সহজ উঠোন

রেজিস্টার / লগইন করুন।

সব কিছু পড়তে, দেখতে অথবা শুনতে লগইন করুন।

Sahaj Uthon
16-December,2022 - Friday ✍️ By- নীলাঞ্জন মিস্ত্রী 541

তিস্তাবাথান-১৩

তিস্তা বাথান/পর্ব : ১৩
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^^^^^^

তিস্তার পূর্বপাড়ের নেওলা বস্তি ছানবিন করে চলেছি সেই সকাল থেকে। অবশেষে নেওলা বস্তির সেই জুম্মার খোঁজ পেলাম। জুম্মার কাছেই একটি নারকেল গাছ ছিল। সেই নারকেল গাছের সন্ধানেই বেরিয়েছিলাম সাধ-সকালে। দুঃখের কথা জুম্মার পাশের নারকেল গাছটা আর পেলাম না। মাসখানেক আগেই কালবৈশাখীর দাপটে ভূপতিত হয়েছে। গাছের গোড়ার কাছে পৌঁছে আগার দেখা পাওয়ার ইচ্ছেটাও পূরণ হল না একেবারেই। ঠিক ওখানেই দাঁড়িয়ে সানিয়াদার মুখ থেকে শোনা ১৯৬৮ সালের ৪ঠা অক্টোবরের সেই ভয়াবহ রাতের কথা স্মৃতিচারণ করছিলাম। রোমহর্ষক সেই ইতিহাসকে একটুখানি ছুঁয়ে দেখার বৃথা চেষ্টা  আর কি।

ঢেউহীন সুতীব্র তিস্তাস্রোত। তিস্তার জল উপরে উঠে নারকেল গাছের মাথা ছুঁই ছুঁই। সেই ঠুঁটা নারকেল গাছের মাথায় দড়ি দিয়ে সানিয়াদারা বেঁধেছে তাদের ডুঙ্গি নৌকা (শিমূল গাছের একটি কান্ড দিয়ে তৈরী)। দুপুরের পর যখন তিস্তার জল বাড়তে বাড়তে বাথানের চাল পর্যন্ত উঠে পরে সানিয়াদা'রা আর বাথানে থাকার সাহস করেনি। ঝুরির ঘাটের সোমারু, লাখোর বাবা আর সানিয়াদা তাদের ছোট্ট ডুঙ্গি নিয়ে ঝাঁপান তিস্তার ভয়াল স্রোতের মাঝে। টাকীমারির চরের বাথানকে ছেড়ে দিয়ে তখন তাঁরা উদ্দাম তিস্তার মাঝে। বৃষ্টি পড়ছে অনবরত সাথে হাওয়া বইছে প্রবল। ঝড় এসে উল্টে দিতে চায় তাঁদের ডুঙ্গি। স্রোতের অনুকূলে কোণাকুণি যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে দেখা মেলে নারকেল গাছটির। দড়ি দিয়ে নারকেল গাছের মাথায় ডুঙ্গি বাঁধেন তাঁরা। কিন্তু যুদ্ধটা চলতেই থাকে। বৃষ্টির জল ছোট্ট ডুঙ্গির বুক ভরে দিয়ে নিয়ে যেতে চায় তিস্তার অতলে। লাখোর বাবা আর সোমারু ক্রমাগত জল ছেঁকে চলে। লগি হাতে সানিয়াদা সামলাতে থাকে তাঁদের জীবন নৌকাখানি।

চোখের সামনে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে তাঁদের  দু’শ ভইস (মহিষ) ভেসে গেছে তিস্তার জলে। মহিষের রক্ষাকর্তারা আজ ব্যর্থ হয়েছেন তাঁদের সন্তানসমদের বাঁচাতে। মহিষ বাঁচানো তো দূর অস্ত তাঁরা আজ নিজেরা বাঁচতে পারবে কিনা সে চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে। কিন্তু এ জীবন যে বড় মূল্যবান। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখবার এই লড়াই জৈবিকও বটে। তাই বেঁচে থাকার অদম্য চেষ্টাটুকু চলতেই থাকে ঘন কালো আকাশতলে।

বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য রয়েছে, “নিজে বাঁচলে বাপের নাম”। ডুঙ্গির উপর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তিন মৈষাল। পাশ দিয়ে হাত ধরাধরি করে ভেসে যাচ্ছে বহু মানুষ। “গেলাম রে, ভাইরে...বাঁচাও রে, ভাইরে...এ মা, এ বাবা ওঠাও রে”...সেইমুহুর্তে ভয়ার্ত এই আওয়াজগুলি কানে প্রবেশ করাতে চায় না সানিয়াদারা।  বানভাসা মানুষের সেই  চিৎকার, চেঁচামেচি, আর্তনাদ বিগলিত করতে পারে না ডুঙ্গিতে ভাসা তিন মৈষালের স্বার্থপর হৃদয়কে। এ লড়াই অসম লড়াই, এ লড়াই বাঁচার লড়াই। ঠিক এই মুহুর্তে অন্যের কথা ভাবলে নিজেদের হারিয়ে যেতে হবে চিরদিনের জন্য। জীবনবোধের বাস্তব এই সত্যকে উপলব্ধি করতে পারেন মৈষাল বন্ধুরা। সানিয়াদা কঠোর হয়ে ওঠেন, হৃদয়কে সেই মুহুর্তে পাষাণ করে তোলেন। বানভাসি যাঁরাই তাঁদের ডুঙ্গির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছিল তাঁদেরকে লগির মাথা দিয়ে গুঁতো মেরে মেরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন তিস্তার ভয়াল স্রোতের মাঝে। সেদিনের এই নির্মমতা আজও ভুলতে পারেননি সানিয়াদা। তাই তো উদাসী কন্ঠে  বাথানের চাংরিতে বসে আমায় শুনিয়েছিলেন, “জিন্দা থাকিতে যে ইমতন কাম করিবার নাগিবে  স্বপনেও ভাবো নাই রে  মুই” (বেঁচে থাকা অবস্থায় যে এমন কাজ করতে হবে স্বপ্নেও ভাবি নাই রে আমি।)

বেলা গড়িয়ে সন্ধে হয়েছে। জল তো কমেইনি বরং বেড়েছে অনেকটাই। বৃষ্টি থামেনি। ঝড় তখনও বইছে। চারিদিকে বানভাসি মানুষের আর্তনাদ, হাহাকার। সর্বোপরি তিস্তার গুরুগম্ভীর হুংকার অন্ধকারের মাঝে আরো প্রকাশ্য হয়ে উঠে। কিছুই দেখা যায় না চারপাশে। পূর্ণিমার চাঁদকেও রুষ্ট প্রকৃতি গ্রাস করে নিয়েছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে দৃশ্যমান হয় ক্ষ্যাপা তিস্তা। সেই আলোতে জল মেপে চলেন যুদ্ধরত তিন অতিমানব। রক্ত মাংসের শরীর তিনটি অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পরে। তিস্তাবুড়িকে ভক্তি দিয়ে (প্রণাম জানিয়ে) অবশেষে হাল ছাড়েন মৈষালেরা। রাত গভীর হলে বৃষ্টি থেমে যায়। ভোরের দিকে বৈদ্যডাঙ্গার পুরান চ্যাংমারিতে নদী ঢুকে যায়। তিস্তার জলে টান ধরে। ধীরে ধীরে জল কমতে শুরু করে।

পরের দিন অর্থাৎ ৫ই অক্টোবর, বেলা একটার পর জল কমে যায় অনেকটাই। জল-কাঁদায় চারপাশে মানুষ আর গবাদি পশুর লাশের ছড়াছড়ি। সুইপার, বি.এস.এফ., পুলিশ নামে উদ্ধারকার্যে। কি যে ভয়ানক ছিল সেই দিনক্ষণ তার কিছুটা অনুধাবন করা যেতে পারে সানিয়াদার বয়ানে। একেবারে তার মুখের কথাগুলোই এখানে তুলে দিলাম।........ 

 “কাহোয় কাঁচা কুমড়া খায়ায় বাঁচিসে রে। এতখান করি পোঁতা গিসে। বত্তায় আছে। কিন্তু কায় বাচাবে?” (কেউ কাঁচা কুমড়ো খেয়ে বেঁচেছে রে। এতটা করে গেঁথে গেছে। বাঁচাই ছিল। কিন্তু বাঁচাবে কে?)

 “ ঐ ঠে বিশ্বনাথের ঘর উমরায় ভাসিছে বাঁশের আগালি ধরিয়া। এমন উমার লাক, মাইয়া-ভাতারে আরো একঠে নাগিসে।“ (ওখানে বিশ্বনাথরা ভেসেছে বাঁশের মাথা ধরে। এমন ওদের ভাগ্য স্বামী-স্ত্রী এক জায়গাতেই ঠেকেছে।)

 “বৈদ্যডাঙ্গায় হামাক নিগাইল। ক্যাম্প করিল ঐঠে।ওরে বাপ! এই ন্যাকনাইয়ের কানের মতো চূড়া রে, তিতা...।ঐলা দ্যাছে এক ঢঙ্গরা করিয়া। আর লোক? একখ্যালে জায়গায় নাই একটা ক্যাম্পোতে। উপায় নাইয়ো। কোঠে যাবে লোকলা। জিলা বাঁচিসে ঐলা।“ (বৈদ্যডাঙ্গায় আমাদের নিয়ে গেল। ওরে বাবা! ন্যাকনাইয়ের কানের মত চিড়ারে, তিতা...। এক ঠোংগা করে দিচ্ছিল। আর লোক? একদম জায়য়া নেই ক্যাম্পে। উপায়ও নেই। কোথায় যাবে লোকগুলো? যারা বেঁচেছে তাঁরা।)

জলপাইগুড়ি জেলা জুড়ে ১৯৬৮ সালের ভয়াবহ বন্যা জলপাইগুড়ি জেলাকে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে। লক্ষ্মীপূজার রাতের সেই তিস্তার করাল গ্রাস বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সম্পদহানি করে সর্বস্বান্ত করেছে শহর জলপাইগুড়ি ও গ্রাম জলপাইগুড়ির হাজার হাজার মানুষকে। মধ্যতিস্তার কয়েকশ' বাথান, হাজার হাজার মহিষসহ নিশ্চিহ্ন হয়েছে। তিস্তাবক্ষে বাথান সংস্কৃতির উপর সে ছিল এক চরম আঘাত। তবুও আশায় শুধু চাষাই বাঁচেনি। বেঁচেছে মৈষাল ও বাথান মালিকেরাও। ১৯৬৮ পরও তিস্তাবক্ষ প্রায় একশ'র বেশি বাথান গড়ে উঠেছিল। বাথানের কলরবে আবার মুখরিত হত তিস্তাবক্ষ। আক্ষেপের বিষয় সেই সংখ্যাটা আজ দাঁড়িয়েছে মাত্র পাঁচ-ছয়টিতে। কেন ঘটল এমন ঘটনা? অবশ্যই আলোচিত হবে এই প্রবন্ধে। তবে ১৯৬৮-এর বন্যায়  ইউনুসের বাথানের ঘটনাটি না বললেই নয়।

আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴
software development company in siliguri,best
                            software development company in siliguri,no 1 software
                            development company in siliguri,website designing company
                            in Siliguri, website designing in Siliguri, website design
                            in Siliguri website design company in Siliguri, web
                            development company in Siliguri