স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/দ্বাদশ পর্ব
রণজিৎ কুমার মিত্র
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
" কোন পুরাতন প্রাণের টানে ...
চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে,
ভাবনা ভাসে পুব বাতাসে।"
বিশ্ববিদ্যালয়ের
ক্লাস, সিলেবাসের বাইরে এক অনাবিল আনন্দের জগত ছিল। ঋজু ইউক্যালিপটাস,
শিমুল, পলাশ-শালের ছায়াতলে, কখনো নকুলদার ক্যান্টিনে, আর্টস বিল্ডিং থেকে
লাইব্রেরি যাওয়ার নির্জন রাস্তাটুকুতে দলবেঁধে, কখনো মাগুরমারি নদীর কাঠের
সাঁকোয়
দাঁড়িয়ে থাকে দুই নির্জনতা অভিলাষী সঙ্গী,
আবার কখনো এক নম্বর বা দুই নম্বর গেটের পাথরের বেঞ্চিতে মুখোমুখি দুজনে বসে
থাকা, লাইব্রেরীর রিডিং রুমে বসে অন্যমনস্ক ভাবে একা বইয়ের পাতা
ওল্টানো। গার্লস হোস্টেলের সামনে দিয়ে যাবার সময় চাতক পাখির মতো চেয়ে
থাকা, শনিবারের হাফ ছুটিতে বন্ধু-বান্ধবীদের সপ্তাহান্তিক বাড়ি যাবার
উল্লাস। এই সবকিছুই ছিল নিজস্ব যাপনের, সিলেবাসের বাইরের। দূরে নীল
সবুজ পাহাড়ের হাতছানি। ভোরের কুয়াশা, আর আঁধার রাতে মাগুরমারি র পুলের
নীচে জোনাকিদের জমাট বাঁধা আগুনের ফুলকি। যেন রূপকথার রাজ্যের আশ্চর্য
রহস্যময়তায় মোড়া রাতের ক্যাম্পাস।
অনেকদিন
আগে শিয়ালদা স্টেশনের নয় নম্বর প্লাটফর্মে, যেখানে দার্জিলিং মেল এসে
দাঁড়ায় সেখানের দেয়ালে সাঁটা এক হ্যান্ডবিলে দেখেছিলাম "দূরে থাকা আমরা
কজন"দের আবেদন। কয়েকজন কলকাতা নিবাসী উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রাক্তনীদের আকুতি, তারা মাসে একবার এই প্লাটফর্মে বা কাছাকাছি কোন
রেস্টুরেন্ট মিলিত হন।উত্তরবঙ্গের প্রাণের টানে, আগামীতে তাদের সম্মিলনের
অনুষ্ঠানসূচি ঘোষণা সব জানানো হয়েছে। প্রাক্তনীদের উত্তরবঙ্গে যাওয়া-আসার
এই জনপ্রিয় ট্রেনটির যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই বোধহয় এই
ঘোষণাপত্র দেওয়ালে লাগানো হয়েছিল। তখন তো যোগাযোগ করবার এত মাধ্যম ছিল
না, হৃদয়ের টানই ছিল যোগাযোগের একমাত্র ভরসার স্থল ।
আজ
আর হৃদয়ের কথা বলবার জন্য অত উদ্বেগ-আকুলতা দুর্ভাবনার উপশম করে দিয়েছে
তথ্য প্রযুক্তি, বহু বৈদ্যুতিন সমাজ মাধ্যম গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের "প্রাক্তনী সমিতি" ভরসা জোগাচ্ছে। N. B. U. A.
A. family Whats App Groupটিও সংযোগের ক্ষেত্রে এক অনবদ্য ভূমিকা নিয়েছে।
এইসব
আবেগ উচ্ছ্বাস ভাবাবেগ নিয়ে হয়তো এ প্রজন্মের, আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা
উত্তরবঙ্গে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছে, তাদের কাছে একটু বাড়াবাড়ি বলে
মনে হতে পারে। তারা তো জানেন না কত স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা উত্তরবঙ্গের এই
প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি, যা আমাদের কাছে তখন এতো সহজপ্রাপ্য ছিল না।
তাছাড়া আমাদের মধ্যে তখন বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন এই
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রজন্মের। আজকের দিনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়
উচ্চশিক্ষা লাভের প্রাচুর্য, প্রাদুর্ভাব কোনোটাই তখন ছিল না। সময়ের খেয়া
বাইতে বাইতে, ঈশ্বর পাটনীর মতো আমাদের অভিভাবকদের একটাই স্বপ্ন ছিল "আমার
সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে" আজ সেই সব স্বপ্ন অনেকটাই সাকার হয়েছে,
কিন্তু যে উচ্ছ্বাস আর আবেগ নিজের বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আমরা অনুভব
করতাম, তা এখন বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। হয়তো চাহিদা ও
যোগানের মধ্যে সুসমন্বয় ঘটেনি। শিক্ষাকে এখন কেউ কেউ পণ্য বলে থাকেন ।
এখন
যেখানে ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, সেটি ছিল ছোট্ট দোতলা বাড়ি,
"বিদ্যাসাগর ভবন", একতলার একদিকে Students' ক্যান্টিন অন্যদিকে ছোট হলঘর।
তখন বক্তৃতা, সেমিনার ওখানে হত। প্রথমে ম্যানেজমেন্ট বিভাগ যখন খোলা হল তখন
তদানীন্তন রাজ্যপাল ও সদ্যপ্রয়াত আচার্য সৈয়দ নুরুল হাসানের নামে
ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট নামাঙ্কিত ছিল, পরে ঐ নাম কেন বাদ গেল জানি না
।আমাদের সময়কার "বিদ্যাসাগর ভবন"টি আর নেই ।ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পাশেই
বড়োসড়ো একটি ক্যান্টিন হয়েছে। আমাদের ওই বিদ্যাসাগর ভবনের ছোট
ক্যান্টিনটি ছিল সব বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের মিলনকেন্দ্র। সেখানে খাওয়া আর
আড্ডার স্মৃতি এখনো অনেকের মনেই জমা আছে। আর্টস ফ্যাকাল্টির ডীনের অফিস
থেকে পনেরো কি কুড়ি টাকার কুপন পাওয়া যেত প্রতি মাসে। পাঁচ পয়সা, দশ
পয়সা, পঁচিশ পয়সার কুপন। ক্যান্টিনে কুপন দিয়ে খেতে হত। সব জিনিসই
অর্ধেক দাম ছিল। পাঁচ পয়সায় চা, দশ পয়সায় সিঙ্গারা, পনেরো পয়সায় এক
প্লেট ঘুগনি, ডিম-টোস্ট পুরি-সবজি এসব মিলত ক্যান্টিনে। কেউ একা একা বসে
খাচ্ছে ভাবা যেত না। ভেতরের ভিড় বাইরে চলে যেত। ক্যান্টিনে ঢোকার মুখে
বাইরের গাছের নিচে বসে খাওয়া আড্ডা চলত। একটু বেশি প্রিয় সঙ্গ, নির্জনতার
অভিলাষে কোনো কোনো জুটি চলে যেত উল্টোদিকের হেল্প সেন্টারের বারান্দায়,
পেছনের ফাঁকা কনভোকেশন হলে, তার চেয়েও বেশি নির্জনতা যাদের দরকার হত তারা
চলে যেতেন শালকুঞ্জে ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে শিলিগুড়ি থেকে দুটো বাস আসত, একটি উত্তরবঙ্গ
রাষ্ট্রীয় পরিবহনের, অপরটি শিলিগুড়ি বাস সিন্ডিকেটের। জলপাইগুড়ি থেকেও
বাস আসত উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহনের, ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক ও অফিস
কর্মীদের নিয়ে। ওই বাসে আমরা জলপাইগুড়ি থেকে যাতায়াত করতাম। এই
যাতায়াতের গল্পটা না বললে এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ছাত্রাবস্থার পরেও
তিন দশকের বেশি সময় ধরে ওই বাসে যাতায়াত করেছি।
ছাত্র-গবেষক-শিক্ষাকর্মী- গ্রন্থাগার বিভাগের আধিকারিক, তথ্য ও গ্রন্থাগার
বিভাগের অধ্যাপনা, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একাধিক পর্ব অতিবাহিত করেছি ওই
বাসের নিত্য যাত্রী হয়ে। দুঃখের বিষয় ২০০৯ এ বাসটি যখন বন্ধ হয়ে গেল তখন
দুর্ভোগের সীমা রইল না, বাসটির রুট ছিল জলপাইগুড়ি থেকে ইউনিভার্সিটি। ওই
সময়ে বাসটি না থাকলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা
সম্ভব হত না, হোস্টেলে থাকার সংগতি অনেকেরই ছিল না। বন্ধ হয়ে যাবার পর
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক আবেদন-নিবেদন করেছিলাম ,কিন্তু বাসটি বন্ধ
হয়ে গেল, নতুন করে ওই রুটে বাস চালানোর প্রয়োজন আর উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয়
পরিবহণ অনুভব করলেন না আমরা ঐ বাস টিকে বলতাম হেরিটেজ বাস।ইউনিভার্সিটি
সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই ওই বাসটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ।
মোহিতনগর
রেল গুমটি ঝনঝন করে পেরিয়ে রানীনগর ঠুটাপাকরি বটতলা দশদরগা সারিয়াম
ফাটাপুকুর পানিকৌড়ি বন্ধুনগর হাতির মোড় রাধার বাড়ি ভুটকি জটিয়াকালি
ফুলবাড়ি তিন বাতি ঝংকার মোড় হাওড়া পেট্রোল পাম্প জংশন চাঁদমনি মাটিগাড়া
শিব মন্দির ... সব পেরিয়ে বাসটি ঢুকত এক নম্বর গেট দিয়ে।লাইব্রেরী,
প্রশাসনিক ভবন, সি.পি.এম. মোড় (কেমিস্ট্রি ম্যাথামেটিক্স ফিজিকস) পেরিয়ে
আমাদের সেই বাস খালি করে ছাত্র-ছাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে গার্লস হোস্টেল,
গেস্ট হাউজের সামনে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা গেট পার হয়ে বিডিও
অফিসের সামনে দিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে চলে যেত। আবার বিকেলে ফিরে আসত আমরা
ফিরে যেতাম ওই একই বাসে।
সকালে
বাসে ছাত্র-ছাত্রীদের কলতান, অফিসকর্মীদের ভাতঘুমের ঝিমুনি, খবরের কাগজ
পড়া, গান-হাসি-ঠাট্টা সিগারেটের ধোঁয়া, সুখ-দুঃখের সংলাপ সব মিলিয়ে বাসে
ছিল যেন এক আনন্দমেলা। নবীন বরণ, ফেয়ারওয়েল ফুলবাড়ি থেকে পান্তুয়া
কিনে খাওয়া, গোলগুমটির রেলগেটে দাঁড়ালে গরম সিঙ্গাড়া। এমনকি সেই বাস
নিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের মতো সবাই মিলে পিকনিক যাওয়া। বর্ষাকালে বাসের
ওয়াইপার অচল হলে রাস্তার পাশের কচু পাতা দিয়ে কাচ মোছা। গাড়ি খারাপ হলে
হাপিত্যেশ করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অন্য কোনো বাস আমাদের তুলে নেবে, এই
আশায়। কন্ট্রোলার অফ এক্সামিনেশন বিভাগের সুনীল সেন, রঞ্জিত চক্রবর্তী,
তুষার ব্যানার্জি, অর্থ বিভাগের প্রদীপ চক্রবর্তী ও চিত্ত চক্রবর্তী,
দ্বিজেন সেন-রা ছিলেন আমাদের অভিভাবকের মতো। ভাবা যায় না পরবর্তী কালের
গুরুগম্ভীর হেড মাস্টারমশাই ম্যাথমেটিক্সএর সুজন সোমের লঘুসুরে কীর্তন!
কমার্সের কিরণ-রাধেশ্যাম -কাশীরাম- রাজা! ফিলোজফি হিস্ট্রি কেমিস্ট্রি
বাংলা সব মিলেমিশে একাকার! পথিক মেঘের দলের মতো ওরা আজও আসে স্মৃতির দরজায়
কড়া নাড়ে ।
কত কি
বদলে গেল সারাবছরের ঋতু পরিবর্তনের ছবি ধরা দিত বাসের জানালা দিয়ে।
রাস্তার দু'পাশের ফাঁকা মাঠগুলি ভরে গেল ইঁট কাঠ কংক্রিটএর জঙ্গলে।
রানীনগর, রাধার বাড়িতে সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর সারি সারি বাড়ি। হাওড়া
পেট্রোল পাম্পের সামনের উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহনের সিটি বুকিং অফিস আর
নেই, রাস্তা চওড়া করার প্রয়োজনে তা কবে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। ঝংকার
মোড়ের ঝংকার সিনেমা হল আর নেই। চাঁদমনি চা বাগান অদৃশ্য হয়ে গেছে
।আসা-যাওয়ার পথের ধারে সাহু নদীর চরে কাশফুল আর ফোটে না। চাঁদমনির
রাস্তায় সোনাঝুরি গাছ আর নেই, পুজোর ছুটির পর যখন ইউনিভার্সিটি থেকে বাসে
ফিরতাম জটিয়াকালি থেকে ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে ভেসে আসত ছাতিম ফুলের তীব্র
গন্ধ। কত মন আকুল-করা শব্দ -দৃশ্য লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তবুও মনের মধ্যে জেগে
থাকে রাজা রামমোহনপুর ক্যাম্পাসে যাতায়াতের পথে কত দৃশ্যাবলী।
তখন
সমাবর্তন ছিল প্রাণের উৎসব। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হবার কিছুদিন পরে
বিভাগীয় প্রধান হরিপদ চক্রবর্তী চলে যাবার আগে সমাবর্তন হয়েছিল। আমরা
স্নাতক উত্তীর্ণ ছাত্র হিসেবে যোগদান করেছিলাম। সেই সময়ে সমাবর্তন শুধু
ডিগ্রি আর পদক প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। উৎসবের রেশ চলত বেশ কয়েক
দিন ধরে। উপাচার্য অম্লান দত্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি চর্চায় বিশেষ
আবহ তৈরি করেছিলেন। অধ্যাপক হরিপদ চক্রবর্তী উপাচার্য অম্লান দত্ত সম্পর্কে
লিখেছিলেন - "উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ উপাচার্য অধ্যাপক অম্লান
কুসুম দত্ত বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন হলেও বিদ্যা বুদ্ধি কল্পনা কর্মদক্ষতা
সবদিক দিয়েই উজ্জল ছিলেন, কিন্তু পরিবেশটা ছিল রাজনৈতিক বিষবাষ্প দূষিত ও
প্রতিকূল। সামগ্রিকভাবে সংস্কৃতির উন্নয়ন বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ
সাধনের জন্য তিনি বিশেষ বিশেষ বক্তৃতার ব্যবস্থা করতেন। বিখ্যাত
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের এনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করাতেন।রাজা রামমোহনপুর
ভদ্রাসনের শোভা বর্ধন ও সকলের, বিশেষ করে ছাত্রসমাজের রুচির উন্নয়নে তার
বিশেষ নজর ছিল।" এই পর্বের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজের অন্তর্গত থাকার
জন্যই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি প্রত্যক্ষ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম।
দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, শান্তিদেব ঘোষের মতো কিংবদন্তি
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের গান শোনার ও সামনে দেখবার সুযোগ হয়েছিল। 'ন
হন্যতে ' 'স্বর্গের কাছাকাছি'র লেখিকা রবীন্দ্র স্নেহধন্য মৈত্রেয়ী দেবী,
কবি নরেশ গুহ, সাহিত্যিক-সাংবাদিক সন্তোষ কুমার ঘোষ, অধ্যাপক নট ও
নাট্যকার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত এসেছিলেন তার "নানা রঙের দিনগুলি" নিয়ে।
আমাদের বাংলা বিভাগের সেমিনারে অধ্যাপক ধ্যানেশ নারায়ণ চক্রবর্তীর
সংস্কৃতে বক্তৃতা, ফরাসি অধ্যাপক ফাদার পিএফ ফারলোর বাংলায় বক্তৃতা,
"রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টর হুগো" তিনি তখন সম্ভবত কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স
কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। বাংলাতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার দুটো উচ্চারণ এখনো
মনে আছে 'অবীনদ্র নাথ' আর 'ভিক্টর উগো'।ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিলিত
হয়েছিলেন।সুদেহী, দীর্ঘকায়, সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরিহিত ফাদার ফারলোকে
মনে হচ্ছিল যেন শ্বেত পাথরের দেবদূত মূর্তি।
মনে
আছে এসেছিলেন বিদুষী কবি লেখিকা কেতকী কুশারী ডাইসন। খুব ভালো লাগত এরা যখন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে মিলিত হতে চাইতেন। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের বিশেষ ঘনিষ্ঠ, সচিব ও কবি অমিয় চক্রবর্তী এসেছিলেন বাংলা বিভাগের
সেমিনারে। ছাত্র-ছাত্রীদের কবিতা শুনতে চেয়েছিলেন। অশ্রুবাবু ও
প্রণয়বাবুর নির্বাচনে বাংলা বিভাগ থেকে আমি আর আলিপুরদুয়ারের মন্তেশ্বর
স্বরচিত কবিতাপাঠ করেছিলাম। ইংরেজি বিভাগের শিপ্রা সেন আর পলিটিক্যাল
সাইন্সএর ধ্রুবজ্যোতি বাগচি কবিতা পড়েছিলেন ।
সময়ের
সাথে সাথে বদলে গেছে সাহিত্য রুচি। এখন এই সময়ে শিক্ষাব্যবস্থা আর
সংস্কৃতি চর্চার বিরুদ্ধে সুস্থ মন কেমন যেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়।
অধ্যাপক পুলিন দাস অমিয় চক্রবর্তীর কথা লিখেছিলেন - "কবি অমিয় চক্রবর্তী
এলেন একবার, রইলেন গেস্ট হাউসে। ওকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া হল কালিঝোরা
তিস্তার পাড়ে বসে আবৃত্তি করে শোনালেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ওর
কণ্ঠস্বরে সে কবিতা ধরা রইল টেপ রেকর্ডারে। বিভাগের সভায় শোনালেন তার
অসামান্য ভাষণ। ওঁর কবিতা আবৃত্তি করে শোনানোর ভার নিতে হল। তাঁর লেখা
একটি ছোট্ট কবিতা দিয়ে গেলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত পত্রিকায় সেটা
ছাপানো হল। কেন জানি না ক্রমশ বিরল হয়ে এল এমন সব সুধীজনদের আসা যাওয়া !"
পুলিনবাবু স্যারের এ প্রশ্ন আজও জ্বলন্ত রয়ে গেল। এই সময়ের
সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার ভয়ঙ্কর পলিটিকাল আগ্রাসন এবং ক্ষমতাশালী
অতিকায়দের মধ্যেও ভরসা শুধু কবির প্রত্যয়ে, আমি তো ক্ষুদ্র পিঁপড়ে বই আর
কিছু নই-
"আহা পিঁপড়ে ছোট পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা-
স্তব্ধ শুধু চালায় কথা বলা-
আলোর গন্ধে ছুঁয়ে তার ওই ভুবন ভরে রাখুক
আহা পিঁপড়ে ছোট পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক। "
( পিঁপড়ে /অমিয় চক্রবর্তী)
----------------------------------------------------------
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
ছবিগুলি ফজলুর রহমান, প্রাক্তনী, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।