মতোই স্পষ্টবাদী। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তার কাজের মতই সোজাসাপ্টা, বলেন -“ যারা আমাদের সময় আর্ট কলেজের শিক্ষা লাভ করেছে রবীন্দ্রনাথের ছবি তাদের পক্ষে বোঝা খুব কঠিন ছিল, খুব কম ছেলে মেয়েই গ্রহণ করতে পারত। আমার একটু অস্বস্তিকরই মনে হতো রবীন্দ্রনাথের কাজের ধরন ধারণ। তার কারণ, আমরা যেভাবে পাশ্চাত্য রীতিতে শিক্ষিত হয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের এই আঙ্গিক তাতে ঠিক যায় না বললেই হয়। ১৯৯৮ সাল হবে, দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্টে রবীন্দ্রনাথের ছবির জন্য একটা আলাদা ঘরই দেওয়া আছে, সেখানে তার ছবিগুলো যখন নিবিড় ভাবে দেখি আস্তে আস্তে উপলব্ধি করি আমাদের ক্ষমতার কত অভাব। ছবির অন্তরে প্রবেশ করলে তবেই বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ কত বিরাট মাপের শিল্পী। এরপর অবশ্যই যতই দিন গেছে ততই তার ছবিকে গ্রহণ করতে শিখেছি, ভালোবেসেছি, শ্রদ্ধা করেছি। এখন মনে করি আমাদের দেশের অত্যন্ত শক্তিশালী আধুনিক এক চিত্রশিল্পী হলেন রবীন্দ্রনাথ”।
ইংল্যান্ডের স্ট্যাটফোর্ড অ্যাভন-এ শেক্সপিয়ার-এর বাড়ির বাগানে, শেক্সপিয়ারের যেটা জন্মভূমি। সেখানে একটা রবীন্দ্রমূর্তি বসানোর কথা উঠল। ভারতীয় হাই কমিশনার এল এন সিংভির মাধ্যমে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে প্রস্তাব এল তারা যদি কাউকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা মূর্তি তৈরি করিয়ে দেন তবে ভাল হয়। প্রস্তাব এলো সোমনাথ হোরের কাছে। জ্যোতি বাবুকে শিল্পী সোজাসাপ্টা বললেন-“আমি করলে তো আমার মতই করব। সেটা ওদের পছন্দ হতে পারে কিংবা নাও হতে পারে। সেই জন্য এটা জানা দরকার ওরা কি চান”। তারপরে সিংভি সোমনাথ হোরকে লিখে পাঠালেন তাঁরা কেমন রবীন্দ্রনাথ চাইছেন। সোমনাথ বুঝতে পারলেন এটা তাঁর দ্বারা হবে না। উঁনারা আসলে চাইছেন প্রথা অনুসারী এক ভাস্কর্য। তথ্যসংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একেবারে যাকে বলে নাছোড়বান্দা। শিল্পীকে বললেন-“না, আপনিই এটা করুন, ওরা না নিলে আমরা আপনার কাজটা নেব। রাখবো রবীন্দ্র সদনে”। উৎসাহ নিয়ে কাজটা করলেন। মনে প্রাণে ইচ্ছে কাজটা থাকুক শেক্সপিয়ারের বাগানবাড়িতে নয়, নিজের মনিকোঠার কলকাতায়, রবীন্দ্র সদনে। যথারীতি কাজটা শেষ হলে ফটো পাঠানো হল লন্ডনে। কেননা ওদের পছন্দ না হলে শিল্পীর আর কোন দায়বদ্ধতা থাকেনা। স্বাভাবিক ভাবেই ওরা মূর্তিটা পছন্দ করলেন না। এদিকে তখন গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী ছিলেন লন্ডনে। গোপাল কৃষ্ণ তখন লন্ডনের ইন্ডিয়ান নেহেরু সেন্টারের অধিকর্তা। ওই ফটো দেখে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে লিখিত জানালেন যে তাঁরা ইন্ডিয়ান নেহেরু মিয়জিয়ামে এই মূর্তি রাখতে প্রবল আগ্রহী। কেননা গোপাল কৃষ্ণ সোমনাথ হোরকে শুধু চিনতেনই না তাঁর ভাস্কর্যের এক ভক্তও ছিলেন। ঘটনা চক্রে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শান্তিনিকেতনে এলেন কাজটা দেখতে। শিল্পী সোমনাথ বুদ্ধবাবুকে বললেন, রবীন্দ্র সদনের জন্যই তিনি কাজটা করেছেন কতৃপক্ষ্য না করে দেওয়ার পরেও। এবং তার প্রবল ইচ্ছে কাজটি রবীন্দ্র সদনেই বসুক, তাতে প্রচুর সমালোচনাও হবে। বুদ্ধবাবু মানলেন না, বললেন-“ না, আমরা ওখানে কথা দিয়ে দিয়েছি, তাছাড়া ওটা খুব প্রেস্টিজিয়াস জায়গা। কাজেই আমি মনে করি আপনি ওতেই রাজি হয়ে যান। আমরা মূর্তিটা পাঠিয়ে দিচ্ছি”। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে কাজটি পাঠিয়ে দেওয়া হল লন্ডনের ইন্ডিয়ান নেহেরু সেন্টারে। রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটির আবরণ উন্মোচন করতে ডেকে পাঠানো হয় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুকে। বিশ্বের শিল্প দরবারে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন লন্ডনের নেহেরু সেন্টারে সোমনাথ হোরের এই কাজ-নেহেরু নামাঙ্কিত এক ভারতীয় গর্বেও মহীরুহ রবীন্দ্রনাথের ভারতীয় শিল্প প্রাচুর্যকে যেন রিলে রেসের ব্যাটনের মত বয়ে নিয়ে চলেছেন তাঁরই আর এক প্রজন্ম...।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴