পইলা সাঞ্ঝির কথা/১৩
পইলা সাঞ্ঝির কথা
পর্ব - ১৩
শুক্লা রায়
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
খাইলের কাঁকড়া, বাঁশের থুড়ি
আন্দুনি বেরায় আটখুরি
রান্না শেষ করে বসমতী একটু চুলটা শুকাবে বলে বাইরে বের হল। মাথা থেকে ভেজা গামছাটা খুলে ঝড়াৎ ঝড়াৎ করে চুলগুলো ঝেড়ে একটু খোলা হাওয়ায় দাঁড়াল আম গাছটার নীচে। পিঠময় ছড়িয়ে পড়ল একঢাল কালো চুল। বসমতীর চুলের গোছ হিংসে করার মতো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির মানুষগুলোর খেতে আসার অপেক্ষা করাটাই সময় কাটানো। অবশ্য এখন শুধু বাচ্চা দুটোই আসবে স্কুল থেকে। এর ফাঁকে একটু পুরনো কথা মনে পড়া, দমকা হাওয়ার মতো হঠাৎই একটু অন্যমনস্ক হওয়া। বসমতীর ভাবনাজুড়ে অবশ্য এই সংসারই বেশি বিরাজ করে।
পেছনের বাঁশঝাড়ে শুকনো পাতায় পা ফেলার মড়মড় আওয়াজ হতেই সেদিকে ফিরল। রসবালা। দেখেই হাঁক পাড়ল,
“বাঁশের থোপত কি করিস কইনা মাই”?
রসবালা বসমতীকে দেখে এক গাল হেসে উত্তর করল,
“বাচ্চা বাউটা হামার অনেকলা কাঁকড়া মারি আনিল দিদি। তোক কয়টা দিবার চানু তে ভাবলুং ওই কয়টা কাঁকড়া আরো কত্তন আন্দিবু। একেরে আন্দি নিগি দ্যাং”!
ছেলের আব্দার রাখতেই অসময়ে বাঁশঝাড়ে প্রবেশ। সদ্য স্নান করা রসবালার মাথায় ভেজা গামছা জড়ানো। বাঁশের ভেতর কাঁকড়ার রসটা ঢেলে, সেটা পুড়িয়ে সেদ্ধ করে তা দিয়ে তরকারী রান্না হবে। বসমতী দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল,
“আজি বিষদ বার। বাঁশ কাটা না যায়”।
তারপরেই নিজের ভুল বুঝতে পারল। বৃহস্পতি নয়, আজকে বুধবার।
রসবালা ঠক ঠক করে দা দিয়ে একটা লম্বা গিঁটওয়ালা ছোট মাকলা বাঁশ কেটে আনল। আগেই জলের মধ্যে খড় ভিজিয়ে রেখেছে। এখন বাঁশের দুটো টুকরো কেটে ভেতরটা ভালো করে ধুয়ে পরিস্কার করে নিল। এরপর কাঁকড়াগুলো ছাড়াতে বসল। বড্ড ঝামেলার কাজ! কিন্তু ছেলের আব্দার! কাঁকড়ার পিঠের শক্ত খোলস, পা এসব কাটারি দিয়ে কেটে বাদ দিল। একটু নুনসহ মেখে কলপাড়ে নিয়ে খুব করে ঘষে ঘষে ধুয়ে একপাশে রেখে ঘরের ভেতর থেকে সাম- গাইন বের করল। সাম আর গাইনটাও ভালো করে ধুয়ে নিল। এখানেই শেষ নয়, কাঁকড়াগুলো সাম গাইনে ভালো করে থেঁতো করে চিপে চিপে শুধুমাত্র রসটা বাঁশের লম্বা টুকরোগুলোতে ভরে যে খড়গুলো ভেজানো ছিল ওগুলো ধুয়ে নিয়ে ঠেসে বাঁশের মুখটা বন্ধ করল। দেখে দেখে বসমতীই কেমন হাঁফিয়ে উঠল।
“বেইন্যায় ভেজালখান করির পাইস কইনা”!
“মোরও মনটা চায় না দি, ছাওয়াটা যে খাবার চাইল। না পালে এলায় মরিয়া মরিবে”।
“কাতাখান তো হয়!”
তবে বসমতী জানে, ছেলের রাগের ভয়ের থেকেও মায়ের করে খাওয়ানোর আগ্রহ বেশি।
বসমতী দেখল কথা বললেও বসমতীর কাজ থেমে নেই। এখন ধান সেদ্ধ করার বাইরের উনুনে আগুন ধরিয়ে বাঁশের টুকরো দুটো পোড়া দিয়ে আলু, পেঁয়াজ, লংকা রসুন কেটে ছুলে নিল। তারপর রান্না ঘরে বাটিতে জল নিয়ে ঘষ ঘষ করে মশলা বাটতে শুরু করল। বসমতীর মনে হচ্ছে পুরো গায়ের জোরে মশলাটা বাটা হচ্ছে। সাথে চার-পাঁচখানা কাঁচা লংকা। রসবালা বড্ড ঝাল দেয়।
মশলাবাটা শেষ করে ঘরের ভেতর ভাতটাও একেবারে বসিয়ে দিল। ওখানেও খড়ি গুঁজে ঠিকঠাক করে চাল ধুয়ে দিয়ে এবার বাঁশের টুকরোগুলো বের করল। কাটারি দিয়ে ফাটাতেই দেখা গেল ভেতরে কাঁকড়ার রসটা জমাট বেঁধে আছে। ওগুলোকে টুকরো টুকরো করে কেটে নিয়ে রান্না ঘরে নিয়ে গিয়ে এবার মূল রান্না।
বাবারে! বসমতী অবাক! ঝামেলা কত্ত! টুকরো করে রাখা কাঁকড়ার অংশগুলো কড়াইতে তেল গরম করে ভেজে নিয়ে নামিয়ে তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে আলুগুলি ঢেলে দিল। খুন্তি নাড়তে নাড়তেই আপন মনে বলে,
“নুনের থুড়িটা যে কোটে থুলুং”!
রান্না ঘরের উপর দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে রসবালা বলে,
“এইবার বাইস্যা পালালে আন্দনঘরটা ভাল করির নাইগবে দি। দ্যাখেক তো খ্যাড় গিলা খসি পড়েছে”।
তারপর নুন দিতে দিতে বলে,
“পইগিলাও মেল্লা দিন হইল, ঢুলে, এইবার দুন বাতাস খানোতে ঘরটা পড়ি যাবার চাছে, খিব ভয় আছিল”।
কথার ফাঁকে ফাঁকেই মশলা দিয়ে কষিয়ে জল। জল ফুটে উঠলে ভেজে রাখা কাঁকড়ার টুকরোগুলো ছেড়ে দিল। কাজ তখনও শেষ হয়নি। একটু অল্প করে গরম মশলা বেটে নামিয়ে নিল। সলজ্জ হেসে বলল,
“কোনেক গরম আছে তে দ্যাং”।
আহ্! কী ঘ্রাণ! বসমতী একেবারে মোহিত হয়ে গেল! খেতে বসে কান্তেশ্বরও বারবার রান্নার সুখ্যাতিতে অস্থির। কান্তেশ্বর অবশ্য রাতে খেয়েছে।
রসবালা যেমন ধান কাটা, পাট কাটা বা জমির অন্যান্য কাজে মোটামুটি চটপটা, রান্নাতেও তেমন। বসমতী ওর হাতের রান্না একদিন না এলে খেতে বসে না। অপেক্ষায় থাকে কখন রসবালা বাটিতে করে তরকারী দিয়ে যাবে। বসমতীও ওর জন্য অন্য বাটিতে আগেই সাজিয়ে রাখে। এতে আর বলাবলির কিছু নেই। ও এসেই বুঝতে পারে কোন বাটিটা ওর। ওদের এই সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তবে পাড়ার অন্য বাড়ির সঙ্গেও সব্জি আদান-প্রদান হয়। কিন্তু রসবালার সঙ্গে যেটা হয় তা হল অলিখিত নিয়ম যেন, দিতেই হবে, নিতেই হবে। আর রসবালা তো ধূপগুড়ি থেকে হঠাৎ মটাৎ কিনে আনা মোটা মাছ বা বড় মাছটা, মাংস ইত্যাদি যে কোনো ভালো-মন্দ রান্না বসমতীকে না দিয়ে খেতেই পারে না। রাঁধেও বড্ড যত্ন করে। সব সময় তো দামী মাছ- মাংস কেনা হয়না, সেরকম আত্মীয়- স্বজন এলে তবেই। সেদিনটা যেন একটা উৎসব মতো হয়ে ওঠে বাড়িটায়। রাত্রে রান্না হলেও রসবালা রান্না শেষ করেই গরম গরম মাংসের বা মাছের বাটি নিয়ে হাজির। বড্ড ভালো মনটা। বসমতী ভাবে এমন অভাবের সংসারে এমন বিলানোর মন ক'জনের আছে!
-------------------------------------------------------
বাঁশের থোপ - বাঁশের ঝাড়
নুনের থুড়ি - লবন রাখার জন্য বাঁশ কেটে বানানো পাত্র।
পই - ঘরে লাগানো বাঁশের খুঁটি।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴