সানিয়া-১২/নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
সানিয়া
পর্ব-বারো
নীলাঞ্জন মিস্ত্রী
^^^^^^^^^^^^^
বাড়ির
উঠোনটা শুকনো পাতায় ঢেকে আছে। কতদিন ঝাড়ু পড়েনি কে জানে। পাতকুয়ার সেই
বালতিটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে অর্ধেক হয়েছে। ঘরের চালে বৃষ্টির জল আটকাতে কালো
ত্রিপাল পাতা। বেড়ার নীচের দিকগুলি পচে ফাঁকা হয়ে গেছে। ঘরের দরজাটা
ভেজানো। নিঃশব্দমাখা চারপাশ। ভর দুপুরে অজানা পায়ের শব্দ শুনে একটা বিড়াল
ছুটে পালিয়ে গেল বেড়ার নীচ থেকে। সানিয়া ভয় পায়। বাড়িতেতো কেউ নেই বলেই মনে
হচ্ছে। কিন্তু ফুলমণি? ও কি তবে একাই রয়েছে ঘরের মধ্যে? কি দেখবে সে দরজা
খুলে? দুরুদুরু বুক নিয়ে দরজা সরায় সানিয়া। ঘরের এক কোণের বিছানাতে ফুলমণি।
হা করে ঘুমিয়ে রয়েছে। বেশ বড় হয়েছে ফুলমণি কিন্তু শরীরে হাড্ডি ছাড়া কিছুই
নেই। ফুলমণির মুখটা দেখে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয় সানিয়ার। ফুলমণি
ফুলমণি করে তাকে ডেকে তুলবে কোন মুখ নিয়ে। এতদিন পরে বাড়িতে ফিরে একটু
মিঠাইও যে সাথে করে আনতে পারেনি ছোট্ট বোনটার জন্য। লজ্জায় মাথা হেট করে
চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে বোনের মাথার পাশে। ফুলমণি বুঝতে পারে না কিছুই।
রামুর মনটাও বড্ড বেদনাকাতর হয়ে ওঠে। ক্ষণিকের জন্য সেও যেন সানিয়া হয়ে
ওঠে। সানিয়ার মনের কথা বুঝতে পেরে বহুদিন পর তারও নিজের বোনের কথা মনে পড়ে
যায়। সানিয়াকে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে রামু।
-সানিয়া এঠে থাকি হাট কদ্দুর?
-মেল্লা ঘাঁটা রে।
-এলাও
বেলাটা ডুবে নাই। চল হাট যাই। একটা আস্তা ঠিক বিরাবে। হাটোত যায়া কুনো
একটা কাম করিমো। দুইটা পাইসা পাইলে বেলা ডুবিবার আগোতে চলি আসিমো। ফুলমণির
তানে নাড়ু নিগামো।
কোনো
কিছু গভীরভাবে না ভেবেই দুই বন্ধু রওনা দেয় হাটের দিকে। পথে পরিচিত
মানুষদের সাথে দেখা হয় সানিয়ার। অনেকে অনেক প্রশ্নই করে তাকে। দু-এক কথায়
উত্তর দিয়ে সানিয়া নির্লিপ্ত থাকে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে তারা পৌঁছায় হাটে।
হাটে লোকসমাগম ভালোই হয়েছে। বেশ কিছু দোকান খোলা রয়েছে। সব দোকানে গিয়ে কাজ
চায় সানিয়া রামু। সব কাজ করতেই আজ রাজী তারা। দু’জন বালককে এভাবে বাজারে
ঘোরাঘুরি করতে দেখে সন্দেহ হয় সকলের। তবুও তারা এদোকান সেদোকান করে চলে
দু’টা পয়সার আশায়। ভাগ্য তাদের সহায় ছিলনা। কাজ মেলেনি কোথাও। তাই খালি
হাতেই ফিরতে হবে বাজার থেকে। রামুও অনেক চেষ্টা করেছে বোন ফুলমণির মুখে
হাসি ফোটাবার। কিন্তু কোন চেষ্টাই ফলপ্রসূ হয়নি।
বেলা
ডুবে যাবে একটু পরেই। আর কোন উপায় না দেখে বাড়ির পথে পা বাড়ায় তারা।
শরীরগুলিও আর চলছেনা। কখন কিছু খাবার মিলবে ? বাড়ি গিয়ে দু-মুঠো ভাত মিলবে
তো। বাবা আর বাচ্চু নিশ্চই এতক্ষণে বাড়ি চলে এসেছে? পেটভরা ভাত না পেলে
রামুই বা কি ভাববে? রামুকে সাথে এনে সে হয়তো খুব ভুলই করে ফেলেছে। এমন হবে
কেইবা জানতো? এসব কথা ভাবতে ভাবতে বাজার ছাড়িয়ে মেঠো পথে ঢুকে পরে তারা।
রাস্তার দুই মাথার মোড়ে একটা বাড়ির সামনে ভাজাপোড়ার দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পরে
রামু। দোকানের সামনে নলপাপরের পাহাড়। কিন্তু কেউ নেই দোকানের ভেতর।
আশপাশটা দেখে দোকানদারের অগোচরে কিছু নলপাপর রামু তুলে নেয় ঝটাপট। সানিয়া
সব দেখে। বুঝতে পারে এ কাজটা ঠিক করেনি রামু। কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারেনা
রামুকে। এ যেন এক প্রচ্ছন্ন সমর্থন। ছোট্ট একটা মেয়ের খুশির জন্য এতটুকু
চুড়ি; বোধহয় কোনো পাপ নয়। এভাবেই মনকে বোঝায় সানিয়া।
দূর
থেকে সানিয়াকে দেখেই চিনতে পারে বাচ্চু। সানিয়ার কাছে ছুটে যায়না সে।
দাঁড়িয়ে থাকে উঠোনের উপর। বাচ্চুর কাছে এসে সানিয়া তার মাথায় হাত বোলায়।
বাবা ঘরের বেড়ার গোড়ায় কোদাল দিয়ে মাটি দিচ্ছিল। বাবার কাছে গুটিগুটি পায়ে
মাথা নীচু করে পৌঁছায় সানিয়া। বাবার শরীরটাতেও কেমন ভাঙন ধরেছে। শক্তিশালী
চেহারাটা আর নেই। রামুকে দেখে কর্মব্যস্ত হাত দুটি থামে হপনা মুর্মুর।
অতিরিক্ত কোন আবেগ নেই তার মাঝে। গভীর এক চিন্তায় যেন মত্ত সে। এতদিন পর
ছেলেকে কাছে পেয়ে যে অভিব্যক্তিটুকু থাকা দরকার তার ছিটেফোঁটাও নেই।
ভাবলেশহীন মুখ। কিছুই জিজ্ঞাসা করে না ছেলেকে। কোথায় ছিল? কেমন ছিল? কেন
এল? সাথেই বা ওটা কে? কিভাবে এল এতটা পথ? এসব দেখে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়
সানিয়ার। শেষে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা বলে, 'যা ঘরে যা। ফুলমণিরও তোর
মার মতো জন্ডিস। বিছানায় পড়ে আছে। খুব খারাপ অবস্থা'। রামুর পরিচয়টা বাবার
সাথে করিয়ে দেয় দিয়ে ফুলমণি ফুলমণি করে ডেকে ঘরে প্রবেশ করে। বড় কষ্টে
ফুলমণি তাকায় দাদার দিকে। মুখের এককোণে মুচকি হাসিটা এসেই মিলিয়ে যায়। চোখ
দুটিও বন্ধ হয়ে যায় সাথে সাথেই। নলপাপর কটি ফুলমণির মাথার পাশে রেখে দেয়
রামু। ছো্ট ভাইয়ের ঘারে হাত দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসতে আসতে বলে, ‘তুই কি
খাবি বলিস। কালকে বাজার গিয়ে এনে দেব। রাস্তায়তো কিছুই পেলাম না তোর জন্য’।
বাবা
ব্যস্ত হয়ে পড়েন রাতের রান্নাটুকু করতে। শোবার ঘরের পাশেই এখন রান্নাঘর।
আগে ছিল শোবার ঘরের সাথেই। জরাজীর্ণ অবস্থা রান্নাঘরটিরও। পিড়ির উপর বসে
বাবা উনোনে আগুন ধরাচ্ছে। সানিয়া বাবার কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। চাল
ভর্তি টিন বাড়িতে সে কোনও দিনই দেখেনি। বাথানে দেখেছে অনেক। টিনের তলায় পরে
আছে কয়েকমুঠো চাল। সানিয়া সেই চাল থেকে কিছুটা তুলে নিয়ে কালিমাখা হাড়িতে
ঢালে। এই পরিমাণ চাল দিয়ে বড়জোর আগামীকালটুকু চলবে তাদের সকলের। তারপর
গায়েগতরে খেটে পেট চালাবার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ক’বছরে যে বাবার উপর দিয়ে
কি ঝড় বয়ে গেছে উপলব্ধি করে সানিয়া। গনগনে আগুনে ভাত ফুটতে শুরু করেছে
উনোনে। ভাতের গন্ধ ছড়ায় ঘরের ভেতর। ভাতের গন্ধ যে এত ভালো হয় সেটা আগে
কোনদিন বোঝেনি সানিয়া। দু'দিন ধরে কিছু না পাওয়া পাকস্থালীটা যেন ক্ষণিকের
জন্য খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
পাশের
ঘর থেকে ফুলমণির গোঙানোর আওয়াজ আসছে। সময় যত পেরোচ্ছে সেই আওয়াজ ঘন থেকে
ঘনতরো হচ্ছে। বাবা, বাচ্চু আর রামু রয়েছে ফুলমণির পাশেই। লবন আর কাঁচালংকা
দিয়ে আলুসেদ্ধ মেখে রাতের খাবার প্রস্তুত করে সানিয়া। ভাত একেবারে গলাগলা
করে মেখে সানিয়া ফুলমণিকে খাইয়ে দিতে থাকে। কয়েকবার সেটা মুখে নেবার পর
ফুলমণি উগরে দেয় বিছানায়। ফুলমণির এমন অবস্থা দেখে খুব চিন্তা হয় সানিয়ার।
মা-ওতো চলে যাবার আগে এমন করেছিল। সেই ভয়ংকর দিনের কথা মনে পরায় আঁতকে ওঠে
তার বুক। ভগবান করুক বোনের অবস্থাটুকু যেন মায়ের মতো না হয়। বাবা চাংড়ার
নীচ থেকে একটা কাঁচের বোতল বের করে । বোতলে রয়েছে কবিরাজি ওষুধ। সেই ওষুধ
জোর করেই মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ফুলমণির। সানিয়ার মনে কিছুটা হলেও বিশ্বাস
আসে। কবিরাজি ওষুধ এনেছে বাবা। ফুলমণি নিশ্চই ঠিক হয়ে যাবে। মা কখনই ওকে
টেনে নিয়ে যাবে না নিজের কাছে।
পেটে
প্রচন্ড ক্ষিদে। তারপর আকাশটা আজও মেঘলা করেছে। ঝড় বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা
প্রবল। তাড়াতাড়ি সবাই মিলে খেতে বসে পরে তারা। চব্বিশ ঘন্টা ধরে শুধু জল
খেয়ে টিকে থাকা সানিয়া রামুর খাবার ধরন দেখে হপনা মুর্মু বুঝতে পারে সব।
খেতে খেতে সানিয়াকে জিজ্ঞেস করে অনেককিছুই। সানিয়া রামু দুজনেই খুলে বলে
সব। পয়সার থলি হারিয়ে এসেছে শুনে হপনা মুর্মুর আশার আলো নিভে যায়। সানিয়াকে
দেখে স্বাভাবিকভাবেই সে ভেবেছিল এবার তার কষ্ট মিটবে। সানিয়া ঠিক সাথে
কিছু পয়সা কড়ি এনেছে। সেই পয়সায় ফুলমণির চিকিৎসা করানো হবে। ঘরের চালটা
ছাওয়া যাবে। কিন্তু সে যে গুঁড়ে বালি হয়। হপনা মুর্মুর কপালের চিন্তার
ভাজটা আরও চওড়া হয়ে ওঠে। সেই ভাজ লুকিয়ে ফেলতে ফেলতে সানিয়াকে বলে, ‘কি আর
করা যাবে? যা হবার তাতো হবেই। তবে চিন্তা নাই। সুবল দেউনিয়ার জমিতে এখন
অনেক কাজ। পয়সা মিলবে দিনে দিনেই’। একথা শুনে রামু আর সানিয়া একে অপরের
দিকে গোলগোল করে তাকায়। দু’জনেই তো জানে বাথান মালিকের সেই নির্দেশ।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴