চা-ডুবুরী-১৩/সুকান্ত নাহা
চা-ডুবুরি : পর্ব ১৩
সুকান্ত নাহা
^^^^^^^^^^^^^^^^
মিছিলের মুখ, মুখের মিছিল
' ...সাথীও, এক বাত ইয়াদ রাখনা , কিসি ভি কিমত পর পহলে বাগান খোলওয়ানে পড়েগা। ইসকে লিয়ে একজুট হোকর, হম সবহি কো কোশিশ করনা পড়েগা। কিঁউ কি মালিক কে বিনা মজদুর জ্যয়াদা দিন বাগান নেহি চলা সকতা.... ইতিহাস ইস বাতকি গবাহ হ্যয়...আউর মালিক কো ভি অপনা জিদ ছোড়কে জিতনা জলদ্ হো সকে বাগান খোলনা পড়েগা। মজদুর ঔর কর্মচারীয়ো কা সমস্যা উনকো হি হাল করনা পড়েগা...' সুমন্ত প্রতিটা বাক্য বেশ জোর দিয়ে বলে যাচ্ছিল।
নীলপাহাড়ির ফ্যাক্টরি গেটে জরুরি মিটিং চলছে। গতকাল দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মালিকপক্ষ অবান্তর কিছু শর্ত আরোপ করায় ইউনিয়ন মানেনি। মিটিং ভেস্তে যায়। আজ তাই এই মিটিংয়ের পর মিছিল করে বিডিওর কাছে স্মারকপত্র জমা দিয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ দাবি করা হবে। ভিন্নমত পোষণকারি চার ইউনিয়নের নেতাদের একজোট করতে প্রথম থেকেই লড়ে গেছে সুমন্ত। লেবার ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতারা এখন বাগানে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। কেননা বোনাস মিটিংএ উপস্থিত থেকেও তারা কিছুই করতে পারেনি নীলপাহাড়ির জন্য। সুমন্ত স্টাফ ইউনিয়নের সভাপতি অম্বরীষবাবুকে নিয়ে এসেছিল একদিন। উনি এসে কিছুটা মনোবল বাড়িয়ে গেছেন। সর্বোতভাবে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে গেছেন।
এতদিন সব ইউনিয়ন একজোট হয়ে প্রতিটা মিটিংএ উপস্থিত থেকেছে। পথ অবরোধ করা হয়েছে। গণস্বাক্ষর করা চিঠি পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন দপ্তরে। রাত জেগে সেসব চিঠি সুমন্ত কম্পিউটারে টাইপ করে পাঠিয়েছে নানান জায়গায়। যোগাযোগ রেখেছে বিভিন্ন নেতাদের সাথে। কিন্তু এভাবে এতদিন জোটবদ্ধ আন্দোলন চলার পরেও হঠাৎ তাল কেটেছে ক'দিন হল। কিছু নেতা বেঁকে বসেছে, তারা মালিককে বাগানে ঢুকতে দেবে না কিছুতেই। নিজেরাই বাগান চালাবে। নেপথ্যে বাইরের বিশেষ কোনও গোষ্ঠী মদত জোগাচ্ছে এবং এতে যে আখেরে তাদের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ হবে সেটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে। এক পা এগিয়ে ওরা শুরু করে দিয়েছে বাগানের শীতকালীন পরিচর্যা। শীত পেরিয়ে যাচ্ছে। অন্য বছরগুলোতে এতদিনে চা গাছের প্রূণিং বা ছাঁটাই কাজ শেষ হয়ে যায়। শুরু হয় জলসেচ, গাছের গোড়া পরিস্কার, ছায়া গাছের বাকল চেঁছে চুন লাগানো, নালা গভীর করার কাজ। এগুলো না হলে আগামী বছর গাছে পাতা আসবে না। বাগানের ভবিষ্যৎ তলিয়ে যাবে অন্ধকারে। এই বাস্তব যুক্তিগুলো দেখিয়ে কিছু নেতা শ্রমিকদের উস্কেছে। যে কারণে কিছু শ্রমিক ছুরি, কোদাল নিয়ে বাগান বাঁচাতে নেমে পড়েছে স্বেচ্ছাশ্রমে। তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে গাছে নতুন পাতা এলেই তা বিক্রি করে তাদের মজুরি মেটানো হবে। শুধু তাই নয় বর্তমান মজুরির চেয়ে বেশি মজুরি পাবে তারা। বোনাসও পাবে বেশি। এতে পরোক্ষে মালিকের ওপর চাপ সৃষ্টি করা গেলেও বাস্তব যে কঠিন এ বিষয়ে শ্রমিকদেরই একাংশ ইতিমধ্যেই সহমত পোষণ করতে শুরু করেছে।
শ্রমিকরাই হবে নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্তা- এ ভাবনায় আবেগ থাকলেও তা বাস্তবায়ন যে বড় কঠিন সে বিষয়ে এখন জোরালো মন্তব্য উঠে আসছে শ্রমিকদের ভেতর থেকেই। এমনকি যে সব নেতা শ্রমিকদের বিপথে চালিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের শারীরিকভাবে হেনস্থা করার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে ভেতর ভেতর। তেমন হলে বাগানে যে কোনও মুহুর্তে রক্তারক্তি ঘটে যেতে পারে। মরিয়া হয়ে তাই সুমন্ত সহ আরো কয়েকজন নেতা নেমে পড়েছে আসরে। বাগানে শান্তি বজায় রাখাই মূল উদ্দেশ্য তাদের। এখনও পর্যন্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের প্রচেষ্টায় বাগানের সম্পত্তি হানি হয়নি একটুকরোও। একটি ইঁট চুরি হয়নি, একটি ছায়াগাছও কাটা পড়েনি। খবরগুলো মালিকের কানে পৌঁছলেও অজ্ঞাত কারণে তিনি অনড়। উপরন্ত সুযোগ বুঝে শর্ত চাপিয়েছেন, যারা বাগান বন্ধের জন্য দায়ী সেইসব শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হবে। বকেয়া বোনাস ৮.৩৩% দেওয়া হবে দুই কিস্তি তে। যদিও আপাতত শ্রমিকরা বোনাস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না মোটেই। বাগান খুলিয়ে মজুরি নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য এখন। সুমন্তর পর একে একে বক্তৃতা দিয়ে গেল ভিখা মুন্ডা, বসন্ত মঙ্গর, জোহান এক্কা, মহিলা সমিতির মরিয়ম তির্কি সকলে। সবার মুখেই এক কথা, যে কোনও শর্তে বাগান খুলতে হবে মালিককে।
গেটের পাশে গ্যারাজ ঘরের ছাউনির নিচে তিনমাস ধরে নিথর পড়ে থাকা ট্র্যাক্টরগুলোর একটিতে বসে, স্টিয়ারিংএ কনুই রেখে, গালে হাত দিয়ে বক্তৃতা শুনছিল সুবর্ণ। অফিস বন্ধ। চেয়ার নেই বসার। বাবুদের অনেকেই তাই যে যার মত অলসভঙ্গিতে বসে পড়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শ্রমিকদের শারীরিক ভাষাতেও ফুটে উঠছে হতাশা। যদিও সংখ্যায় তারা আশানুরূপ ভাবে যথেষ্টই কম। কেননা বাগান বন্ধ হতেই পেটের তাগিদে অধিকাংশ শ্রমিকই চলে যাচ্ছে আশপাশের বাগানে। সেখান থেকে গাড়ি পাঠিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রোজ সকালে গাড়ি এসে তাদের নিয়ে যায়। ফিরিয়েও দিয়ে যায় বিকেল । যারা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই মহিলা শ্রমিক। যেখানে যাচ্ছে সেখানে মজুরির নিশ্চয়তা থাকলেও সম্মান নেই। তারা সেখানে অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিক। যেখানে স্থানীয় শ্রমিকদের নানা বিদ্রুপাত্মক কথা শুনে তাদের কাজ করতে হয়। মরদরা পাড়ি দিয়েছে আশপাশের শহরে কিংবা ভিনরাজ্যে। শ্রমিক ঘাটতি সব বাগানেই আছে। সব বাগানই সিজন টাইমে বাড়তি শ্রমিক আনে বাইরের থেকে। যাকে বলে আউটসোর্সিং। যা অতীতেও ছিল। কথাপ্রসঙ্গে এই কথাগুলো শুনে সত্যপ্রিয়বাবু বলেছিলেন সুবর্ণকে ,
'এই যে শ্রমিক চলে যাওয়া, এ কিন্তু আজকের নয়। একটা সময় তো ছিল যখন এক বাগান থেকে অন্য বাগানে শ্রমিক জাস্ট চুরি হয়ে যেত। ইংরেজ সাহেবরা তাদের চর ছড়িয়ে রাখত চারপাশে। তারা নজর রাখতো যাতে তাদের বাগানের শ্রমিক অন্য বাগানে চলে না যায়। অন্য বাগান থেকে শ্রমিকদের তারাই আবার সুযোগ পেলে লোভ দেখিয়ে ফুসলিয়ে নিয়ে আসত নিজেদের বাগানে। সাপ্তাহিক হাটে এই শ্রমিক চুরির কাজটা হত। কেননা সপ্তাহে ঐ একটি দিনেই হাটে শ্রমিকরা সওদা করতে আসত। ওখানেই তাদের টোপ দেওয়া হতো। হাটে দর কষাকষি পর রফা মনমতো হলে রাতের অন্ধকারে শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় পরিবার সহ নিঃশব্দে চলে যেত অন্য বাগানে । সেখানে গিয়ে তারা তাদের নাম বদলে ফেলত। তখন আর চেনার উপায় ছিল না তাদের। ১৯৫২ সালে সম্ভবত এইভাবে শ্রমিক চুরি রুখতে আইন করা হয়। তবে বন্ধ বাগানের শ্রমিকদের পেটের তাগিদে এই যে অন্য বাগানে চলে যাওয়া, এর সাথে আগেকার শ্রমিক চুরির ব্যপারটা গুলিয়ে ফেলাটা ঠিক হবে না। '
বাগান বন্ধ হলে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা হয় বাবুদের। তারা না পারে অন্য বাগানে কাজে যেতে। না পারে বাগান ছেড়ে চলে যেতে। কেননা বাগান ছেড়ে বাইরে গেলেও কাজ পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া কোয়ার্টার তালা বন্ধ রেখে গেলে চুরি হবার সম্ভাবনা প্রবল। খুব ছোট থাকতেই সেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে সুবর্ণর। সুবর্ণর অস্পষ্ট মনে পড়ে তখন সে খুব ছোট, সবে ভর্তি হয়েছে স্কুলে, একদিন তার জন্মভূমি স্বপ্নপুর চা-বাগান আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। সেসময় সুধাময় প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার সুবাদে সরকারি বেতনটুকু যদিও পেতেন, তবু আবাসনে বিদ্যুৎ সংযোগ,জলের লাইন সব কেটে দেওয়ায় ভয়াবহ দুর্বিষহ দিনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু দিনের পর দিন বেতন না পেয়ে অন্যান্য বাবুরা পড়েছিলেন বিপাকে। ট্রান্সফার নিয়ে সুধাময় নীলপাহাড়িতে চলে আসার ঠিক পরেই বাগান খোলার আশা ছেড়ে দিয়ে বাবুরা বাগান ছেড়ে চলে যেতে লাগলেন একে একে। এবং ঠিক তখনই শুরু হল চুরি। কিছু অসাধু লোক বাবুদের কোয়ার্টার, অফিস, বাংলো, ভেঙে আসবাবপত্র, ইঁট, কাঠ খুলে বিক্রি করে দিতে লাগল। রাতের অন্ধকারে ফ্যাক্টরির যন্ত্রপাতি পাচার হতে লাগল গরুর গাড়িতে চাপিয়ে। লোকাল থানা কার্যত চোখবুজে ছিল সেসময়। কিছু নিরীহ শ্রমিক যারা ধরা পড়েছিল তাদের লোভ দেখিয়ে বিপথগামী করা হয়েছিল। আর মূল পান্ডারা দিব্যি ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তৎকালীন প্রশাসনের জোগসাজসে। সেসব দিনের কথা ভাবলে সুবর্ণর একেক সময় মনে হয়, দুর্ভাগ্য যেন সেই ছোট থেকেই তাড়া করেছে তাকে।
-'ইনকিলাব জিন্দাবাদ, শ্রমিক-কর্মচারী একতা জিন্দাবাদ। জলদ্ সে জলদ্ বাগান খোলনা হোগা...মজদুর কা মাঙ্গে পুরি করো...' মিটিং শেষে শ্লোগান উঠতে থাকে মুহুর্মুহু। স্লোগান শেষ হতেই বসন্ত মঙ্গর চেঁচিয়ে বলতে থাকে, 'আপলোগ লাইনমে খাড়ে হো যাইয়ে। হমলোগ অব সব জুলুস করকে বিডিও সাহাব কা পাস যায়গা... তপাহেরু লাইনমা আনু হোস....'
একে একে লাইনে গিয়ে দাঁড়ায় সবাই। মিছিলের পুরোভাগে দুজন মহিলা শ্রমিক ব্যানার ধরে আছে। যাতে লেখা 'নীলপাহাড়ি টি এস্টেট জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি'। বেশ কয়েকজনের হাতে ধরা বাগান খোলার দাবী সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। সুমন্তই পিচবোর্ড,মার্কার সব জোগাড় করে লিখিয়েছে ওগুলো। মিছিলে লোক খুব একটা মন্দ হয়নি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় বোঝা যাচ্ছিল না এতক্ষণ। একজোট হয়ে উঠে দাঁড়াতে কলেবর বোঝা গেল। একেই বোধহয় একতা বলে।
-' আরে, কি হইল সোনা বাবু, যাবেন না...বইসে আছেন যে। ' তির্কি বাবুর ডাকে ঘোর কাটে সুবর্ণর।
-' কেটে পড়ার তাল করছ নাকি হে! ' আচমকা বড়বাবু দিব্যেন্দু রায়ের গলা শুনে অবাক হয় সুবর্ণ। কখন এসে আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বসেছিল নজরেই পড়েনি। এতদিন ধরে লোকটার টিকিও দেখা যায় নি। বাগান বন্ধ হতেই পিঠটান দিয়েছিলেন জলপাইগুড়ির বাড়িতে। একটা মিটিংও অ্যাটেন্ড করেনি। আজ এতদিন বাদে হঠাৎ তার আগমন অবাক করার মতোই বটে। ট্র্যাক্টর থেকে লাফ দিয়ে নেমে সপাটে উত্তরটা দিতে দেরি করে না সুবর্ণ ,
' কাটতে আর পারলাম কই দিব্যেন্দুদা আপনাদের মতো। তা, আজকে হঠাৎ এখানে... কি মনে করে! '
কথাটা লোকটাকে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটল কিনা বোঝা গেল না। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা কৈফিয়তের সুরেই বলতে শুরু করলেন,
-'আরে, আর বোলোনা, বাগান যেদিন বন্ধ হল ঠিক তার পরদিন থেকেই তোমার বৌদি অসুস্থ। এমনিতেই তো জানো, হাই সুগার, প্রেসার... তার ওপর এই খবর পেয়ে আরো টেনশন বেড়ে গেছে। ওকে নিয়েই তো এদ্দিন ধরে টানাটানি চলল.. জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি,কলকাতা...সর্বস্বান্ত অবস্থা।'
লোকটা যে দোষ ঢাকতে চাইছে তা স্পষ্ট হয়ে পড়ে কথায়। বয়স নেহাৎ কম হল না। আর হয়ত বছর খানেক বাদে রিটায়ার করবেন। তবু মিথ্যে বলার অভ্যেসটা গেল না। এই দুনিয়ায় মানুষের গতিবিধি যে মুঠোফোনে বন্দী তা বোধহয় ভুলে গেছেন। মাসখানেক আগেই মূর্তি রিভার বেডে সপরিবারে পিকনিক করে গেছেন। সস্ত্রীক মুরগির ঠ্যাং চিবিয়েছেন আয়েশ করে, গ্রুপ ফটোয় দাঁত কেলিয়েছেন বিস্তর, বৌয়ের সাথে যুগলে ছবি তুলেছেন,আর সেই ছবি যে তার জামাই এর টাইমলাইনে পাবলিক মোডে এখনও শোভা পাচ্ছে সেকথা বোধহয় জানেনই না। আসলে পঁয়ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনে পঁচিশ বছরের ওপর বড়বাবুর পদে থেকে গুছিয়ে নিয়েছেন ভালই। শহরে তেতলা বাড়ি। নিচে দুটো দোকান ঘর ভাড়া, সদ্য কেনা ছোট্ট একটা গাড়ি, যেটা নিজে কিনেছেন বলতে লজ্জা পান। বলেন,' বাগানে চাকরি করে কি আর গাড়ি- টাড়ি কেনা যায়! ওসব আমার ছেলের কেনা। '
ছেলে বছরখানেক হলো এম এন সিতে একটা অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি পেয়েছে। এরই মধ্যে গাড়ির গল্পটা ঠিক হজম হয় না!হলে হবেও বা। তবে ঝুট ঝামেলা দেখলেই মালটা যে গায়েব হয়ে যায় একথা সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে এরকম আন্দোলন- টান্দোলন হলে তো কথাই নেই। আঁচ পেলেই অফিসিয়াল কাজের বাহানা মেরে হয় বাগানের বাইরে কেটে পড়ে, নয় 'সিক' মেরে শুয়ে থাকে ঘরে। সেই মানুষের হঠাৎ এই তুঙ্গ মুহুর্তে অকুস্থলে আবির্ভাবের পেছনে নিশ্চয়ই কোনও হেতু আছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছিল সুবর্ণ। তখনই দিব্যেন্দু তার চাপা উৎকন্ঠাটা উগরে দেয়,
' পেপারে দেখলাম, লাস্ট মিটিংয়েও কিছু হলো না। কী যে হবে? এত বছর চাকরি করলাম। শেষজীবনে এসে কি গেরোয় না পড়া গেল বলতো...বাগান কি খুলবেই না আর! '
' আপনার আর কদ্দিন যেন...? ' সুবর্ণ জানতে চায়।
' আর মাত্র মাস ছয়েক ছিল। '
' তবে তো ফুরিয়েই গেল আপনার দিন। আর চিন্তা কি। এখন ছেড়ে দিলেও কিছু এসে যায় না। আমাদের যে এখনও বহুপথ হাঁটা বাকি। '
সুবর্ণর কথা শুনে হাঁ-হাঁ করে বলে ওঠে দিব্যেন্দু ,' বলো কী! বাগান না খুললে সার্ভিস লাইফই তো কমপ্লিট হবে না। পি.এফ যদিওবা কিছু পাই, গ্র্যাচুইটি তো ঝুলিয়ে দেবে। অতগুলো টাকা...! '
-' তা কেন। যদ্দিন গ্র্যাচুইটি না পান কোয়ার্টার ছাড়বেন না। '
'ধুসসস, তোমারও যেমন কতা... ' কতকটা লালমোহনীয় স্টাইলে হেসে ওঠেন বড়বাবু দিব্যেন্দু রায়, ' ঐ কোয়ার্টারে আর আ-স-সে টা কী? ছেড়ে গেলেই তো ধসে পড়বে এমনিতেই। কোম্পানির তাতে বয়েই গেল। তার চাইতে আরো কটা বছর থাকতে পারলে বরং...আর এই যে.. এই আমাদের স্টাফ ইউনিয়ন, কিসু করতে পারল ? রিটায়ারমেন্ট এজটাও তো ষাট করতে পারলো না অ্যাদ্দিনে.. । মুখেই শুধু বড় বড় কথা... ' কথাটা কার উদ্দেশ্যে ছুঁড়লেন রায়বাবু ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না সুবর্ণ। তবে তার মুখচ্ছবিতে তীরে এসে তরী ডোবার বেদনাটা তেতো শরবত গেলার অভিব্যক্তি হয়ে ফুটে উঠতেই ভীষণ হাসি পেল দেখে।
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক তখনই সামনে থেকে সুমন্ত ডাক দেয়, ' আরে তোরা পেছনে কি করছিস, সামনে আয়।'
ডাক শুনে সামনে এগোয় সুবর্ণ। বাবুরা আরো অনেকে তাকে অনুসরণ করে। কেবল দিব্যেন্দু রায়ের পা দুটোই যেন এগোতেই চায় না।
কথায় কথায় মিছিল অনেকটা এগিয়ে গেছিল। আর দু কিলোমিটার হাঁটলেই ব্লক অফিস। শীতের দিন বলে হাঁটতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না কারুর। তবু তারই মধ্যে সুবর্ণ লক্ষ্য করে দরদর করে ঘামছে সুমন্ত। চেহারাটা বেশ ভেঙে গেছে। বাগান বন্ধ হবার পর থেকে খুব ধকল যাচ্ছে ছেলেটার ওপর। একা থাকে। খাওয়া দাওয়াও করে না সময় মত। শরীরের যত্নও নেয় না তেমন। তবু উদ্যমে ঘাটতি নেই মোটেই। সকলকে একজোট করে সেই প্রথম থেকে একভাবে লড়াই করে চলেছে।
মিছিলের ভেতর থেকে শ্লোগান উঠছে থেকে থেকে। নাগরাকাটা বাজারের ভেতর দিয়ে মিছিল পেরিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মানুষজন চেয়ে দেখছে তাদের। তারা যেন বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপের বাসিন্দা। বাঁচার দাবী নিয়ে, আশায় বুকবেঁধে ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া কিছু মানুষ হেঁটে চলেছে রাজার প্রতিনিধির কাছে দরবার করতে। সেখানে গিয়ে কী পাবে তারা, কোনও আশার বাণী শোনা যাবে কি? কেউ তা জানে না।
সেদিন রাতে নীলপাহাড়ির নিঝুম শ্রমিকবস্তি, বাসালাইনের মানুষজন রোজকার মত দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে ঘুমিয়ে পড়েছিল সাত তাড়াতাড়ি। কুয়াশাঢাকা শীতের রাতে রাস্তার কুকুরগুলোও আস্তানা খুঁজে গুটিয়ে নিয়েছিল নিজেদের। টুঁ শব্দটি বের হচ্ছিল না ওদের গলা দিয়ে। আগরাত্তিরে যারা কাঠকুটো জোগাড় করে আগুন জ্বেলেছিল 'কাঁইয়া'(মুদি) দোকানের সামনে অশ্বত্থ গাছের নিচে, তারাও তাদের আকাশ কুসুম গল্পশেষে ওম খুঁজে নিয়েছিল বিছানায়। একটুখানি ছাইচাপা আগুন বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে ধিকিধিকি জ্বলছিল একা, শিশিরঝরা আকাশের নিচে। চরাচর স্তব্ধ হয়ে প্রহর গুনছিল ভোরের। কোথাও কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। কেবলমাত্র বাসালাইনের একপ্রান্তে নির্জন একটি কোয়ার্টারের বারান্দায় অস্থির পায়ে পায়চারি করতে করতে মোবাইলে কথা বলছিল একটি মানুষ। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা টুকরো টুকরো কিছু উচ্চকিত তীক্ষ্ণ সংলাপ ছিটকে এসে রাতের বাতাসকে হতবাক করে তুলছিল।
-' .....কোনও দিন আমাদের কথা শোনোনি তুমি। শুনলে আজ এই দিন দেখতে হতো না...। নিজে ডুবেছ, সঙ্গে আমাদের নিয়েও ডুবছ। চিরটাকাল একগুঁয়েমি করে গেলে। কারুর কথা শুনলে না। নিজের মুরোদ নেই, বাপেও রেখে যায়নি কিছুই... শুধু বড় বড় বাতেলা... '
' ব্যস, ব্যস...ঢের হয়েছে...এত রাতে তোমার লেকচার শোনার মুডে আমি নেই...সারাদিন ধকল গেছে প্রচুর... বাগান খোলানো নিয়ে টেনশনে রয়েছি...দিনরাত কিভাবে লড়ে যাচ্ছি যাতে বাগানটা খোলে...সেসব জানতে না চেয়ে তুমি...! '
' ওসব শুনে দরকার নেই আমার। নিজের কবর তুমি নিজে খুঁড়েছ... ফলভোগ কর এখন। বাবা কতবার করে বলেছিল বর্ধমানে চলে আসতে। বিজনেসের ইনভেস্টমেন্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় সব করে দেবে বলেছিল, না... তোমার সে কথা পছন্দ হল না। ইগো..তোমার ইগো আর বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট নিয়ে পড়ে রইলে ঐ জঙ্গলে...বাস্তব বুদ্ধি তো কোনো কালেই ছিল না তোমার...আজও নেই। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তারাও তুমি।এখন নেতা হয়েছ। ন্যাতা....তাও যদি কোনও পার্টির লিডার হতে। সেই দমও তো নেই। আ সিলি, ইমোশনাল...ব্লাডি ফুল। '
-অ্যাই.. জাস্ট শাট আপ। ফোন কাটো। মেজাজ ঠিক নেই আমার। প্রতিটা রাত আমার টেনশনে কাটে। নতুন করে আর টেনশন ক্রিয়েট কোরও না। কী বলার ছিল সেটা বলো। '
-' মেয়ে যেতে চাইছে তোমার কাছে। জেদ ধরেছে বাবাকে দেখবে। সারাজীবন আমি আগলে মানুষ করলাম, এখন সে বাপকে না দেখে থাকতে পারে না...যেতে না দিলে যা খুশি তাই করবে বলে থ্রেট দিচ্ছে। এটাই দেখার বাকি ছিল আমার। এখন এই টেনশনের মুহুর্তে ওকে আমি যেতে দিতে পারিনা। বাট শি ইজ সো স্টিকি টু হার ডিসিশন...। তুমি ওকে বোঝাও, যাতে... '
-'ঠিক আছে বলে দেব। আর কিছু? '
-' দু মাস হল একটা পয়সাও দাওনি। কিভাবে চলছে আমাদের একবারও জানতে চেয়েছ তুমি! '
-কেন, তুমি তো শুনেছি বাড়িতেই বুটিক খুলেছ। সেখান থেকে কি কিছুই উপার্জন হচ্ছে না! '
-'সে কৈফিয়ত তো তোমাকে দেব না আমি। এই ব্যবসা আমার নিজের জমানো টাকা, আর বাবার ফিনান্সে গড়ে তোলা। তুমি দাওনি। তাছাড়া আমাদের প্রতি তোমার যে একটা মিনিমাম রেসপন্সিবিলিটি আছে, সেটা ভুলে যেও না। '
- ঠিক আছে। ব্যাঙ্কের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে যা আছে সেখান থেকে আপাতত তুলে নাও। চেকবই তো তোমার কাছেই... '
-' অসম্ভব। ঐ টাকায় আমি মরে গেলেও হাত দেব না। মেয়ের বিয়ের জন্য পইপই করে রেখেছি ওটা। ওতেও শকুনের দৃষ্টি তোমার...! '
-' ওটা তো আমারই উপার্জনের টাকা। '
-' মোটেই না, ওতে আমার বাবার দেওয়া টাকাও আছে। ওতে হাত দেব না। বিয়ে করেছ, মেয়ে পয়দা করেছ, খাওয়ানো পরানোর দায়িত্ব তোমার। কীভাবে দেবে, কোত্থেকে দেবে তুমি জান... '
-' আশ্চর্য, সব জেনেও এসব কথা বলতে পারছ তুমি! বলছি তো বাগান খুললেই পাঠাব। ততদিন তুমি চালিয়ে নাও... '
' একটা কথা বলব...তোমার মত মানুষের সাথে বিয়ে হওয়াটাই আমার জীবনের মস্তবড় অভিশাপ। এ'জীবন আমি চাইনি....স্বপ্নেও ভাবিনি। আই ওয়াজ টু অ্যাম্বিশাস টু লিভ হাই...বাট নাথিং কুড আই গেট ইন মাই লাইফ। কি পেলাম আমি জীবনে তাই ভাবি, না পেলাম পছন্দের জীবন,না পেলাম যাকে চেয়েছিলাম তাকে...মেয়েটা না জন্মালে... '
-' বলো, থামলে কেন, বলো। '
-' ঐ একটা ছোট্ট ভুলের মাশুলই তো দিয়ে চলেছি প্রতি মুহূর্তে। ও না থাকলে তোমাকে অনেক আগেই মুক্তি দিতাম । নিজেও মুক্ত হতাম। পছন্দ মতো স্বাধীন জীবন কাটাতাম,...'
' এসব পুরনো কথা নতুন করে আমি আর শুনতে চাই না। বহুবার বলেছ তুমি। এবার আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও। ফোন রাখছি, ভাল লাগছে না আমার কথা বলতে... '
ফোন কেটে যায়। থেমে যায় কথোপকথন। রেলিংয়ে হাত রেখে ছায়ামূর্তি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে দূর আকাশের দিকে। অনেকক্ষণ কিছু ভাবে। তারপর একসময় ধীরপায়ে নিঃশব্দে বারান্দার দরজা ঠেলে নিজেকে আড়াল করে নেয় নিঃসঙ্গ, নির্জন, অন্ধকার ঘরে।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴