বাংড়ি তিতি ও হাউড়ি শেষে
পর্ব : ১৩
মিশা ঘোষাল
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
টোটোপাড়া যেতে : চোরাবালির পথে
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
প্রচন্ড বৃষ্টি ছিল সেদিন-
মেঘ-পিওনের চিঠিতে ছিল সঘন বাদল কথার ইঙ্গিত,
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রোজনামচা...
মেঘের গর্জনেও ছিল বৃষ্টি দিনের সংবাদ!
টানা
চার দিন অবিরাম বৃষ্টির পর যখন একটু জিরিয়ে নেবার পালা এল বৃষ্টির, সেই
অবসরে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম টোটোপাড়ার উদ্দেশ্যে, চেনা তবু অচেনা পথের
ঠিকানায়! অচেনা এই কারণে, বৃষ্টি দিনে টোটোপাড়ার পথের কোনো হদিস থাকে না।
অনেক ভুলভুলাইয়া ঘুরে পৌঁছনোর উপায় খুঁজে নিতে হয় এই সময়। দুর্গম রাস্তা,
বৃষ্টির মেজাজী আক্রোশ, নদী ও ঝোরার লাগামবিহীন জলোচ্ছ্বাসে গাড়ি চলাচলের
নিত্যনৈমিত্যিক চেনা পথ যখন ছিন্নভিন্ন, বিচ্ছিন্ন। তখনও আমাদের
বিদ্যালয়ের কাজেই পৌঁছতে হয়েছে টোটোপাড়ায়।
কোনো না
কোনো উপায় খুঁজে নিয়ে কিভাবে যে পৌঁছতে পারা যাবে টোটোপাড়ায়,সেই উপায় ভাবতে
ভাবতে রহস্যময় এই পথের দিকনির্দেশ করে নিয়ে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলতে হয়
আমাদের।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই লিখছি, যতই শোনা
যাক 'টোটোপাড়ার রাস্তা বন্ধ', 'নদীদের বিপুল চেহারা', 'বাংড়ির পাড় ভাঙা',
'হাউড়িও রাগে ফুসছে' ইত্যাদি... তবুও আমরা যে কোনো পথ খুঁজে নিয়ে পৌঁছে
যাই টোটোপাড়ায়। এদিনও তাই...
জীবনের ঝুঁকি নিয়েও
পৌঁছতে হয়েছে টোটোপাড়ায়! একটি বিদ্যালয়ের প্রধান হলে তাঁকে তো এই বিপজ্জনক
রাস্তাতেও যাতায়াত করবার ঝুঁকি নিয়েই চলতে হয় ! ঘোর বর্ষাতেও যে কোনো দিন,
কোনো না কোনো কাজে বিদালয়ে উপস্থিত হতেই হয়। মূল রাস্তা বন্ধ থাকলেও যে
কোনো পথ দিয়ে কোনো উপায় করে বিদ্যালয়ে পৌঁছতে হয়। কখনো আবার একা একাই
ছুটতে হয় এই রাস্তায়। বিদ্যালয়ের সব কাজেই যে প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকাকেই
দরকার হয়!
এদিনও তাই। তবে
এদিন সহ শিক্ষক/শিক্ষিকারাও ছিলেন। চললাম নতুন পথে আবার। টোটোপাড়ায় পৌঁছেও
গেলাম। বিদ্যালয়ে পৌঁছে চটপট জরুরি কাজগুলি সেরে ফেলতে লাগলাম। মাস্ক
পরিয়ে গার্ডিয়ানদের লাইন করে দূরত্ববিধি মেনে দাঁড়িয়ে যেতে বললাম। চাল-আলু,
ছোলা, সাবান ,IFA ট্যাবলেট ইত্যাদি দেওয়া শুরু করে দিলাম। পাশাপাশি
অ্যাক্টিভিটি টাস্ক দেওয়া শুরু করলেন মাষ্টারমশাই ও দিদিমণিরা। পার্ট টাইম
টিচাররা আমাদের বিদ্যালয়ের মাঠের ওপেন স্টেজে এগারো ও বারো ক্লাসের কোচিং
ক্লাস নেওয়া শুরু করে দিলেন।
টোটোপাড়ায়
টিউশন-ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আসলে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের জন্য
টিউশন পড়াবার মতো কেউ নেই টোটোপাড়ায়। বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকাদের উপরই
তাই ভরসা এদের। ছাত্রছাত্রীরা স্কুল বন্ধ থাকলেও এই কোচিং ক্লাসের জন্য
মুখিয়ে থাকে সেইজন্য। আমাদের আসার খবর পেয়ে অপেক্ষায় ছিল সেদিন ওরাও। আমি
জরুরি কাজগুলোতে হাত দিলে মিঠু এসে বলল,
"ম্যাডাম,রাস্তার অবস্থা কিন্তু ভালো নয়। নদীর জল ক্রমাগত বাড়ছে। এই অবস্থায় আমাদের ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।"
টোটোপাড়ায়
এমনিতেই স্কুল টাইমে গাড়ি নেই। আর এই ঘোর বর্ষার দুর্দিনে টোটোপাড়ায়
যাতায়াতকারী একমাত্র বেসরকারী বাস 'মৌসোনা'ও বন্ধ তখন। জিপ-গাড়ি একটু বেশি
টাকা দিয়ে রিজার্ভ না করলে এই পথে কেউ আসতে চায় না। কোনো কোনো জায়গায় তো
রাস্তার চিহ্ন পর্যন্ত থাকে না।
মিঠু আমার অফিসে এসে
বলল, "কিছু কাজ থাকলে আমাকে বলুন, আমি হেল্প করে দিই। তাড়াতাড়ি করে আবার
ফিরতে পারবো তাহলে। নদী-নদী হয়েই তো ফিরতে হবে আমাদের আবার। মেঘলা আকাশ
অন্ধকার হয়ে আসছে দেখুন। নদীতে জল বাড়লে মুশকিল হবে।"
আমি বললাম,
"ঠিক
আছে। মিড ডে মিল ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যাপারটি আজ আর্জেন্ট। সেল্ফ হেল্প
গ্রুপের (SHG group) ওদেরকে নিয়ে একটি মিটিংও করতে হবে। ডেকে নাও ওদের।
অজিতমায়া রানা, বীনা থাপা ও জ্ঞানদা (জ্ঞানবাহাদুর রানা)কে একটু ডাকো।
গার্ডিয়ানদের মিড ডে মিল বন্টন (MDM distribution) বিষয়ে একটু আলোচনা আছে
আজ। সেটিও করে নাও। আমিও কাজ করতে করতে শুনে নেব সিদ্ধান্তগুলো।"
স্কুল মাঠের পিছনেই ওদের বাড়ি...
মিঠু গিয়ে ওদের সবাইকে ডেকে নিয়ে এল আমার অফিস-কক্ষে, আলোচনার জন্য ।
আর
যা যা কাজ ছিল সেদিন, অ্যাক্টিভিটি টাস্ক নিয়েও আলোচনা হল। গুরুত্বপূর্ণ
কাজগুলো সারা হলে সাড়ে তিনটা নাগাদ আমরা বিদ্যালয় বন্ধ করে মাদারিহাটে
ফেরার জন্য আমাদের রিজার্ভ গাড়িটিতে উঠে বসলাম।
উঠেই কৃষ্ণকে বললাম, "কৃষ্ণ, কোনো জিপ কী এই সময়ের মধ্যে টোটোপাড়ায় ঢুকেছে? খেয়াল করেছ?"
কৃষ্ণ
আমাদের স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে সামনেই টোটোপাড়ার রাস্তার তেমাথায়, বি এফ
পি প্রাইমারি স্কুলের উল্টোদিকে যে যাত্রীনিবাসটি রয়েছে সেখানে অপেক্ষা করে
প্রতিদিন।
সেই সময় কৃষ্ণ এই রাস্তার কারেন্ট
আপডেটগুলো সংগ্রহ করে নেয় চলতি ফিরতি গাড়িগুলো থেকে। রাস্তা ও নদীতে জলের
ওঠানামার খবর ছাড়াও হাতি, চিতা, বাইসন ইত্যাদি কোনো বুনো
জন্তুর দ্বারা পথচারীদের আক্রমণের খবরও থাকে এই সাথে। বিপদ এড়াতে এসব খবর সংগ্রহ করে তবেই এই পথে চলার উপায় খুঁজে নিতে হয়।
কৃষ্ণ
বলল, "ম্যাডাম,টোটোপাড়া হসপিটাল থেকে রীরপাড়ায় রেফার করা একজন রোগী নিয়ে
তিল বাহাদুর টোটো একটি জিপে করে ফিরেছে এইমাত্র। ওই জিপে টোটোপাড়ার কিছু
যাত্রীও ফিরেছে মাদারিহাট থেকে।
তিলবাহাদুর ওর এক
আত্মীয়র চিকিৎসার জন্য বীরপাড়া জেনারেল হসপিটালে রেফার করা রোগী মোটামুটি
সুস্থ করে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে এই ঘোর দুর্যোগপূর্ণ দিনে, টোটোপাড়ার ওই ঘুরতি
পথেই। কাজেই আমরাও ফিরতে পারব মাদারীহাট।"
এই ভেবে অনেকটা আশ্বস্ত হতে পারা গেল।
এ রাস্তায় নতুন নতুন ঘুরতি পথ অজস্র। কখন যে কোন রাস্তা খুলে যাবে আর কোনটি বন্ধ হবে, সে কথা একমাত্র প্রকৃতিরই জানা!
নতুন পথের হদিস মেপেই চলতে হবে আমাদের, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবশ্যই পৌঁছে যাওয়া যাবে টোটোপাড়ায়, ফিরেও আসা যাবে।এ কথা জানাই আছে।
এ যেন বিপদ বুঝেও চেষ্টার ত্রুটি না রেখে কাজের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঝুঁকি !
কোনো
না কোনো দিক দিয়ে বিপদ মাথায় করে অসহায় ভাবে টোটোপাড়ায় পৌঁছনোর ইতিহাসও
লেখা আছে ডায়রির পাতায়। কত যে অদ্ভূত কৌশল অবলম্বন করে চলতে হয় এই পথে তার
ঠিক নেই। তবুও ঠিক পৌঁছে যাওয়া যায় এই রহস্য রোমাঞ্চিত পথের পথিক হয়ে !
পথে যতই দুর্যোগ আসুক নতুন উপায়ে চলাচলের পদ্ধতি নিজেদেরই আবিস্কা
র করে নিয়ে চলতে হয় এখানে বারবার। চলতে হয় অবাক পথের দৃষ্টি নিয়ে ভয়ের মাথা গুড়িয়ে দিয়ে। এই পথেই যে রাখা আছে কাজের ঝাঁপি অফুরান!
প্রতিনিয়ত
এভাবে নতুন পথ আবিস্কার করতে করতে মনে হয় যেন চির নতুন 'টোটোপাড়া পথ'
আমাদের! আর আমরা ঘোর বর্ষার বর্ষাতি গায়ে সন্ধানী কৌতূহলে কোনো রহস্যের
কিনারা করতে এগিয়ে চলেছি,সেই নতুন আবিস্কারের অজানা পথে!
প্রতি
বছর নতুন নতুন নদীও সৃষ্টি হয় এখানে। বাঙড়ির নতুন একটি শাখা নদী সে বছরই
সৃষ্টি হয়ে হান্টাপাড়ার পথের উপর দিয়ে চলে যেতে লাগল। জল টপকে উছলে উঠে
দেখি সে নদী তখন জায়গা করে নিয়েছে মুজনাই চা বাগিচার পাশ দিয়ে। গিলে খেয়েছে
সেই চা বাগানের কিছুটা অংশ। হান্টাপাড়ার স্থানীয়রা (এখানকার আদিবাসী
বাগিচা শ্রমিকরা) এই নদীর নাম দিয়েছে 'ঘুটঘুটি'। এবারের বর্ষায় দেখলাম এই
'ঘুটঘুটি' আরও বড় আকার নিয়ে মাটির আরও গভীর দিয়ে 'মুজনাই চা বাগিচা' সংলগ্ন
পিচ-রাস্তার অপর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে 'ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের(I.O.C)
মোড় দিয়ে। সেখান থেকে আবারও বাঁক নিয়ে জামতলা বাজারের কাছাকাছি এসে পাহাড়
থেকে নেমে আসা আর একটি ঝোরার জলে মিশেছে।
এত
জলরাশি পেয়ে এই ঝোরাটিও তখন ফুলে ফেঁপে জলকেলি করে চলেছে।এলোপাথাড়ি এসে
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জামতলা বাজারের উপর। জামতলা বাজারে প্রতি সোমবার যে ছোট
হাটটি বসে, সেটির দশাও সেই নদী-ঝোরার চোখরাঙানিতে অচল তখন। হাটের জন্য
নির্মিত ছোট ছোট চারটি খুঁটিতে দাঁড়িয়ে থাকা টিনের চালও ভেসে গেছে এই
'ঘুটঘুটি' ও 'জাম-ঝোরা'র মিলিত প্রবাহে।
টিনের চালও
উড়িয়ে নিয়ে গেছে ঝোড়ো হাওয়া আর জলের স্রোত। খুব বৃষ্টি হলে এই জায়গাটিতে
ছোট ছোট অনেকগুলি ঝোরাও আবার এগিয়ে এসে দাপিয়ে বেড়ায় এই জামতলার রাস্তায়।
ফেলে রাখে কুচো কুচো পাথর, বালির ঢিপি, রাস্তার মাঝে।টোটোদেরও এই একই চলার
পথ... নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, জীবনদায়ী ওষুধপত্র এই ঘোর দুর্যোগে
মাদারিহাট বা বীরপাড়া থেকে সংগ্রহ করে তবেই টোটোপাড়ায় ফিরতে হয় তাদের।
কখনো আবার বালি-পাথর ঢেলে দেয় এই পথের উপর এই শাখা-নদী ও ঝোরাগুলি, বন্যার জলও ঢুকে পড়ে এই অঞ্চলের বাড়ির উঠোনে।
এই
রকম অবস্থার সাক্ষী থেকে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা বানিয়ে এগিয়ে যেতে হয় আমাদের,
আর তখন নিত্য নতুন কিছু আবিস্কারের পথে পা রাখি আমরা... ফিরে ফিরে বৃষ্টি
আসে, গাড়ির কাচ ঝাপসা হয়ে যায় বারবার... জল ঝর ঝর, মাতাল সমীরণ বয়ে যায়...
জল থৈ থৈ পথ ঘাট-
অবিচ্ছিন্ন তবু টোটোপাড়ার পথ...
প্রতি বছর বর্ষাকালে এই একই রকম রহস্যের পথচলা আমাদের ! এ যেন এক হাড় হিম করা বৃষ্টি-সফর মনোরম !
টোটোপাড়া থেকে গাড়ি ছেড়ে যতক্ষণ পিচ রাস্তা পাওয়া গিয়েছিল, জল জমা ছিল সেখানেও ছোট বড়ো রাস্তার গর্তে।
মাদারিহাট
থেকে টোটোপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যখন জামতলা বাজারের কাছাকাছি এসে
পড়েছিল আমাদের গাড়ি, তখনই দেখেছিলাম রাস্তার পাশ দিয়ে সশব্দে ছুটে চলেছে
ঝোরার জলের নদী। মুজনাই নদী রাস্তার অপর পারের কাছাকাছি তার বিস্তৃত জলরাশি
এগিয়ে নিয়ে এসেছে।
বাংড়ির নদীর কাছাকাছি এসে পড়লে
শেষ হয়ে যায় পিচ রাস্তা । তখনই দেখতে পেয়েছিলাম প্রচন্ত খারাপ রাস্তা আর
খাড়া খাদ বাংড়ির এই পথে! পাড় ভেঙে চুরমার হচ্ছিল কয়েক দিন ধরে। গাড়ি
পারাপারও তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তিন দিন আগে থেকেই...
"গাড়ি ঘোরাও কৃষ্ণ... এ রাস্তা দিয়ে যেতে পারবে না".. বলতে বলতেই পিছন থেকে অন্য আর একজন বলে উঠেছিল...
"হ্যাঁ,নদী-নদী হয়ে যেতে হবে আজ আমাদের।"
নদীতে
জল, এবড়ো থেবড়ো ভাঙা রাস্তার পথে বালি পাথরের ঢিপি- ভুটান পাহাড়ে প্রচন্ড
বৃষ্টিপাতের ফল এসব। নদী ও ঝোরাগুলির পেট ফুলে ফেপে ওঠে এই সময়, আর কাড়ি
কাড়ি নুড়ি-পাথর বয়ে নিয়ে এসে ফেলে রাখে আমাদের যাত্রাপথে। পাহাড়ের ধ্বসও
নামে রাস্তায়। মাদারিহাটের ব্লক ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ক্রেন নিয়ে এলে তবেই এই
বিপুল বালি পাথরের ঢিপিগুলি সরানো সম্ভব হয়। কিন্তু এই যা রাস্তার অবস্থা,
রাস্তা সারাই হতে হতে এক সপ্তাহ তো লাগবেই। নচেৎ জে সি পিও ঢুকতে পারবে না
এই পথে। আর অনবরত বৃষ্টির হুমকি তো লেগেই আছে!
তাই আজ নদীপথ ধরেই কোনক্রমে টোটোপাড়ায় এসে পৌঁছেছিলাম আমরা।
বালি কাকরের কর্দমাক্ত ছিল সেই পথ।
টোটোপাড়ার
নদীর এই পথে আবার জল জমে থাকতে পারে না বেশিক্ষণ! এখানে শুধু বালিমাটি ও
পাথরের মিশ্রণ, কোথাও আবার শুধুই মোটা বালির চর! এই পুরু হয়ে জমে থাকা
বালির চরেই হয় বিপত্তি! চোরাবালির এই চর!বোঝাই যায় না...গুপ্ত ঘাতকের মতো
ওৎ পেতে বসে থাকে যেন ! গাড়ির চাকা ফেঁসে যায় এখানেই ! আর তখন আরো বড়ো
রকমের বিপদের মধ্যে পড়তে হয় আমাদের। সেই বিপদকে আঁচ করে খুব সাবধানে এগোতে
হয়েছিল আমাদের।
আমার
থেকে মিঠু কিছুটা আগে জয়েন করেছে আমাদের টোটোপাড়ার এই বিদ্যালয়ে। তাই ওর
এই লাইনের অভিজ্ঞতা আমার থেকে কিছুটা হলেও বেশি। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে
এসেছিল ও। আসার সময় বলেছিল,
"কৃষ্ণ,গাড়ির চাকার চিহ্ন
দেখে দেখে চলতে হবে...স্রোতের অনুকূলে জোরে স্পীড দিয়ে নদীর মধ্যের ছোট
ছোট স্রোতস্বিনীগুলোকে পার করতে হবে।"
আর বৃষ্টি দিনে যখন বাংড়ির নদীপথ ভেঙে বড় রকম খাদের আকার নেয়, তখনই আমাদের চলতে হয় এই ঘুরতি পথেই !
ভূটান
পাহাড়ের একটানা বৃষ্টিপাতের ফলে বাঙড়ির নদী-রাস্তা ভেঙে শেষ। বাঙড়ির পাড়ের
বাধ ভেঙে নিয়ে চলে গেছে নদীর তুমুল জলস্রোত! জানা ছিল না আমাদের যে একদমই
চলার উপায় নেই এই বাঙড়ির পথে! ধ্বস নেমে ধ্বসে গেছে রাস্তা! অগত্যা গাড়ি
ঘুরিয়ে হান্টাপাড়ার মোড় থেকে ফিরে আসতে হয় মাদারীর রাস্তায়!
কৃষ্ণ(আমাদের জীপ ড্রাইভার) বলে ওঠে,"ম্যাডাম আজ বোধহয় টোটোপাড়া যাওয়া যাবে না "।
"বলো কী ?
"আজকে তো গার্ডিয়ানদের চাল আলু দেবার ডেট" !
"তার
উপর আবার অ্যাক্টিভিটি টাস্ক দিতে হবে"। গত মাসের উত্তরপত্রও জমা নিতে
হবে আমাদের। এই উত্তরপত্র জমা দিতে পাহাড় থেকে নেমে আসবেন আমাদের বাচ্চাদের
গার্ডিয়ানরা।"
যে করেই হোক যে কোনো পথ খুঁজে নিয়ে আজ আমাদের টোটোপাড়া ঢুকে যেতেই হবে কৃষ্ণ"...
"দেরী হোক,তবুও"...
কৃষ্ণ গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলে আবার। মাদারির রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেই মোড়ে একটি ছোটো কালভার্ট আছে,জিপ চলার মতো।
কৃষ্ণ ওখানে এসে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দেয়। বলে,"একটু খোঁজ নিয়ে আসি গিয়ে।"
গাড়িতে
এদিন মিঠু (সহশিক্ষিকা আমাদের ) আর ছিল আমাদের উচ্চমাধ্যমিকের পার্ট টাইম
টিচার দুজন (সুদীপ ও মধু)। এখন থেকে টোটোপাড়ায় ঢোকার সেই সুদীর্ঘ পথের
হদিশ নিতে গিয়ে কৃষ্ণ তখন উধাও! আমারাও জিপ থেকে নেমে পড়লাম সেই পথের
সন্ধানে। টোটোপাড়ায় যাবার এ পথ যেন নিত্য নতুন অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে অপেক্ষা
করে প্রতিদিন! নীল আসমান সেজে ওঠে নতুন নতুন রঙে, বাদল মেঘের ঘনঘটা
চারিদিকে। এরই মধ্যে চোখে পড়ল 'রামধনু' আকাশে! মুহূর্তে আমরা সবাই সব ভুলে
প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে মেতে উঠলাম। সবাই তখন ফটোগ্রাফার। তুলে নিলাম একে একে
সব চিত্র! এবার কৃষ্ণ ফিরে এসেছে।
ওকে বললাম,"কী হলো"?
"যাওয়া যেতে পারে ম্যাডাম"...
ও
বলল, "একটা ডাম্পার (বালি তোলার লরি) ঐ সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। খালাসিরা নেমে
রাস্তা বানাতে শুরু করেছে। ওদের পিছন পিছন ঐ পথ ধরেই আমাদের যেতে হবে।"
কৃষ্ণ গাড়ি স্টার্ট দিল...
আমরা
চললাম জামতলার রাস্তা দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের গাড়ি বাংড়ির একটি
শাখানদীর চর অতিক্রম করে পৌঁছে গেল ঐ ডাম্পারটির কাছে...
ডাম্পারে রয়েছে টোটোপাড়ার এস এস বি ক্যাম্পের খাবারদাবার, চাল ডালের বস্তা, মুরগী ইত্যাদি।
মাদারিহাট
থেকে টোটোপাড়া যেতে এই তেইশ কিলোমিটার পথে দেখা মেলে তিনটি বড় নদীর -
তিতি, বাংড়ি ও হাউড়ি। এ ছাড়াও রয়েছে তাদের অসংখ্য উপনদী, শাখানদী ও ঝোরা
উপঝোরার সমষ্টি। নদীগুলির চর আবার বহুদূর পযর্ন্ত বিস্তৃত। নদী ও এই চরের
রাস্তা ধরেই বেশিরভাগ যাতায়াত করতে হয় আমাদের।
বর্ষাকালে
নদীগুলি প্রবল আকার ধারণ করলে বৃষ্টির জলের বানে ঢেকে যায় নিত্য দিনের
যাতায়াতের পথ। ভুটান পাহাড় থেকে সৃষ্টি এই নদীগুলির চরিত্রে রয়েছে বদমেজাজি
চলন - দিকবিদিক জ্ঞান-শূন্য হয়ে চলার অভ্যেস! পাহাড়ে যখন মেঘ ভাঙা
বৃষ্টি হয় তখন হঠাৎ করেই এই নদীগুলিতে জলে ভরে যায়। প্রবল জলস্রোতে ভেসে আস
বালি পাথরের চাই! মদমত্ত মাতাল তখন নদী- আর নদীর জলে ভরে যায় পথ। খাবলা
খাবলা বালি পাথরের মিশ্রণ ফেলে রাখে রাস্তায়। ভাঙে পথ,নদী-বাঁধ। এই সময়
রাস্তার কোনো ঠিক থাকে না। এরকম হয় তখন-
কাল যে পথে
এলাম,আজ এসে দেখি সে পথের কোনো চিহ্নই নেই সেখানে! চলতে চলতে আমাদের গাড়ির
চাকা হঠাৎ ঢুকে গেল নীচে। কৃষ্ণ গাড়ি স্টার্ট দিয়েই যাচ্ছে...
গাড়ি আর চলছে না!
একদিকের চাকাটি যেন বেশ বুঝতে পারছি ডুবে যাচ্ছে জল জমা বালির গভীরে...
কৃষ্ণ বলল, "সবাইকে একটু গাড়ি থেকে নামতে হবে,ম্যাডাম"...
মাষ্টারমশাইদের
বলল, জিপটির পিছনে গিয়ে গাড়িটি একটু জোরে ঠেলে দিয়ে চাকা তোলার ব্যবস্থা
করতে... জীপের দরজা খুলে নামতে লাগলেন আমাদের মাষ্টারমশাইরা...
আমি বরাবরই সামনের সিটেই বসি। জিপের দরজা খুলে নামতে গিয়ে দেখি সামনেই এক মস্ত বাইসন, সাদা মোজা যেন পায়ে !
বিশ্বজিৎ দা বলে উঠলেন,
"উরি বাবা! বাইসন!"
"প্রথমে ষাঁড়ের মতো লাগছিল। ভাবলাম ষাঁড়। কিন্তু পায়ের দিকে চোখ পড়তেই বুঝলাম বাইসন।"
অগত্যা
ঝটপট সবাই আবার জীপে উঠে পড়লাম। উঠেই গাড়ির কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে
থাকলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম বাইসন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে! এদিকে আমাদের গাড়ির
চাকা বন বন করে ঘুরছে,কিন্তু এগোচ্ছে না...
ঢুকে যাচ্ছে বালি-কাঁদার মধ্যে !
জিপটির ডান পাশ হেলে গিয়েছে, আর চাকা ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে চোরাবালির গভীরে...