অন্তহীন আকাশের নীচে/১৩
অন্তহীন আকাশের নীচে
পর্ব ১৩
দেবপ্রিয়া সরকার
----------------------
কৃষ্ণপক্ষের নিকষ কালো আকাশ জুড়ে অজস্র তারা ফুটে ছিল একটু আগে। এখন কোথা থেকে যেন একফালি মেঘ এস তাদের ঢেকে দিচ্ছে। পাখি খোলা জানালার ধারে বসে নির্নিমেষ চেয়ে আছে আকাশের দিকে। এই উদার অনন্ত শূন্য নিজের বুকে আশ্রয় দিয়েছে হাজার হাজার আলোক বিন্দুকে। মানুষও কি কখনও আকাশের মতো উদার হতে পারে? শুধু নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে আপন করে নিতে পারে কি সবকিছুকে? হয়তো পারে না। আর পারে না বলেই মানুষ কখনও আকাশ হয় না। তাই পাখির কাছে তার ছোট্ট সুন্দর জীবনে স্বয়ংদ্যুতির মতো কোনও ঝলমলে মানুষের অনুপ্রবেশকে অসহনীয় মনে হয়। স্বয়ংদ্যুতির উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে বড্ড ফ্যাকাসে লাগে তার। স্বয়ংদ্যুতিদের ঔজ্জ্বল্যে আকর্ষিত হয় ইন্দ্রায়ুধরা। পাখিরা পড়ে থাকে অবহেলায়, অনাদরে, নির্জন ঘরের এককোণে। রাগ, অসূয়ার দাউদাউ আগুনে দগ্ধ হয় তারা। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে এই নিষ্ঠুর পৃথিবী ছেড়ে।
-পাখি এই দুধটুকু খেয়ে নে মা।
ভাবনার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে পাখি দেখল তার মা হাতে একখানা দুধের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
-উফ্! মা তুমি তো জানো দুধের গন্ধে আমার বমি পায়। তারপরেও কেন?...
পাখি কথা শেষ করার আগেই বকুল বলল, একদম জেদ করবি না। শুনিসনিই ডাক্তারবাবু কী বললেন? তোর প্রেসার লো হয়ে গিয়েছে। এখন একটু পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। নাহলে শরীর আরও খারাপ হবে। বলা নেই, কওয়া নেই আজ কেমন কোচিং ক্লাসে অজ্ঞান হয়ে গেলি বলতো? ভাগ্যিস স্যাররা সঙ্গে সঙ্গে পাশেই ডাক্তার সেনের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। আমার তো খবরটা শুনেই হাত-পা কাঁপছিল।
দুধের গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে পাখির পাশে বসল বকুল। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কেন এতো চিন্তা করছিস? পরীক্ষার এখনও অনেক দেরি। সারা বছর মন দিয়ে পড়লেই ভাল রেজাল্ট করতে পারবি। তোর মাথাটা তো ভালো। এখন উঠতি বয়স। শরীরে, মনে অনেক পরিবর্তন আসবে। সেগুলোর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে তোকে। তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল? তোকে সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে মানুষ করব বলেই তো আমাদের এতো খাটুনি করা।
বকুলের কথা শুনে পাখির বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টের পাহাড়ে আচমকাই ধ্বস নামল। মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। বকুল পাখির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ভয় পাস না মা। নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে যা। দেখবি কোনও কিছুই তোর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। চিন্তা করে করে শরীর খারাপ না করে পড়াশোনার পাশাপাশি খাওয়া দাওয়াটাও ভাল করে কর।
মায়ের বুকে মুখ গুঁজে অনবরত ফোঁপাচ্ছিল পাখি। বকুলের বলা কথাগুলো শুনে তার ভেতরের কষ্টটা আরও চাগাড় দিয়ে উঠছে। কোচিং সেন্টারে জ্ঞান হারানোর পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কাছেই ডঃ সেনের ক্লিনিকে। ডাক্তারবাবু বলেছেন স্ট্রেসের জন্য পাখির নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছিল। কোনও বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করার ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মানে খাওয়া, ঘুম ইত্যাদির ব্যাঘাত ঘটলে এরকম হতে পারে। ডাক্তারবাবু তাকে বেশি চিন্তাভাবনা করতে বারণ করেছেন। কয়েকটা অ্যাংজাইটির ওষুধ দিয়ে বলেছেন শরীরের যত্ন নিতে। মাঝে মাঝে কাছেপিঠে বেড়াতে যাবার, বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করার, গল্পের বই পড়ার, কিছু স্ট্রেস রিলিফ এক্সারসাইজ করার এবং সিনেমা দেখার উপদেশও দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। ডাক্তার সেনের কথা শুনে সকলেরই ধারণা হয়েছে পরীক্ষা আর পড়াশোনা নিয়ে অতিরিক্ত চাপ নেওয়ার ফলেই সমস্যা হচ্ছে পাখির। কিন্তু তার বুকের ভেতর জমে থাকা আসল কষ্টের হদিশ কেউ পায়নি।
পাখিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দুধটুকু খাইয়ে নিজের কাজে চলে গেল বকুল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে পাখি খুলে বসেছিল আজ ক্লাসে ইন্দ্রায়ুধের দেওয়া বইটা। একটা দুটো করে পাতা উল্টে পাল্টে দেখছিল সে, তখনই বাইরে থেকে একটা পরিচিত শব্দ কানে এল তার। শব্দটা অবিকল ইন্দ্রায়ুধের বাইকের আওয়াজের মতো। কয়েক মুহূর্তের জন্য পাখি ভাবল হয়তো মনের ভুল কিন্তু পরক্ষণেই পাশের ঘর থেকে ভেসে এল ইন্দ্রায়ুধের গলার স্বর। পাখি খাটের ওপর সোজা হয়ে বসল। ইন্দ্রদা তাকে বাড়ি বয়ে দেখতে এসেছে ভেবেই আনন্দে ভরে উঠল মন। শুনতে পেল তার বাবা বলছে, আরে তোমরা? এসো এসো কী সৌভাগ্য আমাদের! আর বলো না হঠাৎ করে কী যে হল মেয়েটার! দুপুরে তো ঠিকই ছিল। হ্যাঁ, এখন অনেকটা ভাল আছে। ওই তো ওই ঘরে শুয়ে আছে। পাখি, পাখি মা, দেখ কারা এসেছে তোকে দেখতে।
উত্তেজনায় প্রচণ্ড জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিল পাখি। সেই সমুদ্র-সবুজ রঙের শার্টটা এখনও রয়েছে ইন্দ্রায়ুধের গায়ে। ইন্দ্রায়ুধ পাখির সামনে এসে দাঁড়াতেই আরও একজন প্রবেশ করল ঘরে। পরনে মেরুন টপ আর কালো জিন্স। হাতে একগোছা রঙবেরঙের গোলাপ ফুল নিয়ে পাখিকে অবাক করে হাসিমুখে ইন্দ্রায়ুধের পাশে এসে দাঁড়াল স্বয়ংদ্যুতি। বলল, আরে পাখি কী হল তোমার? কালই তো দিব্য সুস্থ ছিলে।
ইন্দ্রায়ুধ এসেছে দেখে যে খুশির প্রলেপ পাখির মনে পড়েছিল স্বয়ংদ্যুতির আগমনে সে প্রলেপ গায়েব হতে কয়েক মুহূর্ত লাগল মাত্র। তবুও জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে সে বলল, তেমন কিছু হয়নি টুপুরদি, মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল সামান্য।
-কোথায়? দেখি জ্বর ট্বর আছে নাকি?
দ্রুত পায়ে পাখির বিছানার কাছে এসে তার কপালে হাত ঠেকাল স্বয়ংদ্যুতি। বলল, উঁহু, গা গরম নেই। ও কিছু হবে না, টেনশন থেকে মাঝেমধ্যে এমন হয়। এই ফুলগুলো ধরো। রঙিন ফুল মনকে রিফ্রেশ করে, তাই নিয়ে এলাম।
পাখি ম্লান স্বরে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।
-তোমরা বসো। আমি চা করে আনি।
দু’খানা চেয়ার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠল বকুল। ইন্দ্রায়ুধ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, না না তার দরকার নেই। চা খাব না এখন। শুনলাম ডক্টর সেন বলেছেন অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে এমনটা হয়েছে। চিন্তা করার কিছু নেই।
-হ্যাঁ, তাই তো বললেন ডাক্তারবাবু।
-এতো চাপ কেন নিচ্ছ পাখি? পরীক্ষার ফল ভাল হওয়া বা না হওয়াটা সবসময় নিজের হাতে থাকে না। আমরা শুধু সাধ্য মতো চেষ্টা করতে পারি। তারপর যা হবে সেটা ডেস্টিনি। ও নিয়ে অযথা দুর্ভাবনা করে শরীর খারাপ করার কোনও মানে হয় না।
বকুল আর সুরেন ইন্দ্রায়ুধের সঙ্গে একমত হলেও পাখি কোনও উত্তর দিল না। কেবল নির্বাক দৃষ্টিতে ইন্দ্রায়ুধের দিকে চেয়ে থাকল। তার চোখের ভাষা কি পড়তে পারবে ইন্দ্রায়ুধ? স্বয়ংদ্যুতি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, একদম ঠিক বলেছে ইন্দ্র। এই কারণে পরীক্ষা টরিক্ষা নিয়ে আমি কোনও দিনই খুব বেশি প্রেশার নিই না। কিন্তু পাখি আজ বাদে কাল দিদার জন্মদিন। আমরা এতো দূর থেকে এলাম সেলিব্রেট করতে। কতো প্ল্যানিং, প্রোগ্রাম। এর মাঝে তুমি এরকম বিছানায় শুয়ে থাকলে চলবে? কাল সকালের মধ্যে তোমায় সুস্থ হয়ে উঠতেই হবে। আমি কিচ্ছু জানিনা, সক্কাল সক্কাল ও বাড়িতে তোমায় দেখতে চাই। আমি ভেবে রেখেছি তোমায় নিয়ে পার্লার যাব, শপিং করব। আর সেই তুমি কিনা...
স্বয়ংদ্যুতির কথার মধ্যে একটা অদ্ভুত মায়া জড়ানো ছিল। কথাগুলো পাখির মনকে ছুঁয়ে গেল গভীরভাবে। সে বলল, তুমি চিন্তা করো না টুপুরদি, আমি একদম সুস্থ আছি। কাল আমি মায়ের সঙ্গেই চলে যাব ও বাড়ি। দিদার জন্মদিন বলে কথা। আমি যাব না তা কি হয়?
-এই তো লক্ষ্মীসোনা মেয়ে।
পাখিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল স্বয়ংদ্যুতি। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এবার আমায় যেতে হবে। দিদিভাই অলরেডি চারবার ফোন করে ফেলেছে। টেক কেয়ার।
ইন্দ্রায়ুধ বলল, এখন দু’একটা দিন একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও, তারপর আবার পড়াশোনায় মন দিও, কেমন?
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ইন্দ্রায়ুধ আর স্বয়ংদ্যুতি। একসঙ্গে বেশ দেখাচ্ছে তাদের। তারা বেরিয়ে যাবার পর মনটা অনেকটা হালকা লাগছিল পাখির। এই পৃথিবীতে সবকিছু বোধ হয় সকলের জন্য তৈরি হয়না। মানুষ তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করেই খুঁজে নেয় বেঁচে থাকার অবলম্বন। বেছে নেয় সমরুচির বন্ধু, সহচরদের। ইন্দ্রায়ুধের মতো শিক্ষিত, ভদ্র, সুদর্শন যুবক স্বয়ংদ্যুতির মতো স্মার্ট, সুন্দরী, বিদুষীদের পছন্দ করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
কিছুক্ষণ আগেও যে ঈর্ষা এবং ক্ষোভের কুয়াশা পাখির মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল স্বয়ংদ্যুতি আর ইন্দ্রায়ুধের আগমনে সেই কুয়াশা কেটে গিয়েছে অনেকটাই। নির্ভার লাগছে নিজেকে। স্বয়ংদ্যুতির রেখে যাওয়া ফুলের গোছাটা পাখি হাতে তুলে নিল। নাক ডোবাল রঙবেরঙের ফুলের তোড়ায়। গন্ধ নিল বুক ভরে । টাটকা গোলাপের সুরভীতে সজীব হয়ে উঠল মন-প্রাণ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴