বাগানিয়া জার্নাল
পর্ব।।তেরো।।
শিশির রায়নাথ
^^^^^^^^^^^^^^^^^
নার্সারীতে
চারা গাছগুলো যখন এক-দেড়ফুট লম্বা হয়, গোড়ার দিকে সবুজের জায়গায় একটু
বাদামী রঙ ধরে – সেগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয় মাটিতে বসানোর জন্য।
বীজ
বা ক্লোন থেকে চায়ের চারা তৈরি করা থেকে গাছকে বড় করে তোলা, তারপর তার
পরিচর্যা ইত্যাদি সব কিছু সম্পর্কেই TRA-র রিসার্চের ওপর ভিত্তি করে
ভারতীয় টি বোর্ডের (Tea Board of India -চা-সংক্রান্ত সব কাজকর্ম
আইনানুগভাবে যার অধীনস্ত) নির্দিষ্ট নিয়ামাবলী আছে।বাগানগুলোকে সেগুলোই
অনুসরন করে চলতে হয়। এর পাশাপাশি কিছু কিছু চা কোম্পানীর নিজস্ব R&D
(Research & Development)আছে। সেসবও তারা অনুসরন করে। একে বলা হয়
‘ফিল্ড কালচার’ (Field Culture)। কিছু কিছু কোম্পানীর নিজস্ব ফিল্ড কালচার
আছে – যেমন গুডরীক, ডানকান, টাটা ইত্যাদি।
নার্সারী
থেকে চারাগাছ এনে মাটিতে লাগাবার আগে সেই মাটিকে উপযুক্ত করে নেওয়া হয়।
এরজন্য, বিশেষত রি-প্ল্যান্টিং-এর ক্ষেত্রে, আঠারো মাস সময় লাগে। মাটি
পরীক্ষা করে তার গুণাগুণ দেখে নেওয়া হয় – তার ক্ষার বা অম্ল ভাব কতটা (pH
value), ভেষজ কার্বন ও গাছের অন্যান্য অণুখাদ্য (micro nutrients)কতটা আছে
ইত্যাদি। সেই অনুযায়ী মাটিতে তা জোগান দিয়ে বা কমিয়ে তাকে ঠিকঠাক করে নেওয়া
হয়।
চা বাগানের যেখানে চা-গাছ লাগানো হয় তাকে বলে
সেক্শান (section)। সমস্ত প্ল্যান্টেশান অঞ্চলকেই ছোট বড় নানা রকম
সেক্শানে ভাগ করে তাদের নামকরণ করা হয়- যেমন, ১,২,৩, ১/এ,১/বি, ইত্যাদি।
বড় বাগান হলে অনেকগুলো সেক্শান মিলে হয় এক বা একাধিক ডিভিশান।
আইন
অনুসারে একটা বাগানের সমস্ত জমিতে চা-চাষ করা যায় না – কিছু শতাংশ জমি
ছেড়ে রাখতে হয় শ্রমিক আবাস, কর্মচারী-আবাস, ম্যানেজারদের বাংলো, হাসপাতাল,
ফ্যাকটরি ইত্যাদির জন্য। এছাড়া চা-চাষের অনুপোযুক্ত কিছু জলা বা পতিত জমি
(fallow)-ও থাকে। এর বাইরে যেখানে যেখানে চা-চাষ হয় তার সবটা মিলিয়েই হয়
সেই বাগানের ‘Area under Tea’.
আমরা
জানি যে ভাল চা-চাষের জন্য প্রয়োজন এমন জমি যেখানে প্রচুর বৃষ্টি হবে
কিন্তু মাটিতে জল দাঁড়াবে না। এজন্য দার্জিলিং-এর মত পাহাড়ী অঞ্চল ও তার
পাদদেশের ঢালু জায়গাগুলো সবচেয়ে ভাল; সেখানে একদিকে যেমন প্রচুর বৃষ্টিপাত
হয় তেমনি স্বাভাবিক নিয়মেই সেই জল গড়িয়ে নেমে যায় – দাঁড়ায় না।
দক্ষিণ-ভারতের পাহাড়ী অঞ্চলও বছরে দুবার মৌসুমী বৃষ্টি পায়।
পাহাড়ের
পায়ের কাছের সমতলেও ,যেমন তরাই-ডুয়ার্স-আসাম, প্রচুর বৃষ্টি হয়।উপরন্তু,
এসব অঞ্চলের মাটি বেলে-দোঁয়াশ (Sandy-loam)। এইমাটি কিছুটা জল ধরে রাখে (যা
গাছেদের জন্য অত্যন্ত জরুরী) আর অতিরিক্ত জলকে ছেড়ে দেয়। ফলে চা-চাষের
পক্ষে খুবই আদর্শ।এসব কারণেই শুরুতে এসব অঞ্চলেই চা-চাষের পত্তন হয়।
বৃষ্টির
অতিরিক্ত জলকে বের করে দেবার জন্য চা বাগানগুলোতে জমির ঢাল অনুসারে
ছোট-বড়-মাঝারি নানা রকম নালা কাটা ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় অত্যন্ত
গুরুত্ব দিয়ে।চা-গাছ বসাবার আগেই এসব কাজ সম্পূর্ণ করে রাখা হয়।
সঙ্গে আরও একটা কাজও খুব গুরুত্ব দিয়ে করা হয়।তা হল ছায়া-গাছ (Shade Tree) বসানো।
আমরা
ছোটবেলা থেকেই জানি যে গাছ শিকড় দিয়ে জলের সাহায্য তার খাবারের মূল
উপাদানগুলো নিজের কোষে কোষে জড়ো করে আর সূর্যের আলো ও বাতাসের
কার্বনডাইঅক্সাইডের সাহায্যে তাকে নিজের খাদ্যে (carbohydrates:Sugar,
starches etc) রূপান্তরিত করে এবং বাতাসে অক্সিজেন ও জল ছেড়ে দেয়। (তাই
যেখানে যত গাছ সেখানে তত অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাস আর তত বৃষ্টপাত)। এই
প্রক্রিয়াকে বলা হয় অঙ্গারাত্তিকরণ (Photosynthesis)। পাতাকে তাই গাছের
রান্নাঘর বলা হয়।
বাতাস থেকে কার্বনডাইক্সাইড গ্যাস
শুষে নেওয়া (প্রশ্বাস) এবং বাতাসে জল ও অক্সিজেন গ্যাস ছেড়ে দেওয়া
(নিঃশ্বাস) – গাছ এই কাজটা করে তার যে ‘নাক বা মুখ’ দিয়ে তাকে বলে স্টোমাটা
(stomata)। স্টোমাটা থাকে প্রধানত গাছের পা্তায় পাতায়। [ছবি -১]
এখন,
এই রান্নার কাজটা করার জন্য গাছের চাই একটা উপযুক্ত তাপমাত্রা (ambient
temperature)।তার কম হলে যেমন রান্না হবে না বা রান্নার গতি ঢিমে হয়ে যাবে
–তেমনি বেশী হলেও গতি কমতে কমতে একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। রান্নাঘর খুব কম বা
খুব বেশী গরম হয়ে গেলে কোন মা আর সেখানে বসে ‘স্বাভাবিক ভাবে’ রান্না করতে
পারেন – তাঁকে তো রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হয়। গাছেরও তেমনি। চা-গাছের
ক্ষেত্রে সেই তাপমাত্রা হল যথাক্রমে ১৩ডিগ্রী ও ৩৫ ডিগ্রী
সেলসিয়াস/সেন্টিগ্রেড। এর কম-বেশী হলে পাতার স্টোমাটাগুলো ধীরে ধীরে মুখ
বন্ধ করে দিতে থাকে –বন্ধ হয়ে যায় নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ – রান্নার কাজ।
এই
অবস্থা থেকে পার পাবার জন্য লাগানো হয় ছায়া-গাছ। যেহেতু পাহাড়ি অঞ্চলের
তাপমাত্রা এমনিতেই ৩৫ ডিগ্রীর কম থাকে তাই সেখানে ছায়াগাছের অতটা প্রয়োজন
হয় না।একারণে দার্জিলিং পাহাড়ের চা বাগানে ছায়া গাছ ততটা চোখে পড়ে না।
কিন্তু ডুয়ার্স ও আসামের চা বাগানে তা খুবই জরুরী।
[তাপমাত্রার
এই ভেদাভেদটা চা-গাছে সরাসরি প্রভাব ফ্যালে। শীতকালে দার্জিলিং এবং
তরাই-ডুয়ার্স-আসামের তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নীচে নেমে যায়।সঙ্গে
দিনের-আলোর (Day-light)-এর দৈর্ঘ্যও কম থাকে। গাছ তাই রান্না-করা ছেড়ে
দিয়ে শীতঘুমে (hibernation) চলে চায়। ফলে তখন আর গাছে নতুন কুঁড়ি-নতুন
পাতা জন্মায় না।আবার মার্চ-এপ্রিলের গরম পড়লে পাতা ছাড়তে শুরু করে।তাই
শীতকালে চলে চা-গাছের সবচেয়ে দীর্ঘ বন্ধাত্য বা ‘বাঁজি কাল’(Banji Period) –
যার কথা আগেই (পর্ব- নয়) বলা হয়েছে।]
তবে
সব গাছ দিয়ে ছায়া-গাছ হয় না। কেননা ছায়াগাছ এমন হতে হবে যে তার ছড়ানো
ডাল-পালার (canopy) ভিতর দিয়ে চা-গাছের জন্য প্রয়োজনীয় রোদটুকু যেন ঢোকে আর
বেশী রোদ আটকে পরিবেশের তাপমাত্রা বজায় রাখে। এজন্য কৃষ্ণচূড়া বা আমলকির
মত ঝিরঝিরে পাতাওয়ালা একটু ছড়ানো ডালপালার গাছ আদর্শ। তবে সেখানেও খেয়াল
রাখতে হয় সেইসব গাছ যেন রেইনট্রি-র মত এত বড় না হয় – যাতে চারপাশের মাটি
দখল করে চা-গাছকে হটিয়ে দেয় এবং মাটিতে চায়ের খাদ্যের উপাদানগুলো একাই শুষে
নেয়।
এসব ‘ফ্যাক্টর’
মাথায় রেখে চা-বিজ্ঞানীরা কিছু ‘লিগুমিনাস (leguminous)’ জাতীয় গাছ বেছে
নিয়েছেন ছায়াগাছ হিসেবে। লিগুমিনাস মানে যে সব গাছের ফল শিম-এর মত বীজ বা
গুটিকোষ যুক্ত। ঝিরঝিরে পাতাওয়ালা এদের ‘ক্যানোপি’ চা গাছের ক্ষেত্রে
উপযুক্ত।
এছাড়াও, এইসব ছায়াগাছের আরও অনেক সুবিধা ও কিছু অসুবিধা আছে । সে সব কথা পরের পর্বে...
------------------------------------------------------------
ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে নেওয়া...