ভাস্কর্যের আঁতুড়ঘর (পর্ব-১২)
মৈনাক ভট্টাচার্য
--------------------------------------
মীরা মুখোপাধ্যায়ের ডোকরা
ডোকরা শিল্প এমন এক শিল্প যার মধ্যে লেগে থাকে লোকজীবনের অদ্ভুত সব স্বাদ-আহ্লাদ। এই মাদকতায় কেউ একবার মাতাল হলে, সে যে সব কিছু হেলায় সরিয়ে রেখে দিতে পারে ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায় তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ। ১৪ বছর বয়সে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টে তাঁর শিল্পশিক্ষার শুরু। তারপর তিঁনি দিল্লি পলিটেকনিকে পেন্টিং, গ্রাফিক্স ও স্কাল্পচার নিয়ে ডিপ্লোমাও করেন। কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর নানান দেশ। ১৯৫৩ সালে মিউনিখে গবেষণার জন্য বৃত্তি পেয়ে সেই সময় বিখ্যাত ভাস্কর টনি স্ট্যাডলার ও হেনরিচ কারচনারের অধীনে কাজ করার সুযোগ পান। টনি স্ট্যাডলারের প্রভাবে মীরা মুখোপাধ্যায় চিত্রশিল্পী থেকে ভাস্কর শিল্পীতে রূপান্তরিত হন।
জাপান বরাবরই শৃঙ্খলাপরায়ণ এক জাতি। তিনি তাঁর জাপান ভ্রমণকালে অনুভব করেছিলেন সেখানকার কারিগরেরা চাকা ঘুরিয়ে মাটির পাত্র গড়ার সময় যেন ধ্যানস্থ হয়েই ওই কাজ করে চলেছেন। এই ঘটনা শিল্পী মীরাকে খুবই অনুপ্রাণিত করে। নিজের কাজে এই ধ্যান খুঁজে পেতে চেয়ে তাঁকে যেন ভিতরে ভিতরে উথাল পাতাল করে দেয়। তাঁর ভাবনাই পালটে যায়। ফিরে এসে মীরা মুখোপাধ্যায় চলে যান ছত্তিসগড়ের বাস্তার এলাকায়। সেখানকার জনজাতির শিল্পীদের যাপনপ্রকৃয়ার সাথে মিশে গিয়ে ডোকরার ধাতু ঢালাই শেখেন। কোন সন্দেহ নেই এটি একটি প্রাচীন শিল্প কর্ম। এই শিল্পের ইতিহাস প্রায় ৪০০০ হাজার বছরের পুরানো। সিন্ধু সভ্যতায় আবিস্কৃত মহেজ্ঞদোড়োর সেই "নৃত্যরত নারী মূর্তি" ডোকরা শিল্পের নিদর্শন তো সময়কেই চিহ্নিত করে রেখেছে। গবেষকদের মতে সেই তুলনায় অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে ডোকরা শিল্পের প্রসার ঘটে আজ থেকে মাত্র কয়েকশো বছর পূর্বে। মনে করা হয় মধ্যপ্রদেশ এর বস্তার ও ছত্তিসগড়ে এই শিল্পের উদ্ভব হয়। ভারত ছাড়াও চীন, মালয়েশিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে এই শিল্প কর্ম পাওয়া যায়।
মীরা মুখোপাধ্যায় বাস্তারের শিল্পীদের এই ডোকরা ঘরাণার সাথে নিজস্ব ভাবনার এক মেলবন্ধন তৈরি করে আলাদা এক নুতন ঘরাণার জন্ম দেন। এই সব শিল্পীদের সাথে মিশে গিয়ে তিনি ডোকরার সেই আদি অকৃত্তিম ‘লস্ট ওয়্যাক্স মেথড অফ কাস্টিং’ টেকনিকও আয়ত্ত করেন। ডোকরা শিল্প পদ্ধতি বরাবরই একটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ শিল্প কর্ম কোন সন্দেহ নেই। প্রথমে শিল্পীরা পুকুর থেকে লাল বা সাদা মাটি সংগ্রহ করে ও মাটির মণ্ড তৈরি করে; এর পর মাটি দিয়ে হাতে করে একটি অবয়ব তৈরি করে। অবয়বটির উপর মোম, তেল এর প্রলেপ দেওয়া হয় । শেষে নরম মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়। এর পর এটিকে পোড়ানো হয়। ফলে মোম গলে একটি ছিদ্র দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে ।এর পর ওই ছিদ্র দিয়ে গলানো পিতল বা মিশ্র ধাতু ঢালা হয় এবং শক্ত হলে মূর্তিটি সংগ্রহ করা হয়। মূর্তিটি এর পর শিরিশ কাগজে ঘষে এই কাজে প্রয়োজনীয় উজ্জ্বলতা আনা হয়। যেহেতু এই কাজে মাধ্যম হিসেবে গলানো পেতল বা নানা রকম মিশ্র ধাতুর ব্যাবহার হয়ে থাকে। জনজাতির মানুষেরা এই পেতল বা মিশ্রধাতুর জোগান হিসেবে নানা রকম স্ক্র্যাপের ব্যবহার করতেন। তাই এর দামও ব্রোঞ্জের তুলনায় অনেকটা কম করা যেত। ডোকরা শিল্পের জনপ্রিয়তায় জনজাতি ভাবনার প্রতিফলনের সাথে সাথে দাম কম রাখারও একটা বড় কারন হিসেবে মনে করা যেতে পারে। আধুনিক ভাস্কর্যে অনেকটা ব্রোঞ্জ ধরনের এক শিল্পমাধ্যমে তাঁর ভাবনার ভাস্কর্যগুলিকে মানুষের কাছে পরিবেশন করতে শুরু করেন মীরা মুখোপাধ্যায়। কেননা এর আগে ডোকরা এত বৃহৎ আকারে করার কথা যেমন কেউ ভাবেন নি তেমনই এর জন্য ভাবনাটাকে যে একটু বিস্তার করে জনজাতি ঘরাণার আবেশ দিয়ে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করা যায় সেটাও কারও মাথায় আসেনি। তাই তাঁর এই মোল্ডিং কাস্টিং প্রকৃয়ার মাধ্যমে নুতন বৃহৎ আকৃতির আধুনিক কাজের ভেতর নিজের সিগনেচার ওয়ার্ক হয়ে দাঁড়ায়।
ভাস্কর্য শিল্পে কায়িক শ্রম একটা বড় বিষয়। সেই কারনে শিল্পীদের ভেতর চিত্রশিল্পী হওয়ার ঝোঁক ভাস্কর হওয়ার চেয়ে বরাবরই বেশী। বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রেও বিশ্ব জুড়ে এই প্রবনতাই যেন দস্তুর। সেই হাওয়ার বিপরীতে গিয়ে মীরা মুখোপাধ্যায়ের ভাস্কর হওয়া এবং ডোকরা শিল্পকে আধুনিক ভাস্কর্যের মাধ্যম হিসেবে প্রকাশ করা অবশ্যই ভাস্কর্যের ইতিহাসে এক মাইল স্টোন হয়ে থাকবে। এই কাজে অনেক মানুষের সাহচর্য দরকার । মাটি দিয়েই প্রথম থেকে মূর্তি গড়তেন মীরা। সাধারণত প্লাস্টার অফ প্যারিসেই মূল অংশটি (কোর) বানানো হয়। কিন্তু উনি ব্যবহার করতেন এঁটেল মাটির সঙ্গে খড়ের টুকরো, ছাঁকা গোবর, ধানের কুড়ো, বেলে মাটির সংমিশ্রণ। তা দিয়ে প্রথমে মূল অংশটি তৈরি করতেন। তার পর মৌচাক থেকে সংগৃহীত নরম মোমের সুতো বানিয়ে সেটি খাঁজে খাঁজে জড়িয়ে সমান ভাবে মূল মূর্তিটা তৈরি করা হত। তার উপরে ঢাকা দিতেন গোলা-মাটি দিয়ে। এর উপরে দেওয়া হত মোটা টেপা-মাটি। তার পরে বালি-মাটি, একদম উপরে তুষ-মাটি। ফার্নেসে দিয়ে মোমটা গলে গিয়ে একটা নেগেটিভ স্পেস তৈরি করা হত এইভাবে। সেখানে গলা ধাতু ঢেলে দেওয়ার ফলে মূর্তির ভিতরটা ফাঁপা থেকে যেত। তাতে ওজনটাও কমে যেত। ইটের গোল উনুন বা ভাটায় কাজ করতেন মীরা। এর আঁচ ঠিকমতো বজায় রয়েছে কি না, সে দিকে নজর রাখতেন নিজেই। এই ভাবে তিনি নিজেই কিছুটা পশ্চিমী পদ্ধতিতে কাজ শুরু করেন। কাজ করতে গিয়ে বাস্তারের এই সব মানুষেরাই হয়ে ওঠেন শিল্পীর পরিবার। তারের কর্মী, মাটি-বাহক, মাঝি, জেলে, ঝুড়ি বোনেন যাঁরা তাঁরাই ওঁর শিল্পসৃষ্টির বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। সাঁচিতে বুদ্ধের বিশাল ধ্যানমগ্ন মূর্তি শিল্পী মীরা মুখোপাধ্যায়ের মনে বিশেষ দাগ কাটে, তাঁর মনে হয়- ‘‘যে শিল্পী এ কাজ করতে পারেন, তিনি তো নির্ঘাত বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন।’’ এর পর তিনি ১৯৯৬-এর ডিসেম্বরে বুদ্ধের ১৪ ফুটের ধ্যানস্থ মূর্তির কাজে হাত দেন। এই কাজের অনুপ্রেরণা হয়তো পেয়েছিলেন সাঁচিতে বুদ্ধের বিশাল ধ্যানমগ্ন প্রতিকৃতি দেখেই। জীবনের প্রথম দিকে সম্রাট অশোকের একটি ১২ ফুটের ভাস্কর্য শুরু করেছিলেন তিনি। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরের মুহূর্তকে ধরা হয়েছে সেখানে। সেটি বানাতে প্রায় তিন বছর সময় নিয়েছিলেন শিল্পী। কিন্তু জীবনের শেষ দিগন্তে ওই ১৪ ফুটের বুদ্ধমূর্তির জন্য মাত্র এক বছর পেয়েছিলেন। ওই বিশাল কাজে সাহায্য পান ভূমিহীন চাষিদের কাছ থেকে, যাঁরা শিখেছিলেন মীরার জটিল ধাতু ঢালাই পদ্ধতি। শেষে তাঁরাও হয়ে ওঠেন উন্নতমানের শিল্পী। বুদ্ধের শরীরের নীচের অংশ ও কিছুটা অবয়ব সংযুক্ত করা হয়েছিল, এমন সময়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যান মীরা। খুব মনে পড়ে মীরার কবিতার লাইন গুলি -
একদিন সবকিছু শেষ হয়ে যায়,
সব আলো নিভে যায়, সমস্ত নির্মোক ঝরে পড়ে
শুধু এক শূন্যতা কৃষ্ণ গহ্বরের মতো একা
তার রোগা হাত পেতে বসে থাকে।
.........
ঐ যে বললাম রোগা হাত.....
কিছুই চাওয়ার নেই তবু পাতা
হয়তো অভ্যাসবশে।
ধূসর বাকলগুলো রোগা রোগা নিস্পৃহ আঙুলে
হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া দূরে , দূরে আরও দূরে
বাহুর কিছু অংশের কাজ বাকি ছিল। তাঁর কবিতার মতোই। সেই কাজ তাঁর সহযোগীরাই শেষ করেন। যেন ধূসর বাকলগুলো রোগা রোগা নিস্পৃহ আঙুলে....হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া দূরে, দূরে আরও দূরে...।