আমি এক যাযাবর-১৩/শৌভিক কুন্ডা
আমি এক যাযাবর
১৩তম পর্ব
শৌভিক কুন্ডা
আরিতারের থেকে লিংতাম হয়ে(এখানে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়ে রেশমপথের ছাড়পত্র নিতে হত) জুলুক পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেছিলো আমার। পথেই বুঝতে পারছিলাম ঠান্ডা কাকে বলে! গোপালবাবুর ছোট্ট আস্তানায় ঢুকতে ঢুকতে হাত-পা জমে বরফ হওয়ার যোগাড়। সন্ধ্যে গাঢ় হতে হতে শীতের কামড়ও বাড়তে লাগলো। আমার ধুমসো জ্যাকেট আর রাম-অস্ত্রও পাল্লা দিতে পারছিল না সে হিংস্রতার সাথে। অতএব চাইনীজ ব্ল্যাংকেট আর বুখারির আনুগত্য। এক মাগ কালো কফির অনুরোধ জানানোতে হাসিমুখ কর্ত্রী জানালেন একটু অপেক্ষা করতে। এবং ঐ একটুই অপেক্ষা। কফি তো এলোই সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা মোমো, সাথে রগরগে লাল চাটনি। মফস্বলেও এখন পাড়ার মোড়ে মোড়ে মোমো বলতে যে বস্তু চালানো হয়, স্বাদে-গন্ধে এ একেবারেই অন্যরকম। কেবল, যতই ধোঁয়া উঠুক, পলকে জুড়িয়েও যাচ্ছে, জুলুকএর সাড়ে ন হাজার ফুট উচ্চতায় ঠান্ডার ছোঁয়া লেগে! রাতের সব্জি ছেটানো খিচুড়িরও অবস্থা একইরকম!
বিছানায় কিছুক্ষণ একঠাঁই হয়ে শুয়ে থাকলে ঠান্ডা কম লাগে, এ আমার বরাবরের ধারণা।সে রকম থাকতে থাকতেই আধো ঘুমের ভেতর ঢুকে যায় বইপড়া শব্দগুলো, যারা আগামীকাল থেকেই আমার সামনে জীয়নকাঠির স্পর্শ পাবে! জুলুক থেকে কুপুপ হয়ে জেলেপ লা---- যে পথে তিব্বত! যদিও সে সময়ে সীমান্ত প্রতিরক্ষার কারণে জেলেপ লা পর্যন্ত যাওয়া নিষিদ্ধ। তবু তার কিলোমিটার পাঁচেক দূর অব্দি তো নিশ্চিন্ত ভ্রমণেচ্ছা! এ পথেই ১৯৫০এ ঘোড়ায় চেপে জওহরলাল নেহরু মেয়ে ইন্দিরাকে নিয়ে এসেছিলেন ইয়টুং পর্যন্ত। ১৯৫৬তে দলাই লামার পরিক্রমন! এই জেলেপ লা সীমান্তপথ ধরে ব্যবসা চলতো বিনিময় প্রথায়, আর নাথু লা'র পথে মাধ্যম ছিলো টাকা-পয়সা। নাথু লা তো এখন গ্যাংটকের ট্যুরিস্টদের কাছে বাবুঘাটে হাওয়া খেতে যাওয়ারই সামিল! কিন্তু আমরা যাবো, ফিরবোও যে পথ ধরে, তার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে হাজার হাজার বছরের পুরনো কথকতা! কত কথা!
এতসব এলোমেলো ভাবনার ভেতরে ঘুমও আসে আর যায়। এভাবেই ভোররাত। গরম কফি হাতে গোপালের ডাক সাড়ে তিনটেয়। তাড়াতাড়ি বলতে হুড়োহুড়িই, আধ ঘন্টার ভেতর তৈরি হয়ে নিয়ে গাড়িতে ওঠা। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম "সব থেকে উঁচু পাহাড়ে"! হ্যাঁ, লুং থুং শব্দটির আক্ষরিক অর্থ তাই-ই। বাস্তবিকই, রংলি থেকে শুরু করে যতটা পথ পেরোলাম, এ মুহুর্তে লুংথুং এর যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সে পয়েন্টটিই এ পথের সবচাইতে উঁচু জায়গা। পথে রেখে এসেছি থাম্বি ভিউ পয়েন্ট, ভুলভুলাইয়া। এদের সাথে পরিচিতি হবে ফেরার পথে। আপাতত অপেক্ষা! তবে, খুব বেশিক্ষণের নয়। সূর্যদেবের ঘুম ভাঙলো আর চোখের সামনে যেন জাদু তুলির ছোঁয়ায় ফুটে উঠলো স্বর্গীয় ল্যান্ডস্কেপ। পায়ের নীচে সাদা মেঘের ভীড় আর কাঞ্চনজঙ্ঘার মুকুটে সোনার ছোঁওয়া! সে সোনালি পাল্টে যায় কমলা, রক্তিম রঙে। সব শেষে রঙের পালাবদল থামিয়ে স্পষ্ট জেগে ওঠে রূপোলী কাঞ্চনজঙ্ঘা, জেগে ওঠে কোকতাং, রাথোং,কাবরু কুম্ভকর্ণ -- ভুটান পাহাড়ের বিস্তৃতি! আলো আরও কিছু বয়সী হলে চোখের সামনে ফুটে ওঠে ডুয়ার্স, সিকিমের বার্ডস আই ভিউ!
সারাটা দিন যদি ভোর হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতো, লুংথুংই তবে আমারও পায়ের নীচে শেকড় গেঁথে দিত। কিন্তু সময়ের চলমানতা বাধ্য করলো আবার গাড়িতে উঠতে। কিছু দূর মাত্র গড়ানোর পরই নীচে দেখা গেল নাথাং ভ্যালি। তুষারছাওয়া উপত্যকায় জেগে জেগে আছে খেলনার মতো পাহাড়ি ঘর বাড়ি, সেনা ছাউনি, কোথাও আবার তুষার শুভ্রতার ভেতর থেকেই মাথা তুলেছে রঙিন ফুলের ঝোপ, বঙ্কিম চালে বয়ে চলেছে স্নেক রিভার। আর এই জীবন্ত ল্যান্ডস্কেপটিকে পাহারা দিতেই বুঝি বা সটান দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা! দু চোখে নাথাংএর রূপ শুষে নিতে নিতে ফ্ল্যাগ হিল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম পুরনো বাবাধামে। গ্যাংটক থেকে ডে আউটিংএ বেরিয়ে যে বাবা মন্দির দেখানো হয়, তার পত্তন কিন্তু অনেক পরে হয়েছে। আর আমরা এখন যেখানে, যার নাম টুকলাদাঁড়া, এখানে যে স্মৃতিমন্দির, পাঞ্জাব রেজিমেন্টের উদ্যোগে বানানো, সেটিই আদি বাবা ধাম।
১৯৬৮তে এই পাঞ্জাব রেজিমেন্টেরই বীর জওয়ান হরভজন সিংহ কিছু মালবাহী খচ্চরকে বাঁচাতে গিয়ে পাহাড় থেকে নীচে নদীতে পড়ে মারা যান। এরপর থেকেই নাকি এতদঞ্চলে ঘটে যেতে থাকে একের পর এক অলৌকিক ঘটনা, যার সবটাই নাকি মৃত হরভজন সিংহের কল্যাণে! ফলতঃ স্থানীয় বাসিন্দা এবং জওয়ানদের কাছে হরভজন হয়ে ওঠেন "বাবা", আর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই গড়ে ওঠে এই বাবামন্দির। চোদ্দ হাজার ফিট উচ্চতায়, হরভজন সিংহের জীবনকালে তাঁর ব্যবহার করা এবং আজও সযত্নে রক্ষিত বাংকারটির সামনে দাঁড়িয়ে অলৌকিক না হলেও অননুভূত এক শিহরণ জাগে মনে। প্রবল ঠান্ডায় ঠকঠকে কাঁপুনির মধ্যে অতিথিবৎসল ফৌজীদের বাড়িয়ে দেওয়া কফির মাগে মিশে থাকে মানবিক উষ্ণতাও!
তাঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফের রওনা হলাম। এবার গন্তব্য কুপুপ। এখানকার হ্রদটির থেকেই পথচলা শুরু জলঢাকা নদীর। আকৃতিতে কিছুটা সামঞ্জস্য হাতির মাথার সাথে, তাই এ হ্রদের চলতি নাম 'এলিফ্যান্ট লেক'! লেকের পাড়ে চরে বেড়াচ্ছে ইয়াকের দল। এখান থেকে জেলেপ লা সীমান্ত মাত্রই পাঁচ-ছয় কি.মি, কিন্তু প্রতিরক্ষার নজরদারিতে আমাদের জন্য সে পথ বন্ধ। কুপুপ ছাড়িয়ে অল্প এগোতেই ডানহাতে " ইয়াক গল্ফ কোর্স" প্রায় চোদ্দ হাজার ফুট, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু গল্ফ কোর্স। মিলিটারিদের তৈরি করা এই গল্ফ কোর্সের নাম গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এর পাতাতেও আছে। এর ঠিক পরপরই রাস্তার বাঁকে তিরচিহ্ন দেখানো সাইনবোর্ড। নির্দেশ করা আছে মূল রাস্তা থেকে সরে যাওয়া অপেক্ষাকৃত সরু একটি পথের দিকে, নাম "ইয়াং হাসব্যান্ড ট্র্যাক" যে ট্র্যাক ধরে মাত্রই ৫২০ কিলোমিটার প্রাচীন তিব্বতের লাসা!
এর পরের দ্রষ্টব্যটিই মেমেঞ্চো লেক। গাড়ি নামবে না, তবে দু-তিন কি.মি পাথুরে রাস্তায় হেঁটে লেকের কাছে পৌঁছে বোঝা যায়, পরিশ্রম সার্থক! চারদিক থেকে সবুজে সবুজ পাহাড় যেন যত্নে আগলে রেখেছে হ্রদটির নীল।মেমেঞ্চো লেকই সিকিমের বিখ্যাত রংপো নদীর উৎস। আর একটু এগিয়ে গাড়ি থামে নবনির্মিত বাবামন্দিরে। গ্যাংটক থেকে নাথু লা - ছাঙ্গু ডে ট্রিপে পর্যটকেরা যেখানে সাধারণত ঘুরে আসেন। এই বাবামন্দির থেকে নাথু লা দশ বারো কিলোমিটার দূর। কিন্তু এ যাত্রা আমরা সে পথ ছাড়ি। বরং গ্যাংটকগামী রাস্তায় কিলোমিটার পনেরো উজিয়ে চলে যাই ছাঙ্গু লেক। পথেই পেয়ে যাই শেরাথাং মারট। চীন-ভারত বাণিজ্য নূতন করে শুরু হওয়ার পর দু-দেশের ব্যবসায়ীরা তাঁদের পসরা নিয়ে হাজির হন এই বিরাট অট্টালিকাটিতেই। এই শেরাথাং মার্টেই রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ অবস্থানের এটিএম! ছাঙ্গু পৌঁছে সবার আগে নিজেকে তৃপ্ত করি লেকপথের শুরুতে বরফমুকুট দোকানে একদম আসলি থুপ্পা(মতান্তরে থুকপা)র স্বাদ নিয়ে। তারপর লেকবিহার। কয়েক বার এসেছি, তবু যেন চিরনূতনই, ছাঙ্গু! ধবধবে সাদা বরফ আর নীলচে জলের লুকোচুরি খেলা! জলের বুকে ধরা রয়েছে জাদু আয়নার ফ্রেমে বাঁধানো বরফঢাকা পাহাড়, ব্রাহ্মণী হাঁস আর পরিযায়ী পাখিদের চঞ্চলতা মাঝে মাঝেই ভেঙে দিচ্ছে সে প্রতিচ্ছবি!
জুলুকের ফিরতি পথে লুংথুং আর থাম্বি ভিউপয়েন্টের মাঝখানে পৃথিবীবিখ্যাত সেই ভুলভুলাইয়া! জিগজ্যাগ এ রাস্তাটিতে রয়েছে মোট পঁচানব্বইটি বাঁক! এই ওপর থেকে দেখে মনে হয় এক অতিকায় সরীসৃপের অনন্ত যাত্রাপথ যেন! কখনো মেঘের দল এসে ঝাপসা করে দিচ্ছে, তো পরক্ষণেই রোদ্দুরের হাত ধরে চোখের সামনে ঝকঝকে পিকচার পোস্টকার্ড! আর একটু এগোলেই থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। আমরা একে পেরিয়ে গেছিলাম ভোররাতে। যদিও পরে জেনেছি, সূর্য ওঠা দেখার জন্য লুংথুংএর চেয়েও থাম্বির খ্যাতি বেশি। বিকেলশেষের নেভা নেভা আলোর থাম্বি অবশ্য নিরাশ করে নি আমাকে! এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে ভেসে এলো সেই কোন শৈশবে পিছে ফেলে আসা দীপান্বিতার সন্ধ্যার কথা! সকাল থেকে অক্লান্ত অপটু হাতে গড়া পাহাড়, সন্ধ্যেয় তাতে ছোট ছোট প্রদীপের বসতি, খেলনা বাড়িঘর, খেলনা গাড়ি দিয়ে সাজানো! এখন এই থাম্বি ভিউপয়েন্ট থেকে দূর দূর পাহাড়ি বসতিতে টুপটাপ জ্বলে উঠতে থাকা আলোর বিন্দু, ভুলভুলাইয়া পথে গড়াতে থাকা মিলিটারি ট্রাক-----সবই এতো ছোটো ছোটো------যেন সেই হারিয়ে ফেলা ছেলেবেলাটাই আমার!
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴