সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
08-September,2023 - Friday ✍️ By- শুক্লা রায় 638

নিরুদ্দেশ/শুক্লা রায়

নিরুদ্দেশ
শুক্লা রায়

লোকটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। একেবারে মুছে গেল যেন। রাতে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়েছিল রোজকার মতো দরজা বন্ধ করে, সকালে দেখা গেল বিছানা খালি। কোনো চিহ্ন নেই। জামা-কাপড় মায় ক্ষুর কাঁচির ঝোলাটা পযর্ন্ত নেই। টিংটিঙে পাতলা চেহারার মানূষটির বয়স এমন কি আর হয়েছিল, বড় জোর বাহান্ন-তেপ্পান্ন! হঠাৎ মরে যাওয়ার কোনোই সম্ভাবনা ছিল না। মরে গেলেও নিদেন পক্ষে ডেডবডি বলে তো একটা কথা আছে নাকি! সেটা তো থাকবে! না, তা ও নেই। পাড়াসুদ্ধ, গ্রামসুদ্ধ চিন্তায় পড়ে গেল। তবে এ নিয়ে খুব যে বিরাট হৈ চৈ হল তা নয়। শান্ত পুকুরে ঢিল পড়লে যেমন তখনকার মতো আওয়াজ ওঠে, জলের গায়ে ছোট ঢেউ, মৃদু কম্পন, সেরকম একটু আওয়াজ উঠল। আস্তে আস্তে ক্রমশ সব থিতু হয়ে, শান্ত হয়ে গেল। কেউ কেউ মাঝে-সাঝে মাথা চুলকাতে গিয়ে কিংবা অন্য কোনো নাপিতের কাছে পিঁড়ি পেতে বসার আগে একটু হলেও মনে মনে ভাবত বালদেও ঠাকুরের কথা। ব্যস, ওই পর্যন্তই। রীতিমতো পূর্ণ বয়স্ক মানুষ, কোথাও গেলে নিজের ইচ্ছেতেই গেছে। এ নিয়ে আর থানা-পুলিশের কারবারও হয়নি। শুধু মুকুলের বৌটা কদিন কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলল। ওদের উঠোনে তখন সান্ত্বনা দেবার জন্য, কিছুটা খোঁজ-খবর করে কৌতুহল মেটানোর জন্যও মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। ধীরে ধীরে ভিড় কমে গেলে মুকুলের বৌও সংসারে মন দেয়। মুকুলকে সাথে নিয়ে বাজারের সোনার দোকান থেকে একজোড়া নতুন কানের বালি কিনে নিয়ে আসে আর মনে মনে পাঁচ পাথরের বড় নাকফুলটা কেনার কথা ভাবতে থাকে। বাক্সে সাজানো ছিল, দেখে বড় লোভ হয়েছিল। কিন্তু মুকুলকে এখনি বলার সাহস হল না।
বালদেও ঠাকুর এই ঝিনাইমারিতে এসেছিল সেই কোন ছোটবেলায়। তখন নিজে কাজ করত না, বাবার পিছু পিছু ঘুরত। তারপর আবার বিহারে চলে গেল, আর এল না। ওর বাবা রামরতনকে বললে হাসে। কাঁচি দিয়ে কুচকুচ করে চুল কাটতে কাটতে বলে, "ও তো বাড়িত আছে। বিয়া করাব এর মধ্যে।"
সবাই আঁতকে ওঠে। ওইটুকু ছেলের বিয়ে? তা শোনা গেল বিয়েটা হয়েই গেল বালদেও এর। তারপর যখন আবার এল, গোঁফ উঠেছে। বেশ লম্বা, পাতলা চেহারায় বাবার মতোই পেশাদার একখানি মুখ। মুখের হাসিটি কিন্তু প্রাণখোলা। মাঝে মাঝে উধাও হয়। দেশে গিয়ে মাসখানেক কাটিয়ে আবার ফেরে। বেশ চকচকে চেহারা, তেল চুপচুপে মাথায় খুশি খুশি মুখে সাইকেল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে দেখা যায়। বিয়ে করে চেহারার বেশ খোলতাই হয়েছে। ক্ষুর-কাঁচির ঝোলাটার মধ্যেও কেমন একটা সুখী সুখী ছাপ পড়ে গেছে যেন। 
শোনা গেল সেই বালদেওয়ের আরো বিয়ে করাতে চায় বাড়ির লোক। ছেলে হতে গিয়ে বৌটাই নাকি মরে গেছে। বাচ্চাটাও আর বাঁচেনি।  অল্প বয়সের মেয়ে। ধকল সইতে পারেনি। ও পাট চুকে বুকে গিয়ে বালদেও ঝিনাইমারিতেই পুনরায় থিতু হয়ে গেল। দেশে যাওয়ার কথা আর মুখেও আনে না। সে না গেলে কী হবে! রামরতন এসে পড়ে থাকল। ছেলের পিছে পিছে ঘোরে দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য। না পেরে বালদেওয়ের মা ও চলে এল। বয়স্ক মহিলা। এক গলা ঘোমটা। হাতে রঙবেরঙের কাচের চুড়ি, পায়ে মোটা পায়েল। সামনের দিকে আঁচল টেনে শাড়ি পরা। তাকে দেখতেই বাঙালি বৌদের ভিড় লেগে গেল। মা এসেও অবশ্য ছেলেকে ফেরাতে ব্যর্থ হলেন। একমাস থেকে অবশেষে রওনা হলেন। যাওয়ার দিন হাপুস নয়নে কেঁদে ভাসালেন। তারপর থেকে মা-বাবা যদ্দিন বেঁচে ছিলেন বালদেও যেত ন'মাসে, ছ'মাসে। বাকি সময় এখানেই পড়ে থাকল। সকালবেলাতেই সাইকেল নিয়ে বের হত। গ্রামের মানুষ, সিকিটা, টাকাটা জোগাড় করে রাখত চুল, দাড়ি কাটার জন্য। কেউ কেউ আবার বলে দিত ধান উঠলে আসিস। তো এটাই মজুরী। এই করেই একদিন বালদেও ঠাকুরের অবস্থা ফিরে গেল। টিনের চাল দিয়ে হাফওয়াল বাড়ি করল প্রথমে। ধীরে ধীরে সামান্য জমিও কিনল। একসময় একটা ধান ভাঙানো মেশিন বসিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসল ঝিনাইমারিতে। লোকে ভালোওবাসে বালদেওকে। বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া ধান ভাঙানোর মেশিন আর সেলুন পাশাপাশি। খাওয়ার লোক নেই, একা মানুষ। সারাদিন কাজের মধ্যেই ডুবে থাকে। হাসিখুশি। এলাকার সবার সঙ্গে বেশ ভাব-ভালোবাসা তার। তবে বেশি খাতির বীরেন্দর এর সঙ্গে। বাজারের একমাত্র সোনার দোকানটা বীরেন্দরের। সেও সকাল সকাল সাইকেলে করে পাড়ায় পাড়ায় আগে ঘুরে আসে। অনেক বাড়িতেই বাকি বকেয়া টাকা তুলতে যেতে হয়। এই ফাঁকে একটু বিক্রি বাটাও হয়। বাড়ির মেয়েরা হাঁসটা, মুরগিটা অথবা ছাগল বিক্রি করে কিছু টাকা লুকিয়ে ফেলে বাড়ির পুরুষটির থেকে। সেই টাকায় শখের একটা নাকছাবি বা এক গাছা চুড়ি কিনে রাখে বাড়িতেই। আবার দুর্দিনে ঘরের সোনাটুকু বিক্রি করতে হলেও এই বীরেন্দরই ভরসা। সিঁদুরের কৌটোয় যত্নে রাখা এক জোড়া দুল কিংবা ছোট্ট টপ বের করে দিতে দিতে অনেকেই লুকিয়ে কেঁদেও ফেলে। 'ধান উঠলে আবার কিনে দেওয়া যাবে' -এই আশ্বাসবানীতে খুব একটা ভরসা রাখতে পারা যায় না আসলে। কাচ লাগানো একটা কাঠের বাক্স। তাতে ছোট ছোট তাকে তুলোর মধ্যে গোঁজা ছোট্ট কানের দুল, রূপোর বাজুবন্ধ, আংটি এসব। এইসব নিয়েই হয়ত মাঝপথে দুজনের দেখা। তখন প্রাণখুলে দুজনেই দেশোয়ালী ভাষায় একটু গল্প করে, খৈনি খায় তারপর যে যার পথ ধরে।
কাটছিল বেশ। কিন্তু বালদেও সেবার বাবার অসুখের খবর পেয়ে সেই যে দেশে গেল, ফিরল পাক্কা ছয়মাস পরে। ফিরে এল একটা ছেলে সঙ্গে করে। নাম মুকুল। সে তো এ দেশের ভাষা কিছুই বুঝে না। তাকে সঙ্গে করে বেড়াতে বেড়াতে একেবারে এ দেশের যোগ্য করে তুলল। বিয়ে-থা করাল। এখন দোকানদুটো মুকুলই দেখে। বালদেও এখনও সাইকেলে করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কাজ করে। কাজে ওর আলস্যি নেই। তো এমন একটা মানুষ হঠাৎ হারিয়ে গেল। দেশের বাড়িতেও তার এখন কেউ নেই যে খোঁজ করবে। থাকার মধ্যে এই পালিত পুত্র মুকুল আর তার বৌ। তারা বিস্তর খোঁজ-খবর করল, কেঁদে-কেটে অস্থির হল, কিন্তু মানুষটাকে পাওয়া গেল না। ধীরে ধীরে সব যেমনকে যেমন থিতিয়েও এল। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে মুকুল আর আগের মতো হাসিখুশি নেই। প্রথমে ধান ভাঙার মিলটা বিক্রি করে দিল। তারপর সেলুনসহ পুরো বাড়িটা বেচে দিয়ে এখানকার পাট উঠিয়ে আবার বিহারেই চলে গেল বৌসহ। জানা গেল বৌয়ের বাপের বাড়িতেই উঠবে, ওখানে জমি কিনে ঘর তুলবে আবার।
ওরা গেলে রেশন ডিলার নিমাই ওখানকার টিনের ঘর ভেঙে আরো বড় মাপে ভিটি খুঁড়তে লোক লাগালেন। রেশনের মালের গো ডাউন হবে। জমিটা ঘরবাড়িসহ তিনিই কিনেছেন। এক সকালে ভিটি খোঁড়া শুরু হল। দুপুর হতে হতে হৈ চৈ। মানুষের কঙ্কালসহ হাড়গোড় উঠে এসেছে মাটির তলা থেকে। ক্ষুর কাচির ঝোলাটা দেখে বীরেন্দর এই বৃদ্ধ বয়সে ওখানেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। ঝোলাটার কিছুই অবশিষ্ট নেই, কিন্তু তবু চেনা যায় ওটা বালদেও ঠাকুরেরই।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri