কুমলাই চা বাগিচা/গৌতম চক্রবর্তী
কুমলাই চা বাগিচা
গৌতম চক্রবর্তী
^^^^^^^^^^^^
সাধারণত শীতের শুখা মরসুমে ১৫ ই ডিসেম্বর থেকে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত বাগানে পাতা তোলা এবং উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। শীতের সময় কাঁচা পাতা তোলা ও উৎপাদনের ওপর কড়া মনোভাব নেওয়া হয় এবং সে কথাই বাগানগুলিকে আগে থেকে জানিয়ে রাখা হয়। এই বিধিনিষেধ জারির মূল কারণ ভরা মরশুমে উচ্চমানের উৎপাদন নিশ্চিত করা। উন্নত মানের চা এর লক্ষ্যেই টি বোর্ডের কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। বড়ো ছোটো সব বাগানকেই এই নিয়ম পালন করতে হয়। অতিরিক্ত মুনাফার আশায় কেউ কেউ শীতকালীন
মরসুমে আগাম খারাপ পাতা তুলতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে আগেভাগে সর্তক হয় চা পর্ষদ। কারণ একটি বা দুটি বাগানের ভুল পদক্ষেপ পুরো শিল্পে প্রভাব ফেলতে পারে। গুণগত মানের চায়ের অভাবের ফলে দাম যাতে না কমে যায় তার জন্যই উৎপাদনে রাশ টানার সিদ্ধান্ত শীতের মরসুমে। তাই শীতের মরসুমে যেন কাটিং এবং প্রুনিং ভালোমতো হয় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হয় বাগিচাগুলিকে। আসলে শীতকালে নতুন কুঁড়ি মেলে না। ফলে এই সময় পাতা তোলা হলে রপ্তানির বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। টিআরএ ও উপাসী নামে দুটি চা গবেষণা সংস্থার পরামর্শ মেনেই কাঁচা চা পাতা তোলা ও উৎপাদন বন্ধ রাখার এই নির্দেশাবলী। শীতকালে গুণগতমানের উৎপাদন আদৌ সম্ভব কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য নাগরাকাটা ও ব্যাংডুবির চা গবেষণা সংস্থাকে বলা হয়েছিল। ‘চা গবেষণা সংস্থার’ (টিআরএ) বিজ্ঞানীদের মতামত ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে শীতকালীন কাঁচা পাতা তোলা বা বাগানের উৎপাদনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে টি বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
এসেছি কুমলাইতে। কুমলাই চা বাগান। পরিচালক গোষ্ঠী দি কুমলাই টি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। অমিত কুমার আগরওয়াল, গৌরী আগরওয়াল এবং সজ্জনকুমার আগরওয়াল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। প্রায় ৪২ বছরের এই ঐতিহ্যশালী কোম্পাণী হাত বদল হয়েছে বারংবার। ১৯৭৯ সাল থেকে কোম্পাণি চা উতপাদনের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। দিলীপ কুমার কানোরিয়া, বজরংলাল গনেরিলাল, ওমপ্রকাশ সোনি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ম্যানেজিং ডাইরেক্টরছিল। কানোই গ্রুপের হাতে ছিল বাগান। মালবাজার সাব ডিভিশনের কুমলাই চা বাগানটিতে গেলাম লাটাগুড়ি ছুঁয়ে লাটাগুড়ি-রাজাডাঙ্গা- মালবাজার রোড ধরে। নেওড়া মোড় থেকে বাঁদিকে টার্ণ নিয়ে কুমলাই চা বাগান। বাগানে প্রতিষ্ঠিত টেড ইউনিয়নের সংখ্যা এখন একটিই, ডিটিডিপিএলইউ। শাসক দলের প্রাধান্য হলেও জয়েন্ট ফোরাম শক্তিশালী। কুমলাই চা বাগানটির আয়তন ছোট। চাষযোগ্য আবাদীক্ষেত্র মাত্র ৫৮৭.৬২ হেক্টর। ড্রেন এবং সেচের সুবিধাযুক্ত অঞ্চল ২৯৩.৮২ হেক্টর। প্রতি হেক্টর জমি পিছু ১৬০০ কেজি করে চা ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয়। কিন্তু গুণগত মান ভালো নয়। কুমলাই চা বাগানে নিজস্ব কাঁচা চা পাতা উৎপাদনের গড় ২০ লাখ কেজি। তাই ফ্যাক্টরিতে নিজস্ব উৎপাদিত তৈরি চা মাত্র গড়ে ৪-৫ লাখ কেজি। প্যাকেজড টি উৎপাদনের পরিমান ৬ লাখ কেজি ধরলে মোট বাৎসরিক উৎপাদিত ইনঅরগ্যানিক সিটিসি চা ১১-১২ লাখ কেজি।
শীতের কুমলাইতে এখন বাগানে সবে কাটিং এর পর সবুজ পাতা আসতে শুরু করেছে। এখনো পাতা তোলা শুরু হয়নি। ডুয়ার্স-তরাই ও পাহাড়ের চা বাগানে পাতা তোলার দিনক্ষণ জানিয়ে নির্দেশিকা জারি করে টি বোর্ড। এর আগের বছরগুলিতে বোর্ডের নির্দেশিকা অনুযায়ী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ডুয়ার্স-তরাইয়ের চা বাগানগুলিতে কাঁচা পাতা তোলা শুরু হয়। পাহাড়ের বাগানে সম্ভবত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে পাতা তোলা শুরু হয়। পাতা তোলার মরশুম শুরু হলে প্রথম দফাতে প্রাথমিকভাবে বেশি কাঁচা পাতা পাওয়া যায় না। তবে মার্চের শুরু থেকে প্রিমিয়াম কোয়ালিটির ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাওয়া শুরু হয়ে যায়। এপ্রিল পর্যন্ত এই চা পাতা পাওয়া যাবে। তাই ধরে নেওয়া যায় ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ডুয়ার্স-তরাইয়ের বাগানের পাতা তোলা শুরু হবে। আসলে ফার্স্ট ফ্লাশের উৎপাদনের দিকেই চা শিল্প সারাবছর তাকিয়ে থাকে। তবে করোনাকালীন পরিস্থিতি এবং গত বছর বৃষ্টি ভালো হওয়ায় আগেভাগে বাগানগুলিতে পাতা তোলার অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। বোর্ড তাতে সাড়া দিয়েছিল। কেন এই আগাম উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল বাগানগুলির? সেই সময় মাদারিহাটে যখন আঞ্জুমান চা বাগানে গিয়েছিলাম জিজ্ঞেস করেছিলাম ম্যানেজারকে। "আমাদের নতুন বাগানের গাছের বয়স ২৫ বছর। বুড়ো বাগানগুলি সেচের আওতায় রয়েছে। আমাদের বাগানের গাছে প্রিমিয়াম ফার্স্ট ক্লাসের পাতা এসে গেছে। এর মান অত্যন্ত ভালো। এই চায়ের দাম বেশি পাওয়া যায়। এই চা উৎপাদন না হলে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব" বলে জানিয়েছিলেন মাদারিহাট এর আঞ্জুমান চা বাগানের ম্যানেজার। তাই তাঁরা টি বোর্ড এর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন আগাম পাতা তোলার জন্য।
কুমলাই এর ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম এই বছর তাদের সেরকম কোন পরিকল্পনা আছে কিনা। জানলাম টি বোর্ড অর্ডার না দিলে তাদের পাতা তোলার কোন অধিকার নেই। কোন বছর কবে থেকে পাতা তোলা হবে তা নির্ভর করে আবহাওয়া এবং চা গবেষণা পর্ষদের অনুমতির ওপর। দেখলাম উত্তরবঙ্গের অন্তত ৩৫ শতাংশ চা গাছ দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় বা তার কিছু আগে লাগানো যার জেরে বাগানগুলির উৎপাদন ক্ষমতা এবং পাতার গুণমানও ক্রমশ কমছে। এক একটি চা গাছ ৫০-৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ভাল মানের পাতা দিতে পারে বলে চা গবেষণা কেন্দ্রের দাবি। তার পরেই বয়সের ভারে চা গাছের পাতার গুণমান, স্বাদ গন্ধ কমতে থাকে। বুড়ো হয়েছে উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ চা গাছ। জীবনীশক্তি হারাতে চলা চা গাছগুলিকে বহন করে চলছে উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলি যার পরিণতিতে উৎপাদন ঘাটতির সমুহ সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। এই দাবি কিন্তু শ্রমিক-মালিক দু’পক্ষেরই। পর্ষদ তথা টি বোর্ডেরও দাবি আপরুটিং ও রিপ্ল্যান্টিং না হওয়াতে কমছে উৎপাদন। তাই বাগানগুলিকে পুরোনো চা গাছ আপরুটিং ও নতুন গাছ রোপণ অর্থাৎ রিপ্ল্যান্টিং এই দুটি কাজই শীতের শুখা মরশুমে করতে হয়। বাগানে একসঙ্গে পুরো একটি বিভাগের পুরনো চা গাছ তুলে ফেলা হয়। এই প্রক্রিয়া খরচসাপেক্ষ। কারণ নতুন গাছে পাতা আসতে ৫-৬ বছর লাগতে পারে। তাই প্রুনিং না করে ছেড়ে রাখা অংশ থেকে কাঁচা পাতা তুলে যদি ফার্স্ট ফ্লাশের উৎপাদন বলে চালিয়ে দেওয়া হয় তাহলে চায়ের বাজার আরও সংকুচিত হবে। তাই চা বাগিচাতে আপরুটিং এবং রি প্ল্যান্টিং একান্তই জরুরী। বৃহদায়তন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রায় সব বাগানই এই আপরুটিং এবং রি প্ল্যান্টিং করে। কুমলাইতেও দেখলাম আপরুটিং এবং রিপ্ল্যান্টিং এর কাজ চলছে এবং দেখে ভালো লাগল বাগানটির হাল ফেরানোর প্রচেষ্টা চলছে।
৭৫ জন সাব স্টাফ, ১৫ জন ক্ল্যারিক্যাল এবং টেকনিক্যাল স্টাফ, ফ্যাক্টরিতে নিযুক্ত ৬ জন স্টাফ এবং শ্রমিক সহ স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলে কুমলাইতে স্থায়ী শ্রমিক ৯৮৭ জন। বাগানে শ্রমিক পরিবারের সংখ্যা ৯৫৫। কিন্তু মোট শ্রমিক আবাস ৭৩৮টি। বাগানটির লীজ হোল্ডার কোয়ালিটি টি প্ল্যান্টেশন লিমিটেড। অর্থাৎ বাগানে শতকরা ৬৭ শতাংশ শ্রমিক আবাস এবং অন্যান্য বাসগৃহ আছে। বাগিচায় ব্যাক্তিগত ইলেক্ট্রিক মিটার সহ পাকাবাড়ির সংখ্যা ৬০৬ টি। বৈদ্যুতিক সংযোগবিহীন শ্রমিক আবাসের সংখ্যা জানা যায় নি। ছোট হাসপাতাল এবং ডিসপেনসারি সমৃদ্ধ কুমলাইতে আবাসিক মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার আছে। প্রশিক্ষিত নার্স ১ জন, মিড ওয়াইভস ১ জন, কম্পাউন্ডার অথবা স্বাস্থ্য সহযোগী ২ জন। অ্যাম্বুলেন্স আছে। বাগিচায় লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই ২০১২ সাল থেকে। ভ্রাম্যমান ক্রেশের সংখ্যা ২টি। ক্রেশে পর্যাপ্ত জলের ব্যাবস্থা এবং শৌচালয় নেই। ক্রেশে মোট অ্যাটেন্ডেন্ট ৩ জন। কুমলাই টি গার্ডেনে প্রভিডেন্ড ফান্ড খাতে নিয়মিত অর্থ জমা পড়ে না বলে শ্রমিকদের অভিযোগ। বকেয়া পি এফ এর মোট অর্থ জানা যায়নি। তবে মোটা অঙ্ক বলেই জানা গেছে।
ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে জানতে পারলাম চা বাগানের রেকর্ডে নাম এবং বয়স রয়েছে একরকম অথচ ওই দুই তথ্য সমেত আরো কিছু ব্যক্তিগত তথ্য আধার কার্ডে রয়েছে আরেক রকমের। ফলে অবসরের পর প্রভিডেন্ট ফান্ড বা পেনশনের টাকা পেতে চা শ্রমিকদের চরম হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে। এই অভিযোগে সরব হয়েছে বাগানের মালিক থেকে শ্রমিক সব পক্ষ। তাদের বক্তব্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের নিষ্পত্তি এখন অনলাইনে হয় বলে প্রভিডেন্ট ফান্ডের অ্যাকাউন্টের সঙ্গে ব্যাংক একাউন্ট এবং আধার কার্ডের সংযুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক। তথ্যের অমিল থাকার ফলে বহু ক্ষেত্রেই ক্লেম নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না। চা শ্রমিক থেকে চা বাগানের মালিক সব পক্ষের দাবি আধার কার্ডের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের যার যা গোলমাল রয়েছে সেগুলি সংশোধন করে দেবার জন্য আধার কার্ড আপডেটের বিশেষ অভিযানের ব্যবস্থা করতে হবে। এই মর্মে ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার রাঁচির আঞ্চলিক অফিসে চিঠিও পাঠিয়েছিল চা বাগিচার মালিকদের অন্যতম সংগঠন টি অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া বা টাই। টাই এর ডুয়ার্স শাখার সম্পাদক হিসাবে রাম অবতার শর্মা যখন ছিলেন তখন তিনি জানিয়েছিলেন, আধার কার্ডের সঙ্গে প্রভিডেন্ট ফান্ডের নথিতে অমিল থাকলেও যাতে বাগান কর্তৃপক্ষের শংসাপত্রকে মান্যতা দিয়ে ক্লেম এর নিষ্পত্তি করে দেওয়া যায় সেই ব্যাপারে প্রভিডেন্ট ফান্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আর্জি জানানো হয়েছিল। আসলে একটি চা বাগান থেকে আধার কার্ড তৈরি বা সংশোধনের কেন্দ্রগুলির দূরত্ব যেহেতু অনেক বেশি এবং সংখ্যা হাতে গোনা তাই সেখানে গিয়ে যে একদিনে এই কাজ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আধার কার্ড কর্তৃপক্ষ যাতে চা শ্রমিকদের স্বার্থে বিশেষ অভিযানে এগিয়ে আসে সেই দিকটাও দেখা প্রয়োজন। কিন্তু ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে কথাবার্তা বলে মনে হলএখনও সমস্যার সমাধান বোধহয় হয় নি।
তবে এতদিন চা বাগিচাতে সমীক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়িয়ে যেত সেটা হল সবার কথাই উঠে আসতো চা বাগান বিষয়ক লেখাতে। কিন্তু বাবুদের কথা কিন্তু উল্লিখিত থাকতো না। নিজেদের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে অনেকটা অভিমাণী বাবু সম্প্রদায় নীরবে তাদের দিনাতিপাত করতেন। এবার তাঁরাও যে অবর্ণণীয় দুঃখ দূর্দশার শিকার সেটা বুঝতে পারলাম তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। চা বাগানের পিরামিডসম শ্রেণীবিন্যাসের ভিত্তিভূমিতে অবস্থান সংখ্যাগুরু শ্রমিকের। ঠিক তার উপরের দুটি স্তরে অবস্থান বাবু, স্টাফ এবং সাব স্টাফদের যাদেরকে চা-বাগানের পরিভাষায় অবরবাবুও বলা হয়। সংখ্যা এবং শতাংশের বিচারে এরা সংখ্যালঘু। শ্রমিক মাঠে এবং কারখানায় কাজ করে। পাতা তোলে। তাদের কাজের তদারকি করা, কর্মরত অবস্থায় তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা, কাঁচা পাতা গাড়িতে করে নিয়ে আসা, কারখানায় শ্রমিকদের পরিচালনা করা, তাদের হাজিরা খাতায় তোলা, হাসপাতালে অসুস্থ শ্রমিকের সেবা করা, রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, রাতে মালিকের সম্পত্তি পাহারা দেওয়া ইত্যাদি অনেক কাজের দায়িত্ব পালন করে থাকে সাবস্টাফ শ্রেণী। আর বাগানের শ্রমিকের তোলা কাঁচা পাতা ওজন করে খাতায় হিসেব তোলা থেকে শুরু করে অফিসের যাবতীয় হিসেব নিকেশ, কারখানা পরিদর্শন, পাতার হিসেব কষা, সপ্তাহের শেষে শ্রমিকের মজুরি পাই পয়সা হিসেব কষে তাদের হাতে তুলে দেওয়া, ম্যানেজারের কাজে সাহায্য করা ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব বর্তায় বাগানের স্টাফ অথবা বাবুদের উপর। এই প্রথাই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে চায়ের দেশে। এমনকি শ্রমিকের প্রতি নানা বঞ্চনা এবং শোষণের প্রতিবাদে তাদেরকে জোটবদ্ধ করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সাব স্টাফ শ্রেণি। চা-বাগানের ভাষায় তারা কেউ সরদার, কেউ বৈদার, চৌকিদার ইত্যাদি।
সম্প্রতি চা বাগানের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ঘটনার সূচনা হল যা চলমান রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিচিত পথের বিপরীত এক নতুন পথের দিশারী। চা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা বা বিদগ্ধজন এই ভিন্নধর্মী আন্দোলনকে হয়তো মান্যতা দিতে চাইবেন না, অথবা এই যুগান্তকারী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হতেই পারেন। তবুও যখন চা বাগানের বাবু এবং স্টাফ ও সাব স্টাফেরা দীর্ঘ বঞ্চনা, অবহেলা ও অপমানের প্রতিবাদে একযোগে দলমত নির্বিশেষে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের দাবিতে সোচ্চার হয়ে পথে নামেন তখন তা নতুন পথের দিশা দেখায়। এমন অনেক মানুষ শ্রমিকের স্বার্থে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে শহীদ হয়েছেন। কেউ আবার যোগ্যতার নিরিখে হয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। শ্রমিকের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন এমন বাবু বা স্টাফ এখন বিরল নয় যাদের অনেকেই পরিচিত জনপ্রতিনিধি। এরা সবাই চা বাগানের তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে শ্রমিকের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ন্যায্য পাওনা আদায় করে নিয়েছে। অথচ ইতিহাস সাক্ষী যখনই স্টাফ অথবা সাব স্টাফদের দাবি আদায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়, তখন বার বার তা উপেক্ষিত হয় অথবা নিতান্ত দায়সারা গোছের বেতনের চুক্তি করে তাদের দীর্ঘদিনের বকেয়া অন্যান্য দাবি কার্যত ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন শ্রমিক স্বার্থে লড়াকু এই সমস্ত নেতারা নিজেদের স্বার্থে সোচ্চার হতে পারেন না বা তাদেরকে সোচ্চার হতে দেওয়া হয় না। যুগের পর যুগ এভাবেই উপেক্ষিত হয়ে এসেছেন স্টাফ এবং সাব স্টাফেরা। এমনকি যখন শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরির মাপকাঠি স্থির হয় তখন অবরবাবু এবং বাবু সমাজ জানে না তাদের ন্যূনতম মজুরির মাপকাঠি কী হবে। প্রশ্ন হল, মজুরির বিনিময়ে শ্রম দান যে করে সে যদি শ্রমিক হয় তাহলে ওই দুই শ্রেণীও শ্রমিক। তাহলে তাদের প্রতি সর্বস্তরের এই অবমাননা এবং তাচ্ছিল্যের মনোভাব কেন? এই ভাবনা মাথায় নিয়েই ঘরের পানে রওনা হলাম। ঠিক করলাম পরের সপ্তাহে নিদাম বাগানে গিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴