বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং-১২/রূপন সরকার
বিবর্তনের পথে শহর দার্জিলিং
পর্ব-১২
ড. রূপন সরকার
নতুন করে বসতি স্থাপনে স্থানাভাব স্বত্ত্বেও বিংশ শতকের শুরু থেকেই জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে জোয়ার দেখা যায়। ১৯১১ সালের জনগণনায় জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯,০০৩ জন, যা পূর্ববর্তী দশকের থেকে ২০৮১ জন বেশি, অর্থাৎ ১২% বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। এর মধ্যে ১,৫৭৬ জন ছিলেন ইউরোপীয় বংশোদ্ভুত। যদিও গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে সংখ্যাটা আরো বেড়ে যায়। কারণ উক্ত সময়কালে সমতলের গরম আবহাওয়া থেকে নিস্তার পেতে অনেকেই এই শৈল শহরে আশ্রয় নেয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রথম জনগণনা থেকে ১৯১১ সালে সংগঠিত চতুর্থ জনগণনা পর্যন্ত শহরের জনসংখ্যা চারগুণ বৃদ্ধি পায়, যা দ্রুত নগরায়ণের অন্যতম শর্ত হিসেবেই দেখা যেতে পারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমানতালে শহরের জনঘনত্বও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে পরিবর্তী দশকগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে তারতম্য ধরা পরে। ১৯২১ সালে দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যা হয়ে ওঠে ২২,২৮৫ জন। তবে পরবর্তী দশ বছরে অর্থাৎ ১৯৩১ সালের জনগণনায় ধরা পরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে, জনসংখ্যা হ্রাস পেয়ে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২১,১১৫ জন। ১৯৪১ সালে আবার পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে সংখ্যাটি হয় ২৭,২২৪ জন। মূলত চা-শিল্পে যুক্ত হতে মানুষদের আনাগোনা জনসংখ্যায় জোয়ার আসে। এর সাথে যুক্ত হয় ইউরোপীয় সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারী, ব্যবসায়ি, ভারতীয় চাকুরিজীবি, ডাক্তার তথা নানা পেশার সাথে যুক্ত মানুষের স্রোত। এই জনপ্লাবনের ফলে ১৯৫১ সালের জনগণনায় দেখা যায় দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যা বেড়ে ৩৪ হাজারে পৌছে গিয়েছে। অর্থাৎ পূর্বের দশকের তুলনায় ২৩% বৃদ্ধি পায়। ১৯৬১ সালে আরো ২১% বৃদ্ধি ঘটিয়ে জনসংখ্যার পরিমান দাঁড়ায় ৪১, ০০০ জন। এর পরবর্তী দশকে বৃদ্ধির হার একেবারই কমে যায়। এই দশকে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মাত্র ৫.৫% বৃদ্ধি ঘটিয়ে শহরের জনসংখ্যা ৪৩ হাজারে থেমে যায়। এই বৃদ্ধি পূর্বের সমস্ত দশকের থেকে একদম কম। এর পরবর্তী দশকে আবার জোয়ার আসে এবং প্রায় ৩৪%-এর বেশি বৃদ্ধি পেয়ে অর্থাৎ ১৯৮১ সালে জনসংখ্যা ৫৮ হাজারে পৌছে যায়। পরবর্তী দশকদ্বয়ে বৃদ্ধির হার একই রকম বজায় থাকে এবং ১৯৯১ সালে জনসংখ্যা হয় ৭১ হাজার ও ২০০১ সালে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা হয় ১০৩,০০০ জন।
অতি অল্প সময়ে দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব বৃদ্ধির পেছনে একটিই কারণ ছিল অভিবাসন। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র উনবিংশ শতককে ভারতের ইতিহাসে অভিবাসনের শতক হিসেবে দেখা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, পরবর্তী শতকেও এই প্রবণতা বজায় ছিল। দার্জিলিংয়ের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ধরনের অভিবাসনই কার্যকর ছিল। পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন নেপাল, সিকিম, ভুটান ও তিব্বত সহ এই সমস্ত দেশ থেকে প্রচুর মানুষ এই পার্বত্য শহরে এসে বসবাস শুরু করে। তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি কর্মচারী অথবা গৃহস্থলির কাজের সাথে যুক্ত মানুষের চাহিদা এবং ভ্রমণকে কেন্দ্র করে জীবিকা অর্জনের যে সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছিল তাতে আকৃষ্ট হয়ে সমতল থেকে বহু মানুষ ধীরে ধীরে দার্জিলিং শহরে এসে হাজির হয় এবং বসতি স্থাপন করে। এরাই দার্জিলিং শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। যদিও এদের মধ্যে অনেকেই যেমন বাঙালিরা তাদের আদি বাসস্থানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন না করেই দার্জিলিংয়ে বসবাস শুরু করে। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আগত অভিবাসিরা তাদের আদি বাসস্থানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেই দার্জিলিংয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল। পার্বত্য অঞ্চলের অভিবাসীদের ক্ষেত্রে 'Pull' ও 'Push' উভয় প্রক্রিয়ায় কার্যকর ছিল। এই পার্শ্ববর্তী দেশগুলির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল দাসপ্রথা নামক প্রতিষ্ঠানটির উপস্থিতি। দাসত্বের জীবন থেকে মুক্তি পেতে এবং স্বাধীণভাবে জীবন যাপনের জন্য এবং নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবিকা গ্রহণের আগ্রহে পার্শ্ববর্তী পার্বত্য অঞ্চলের দেশের মানুষ দার্জিলিংয়ে এসে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। তবে ভুটান থেকে আগত মানুষের সংখ্যা ছিল খুব কম। সবচেয়ে বেশি সংখ্যাক মানুষ এসেছিল নেপাল থেকে। দাস ব্যবস্থার উপস্থিতি ছাড়াও নেপালের সৈন বাহিনীতে নাম লেখানো ছিল বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেকে নেপাল ছেড়ে দার্জিলিংয়ে চলে আসে। একদিকে নিজ দেশে বিকর্ষণ (Push) জনিত কারণ, অন্যদিকে দার্জিলিংয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় আকর্ষণ (Pull) জনিত পরিস্থিতি তৈরি হয়। উভয়ের সম্মিলিত কারণে এক বিশাল অংশের মানুষ দার্জিলিংয়ে এসে বসবাস শুরু করে। এইভাবে নেপালের বিভিন্ন অংশ থেকে বিশেষকরে পূর্ব নেপাল থেকে এতো মানুষ দার্জিলিংয়ে এসে বসতি স্থাপন করে যে, অচিরেই নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষ স্থানীয় লেপচা, ভুটিয়াদের পেছনে ফেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এভাবেই শহর দার্জিলিং বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, ভাষার মানুষদের নিয়ে এক বহুমাত্রিক চরিত্র লাভ করে, যা অভিবাসন দ্বারা সংগঠিত তিন ধরনের মানুষদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। প্রথমত, পার্শ্ববর্তী পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগত স্থায়ীভাব বসবাসকারী মানুষজন, দ্বিতীয়, সমতল থেকে আগত অর্ধস্থায়ী মানুষজন এবং আবহাওয়া কেন্দ্রিক মানুষজন, যারা গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে সমতলের অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া থেকে নিষ্কৃতি পেতে এই শৈল শহরে আশ্রয় নিতেন, এবং তৃতীয়ত, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা, চা-বাগানের সাথে যুক্ত মানুষদের নিয়ে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা সমৃদ্ধ হয়েছিল। দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রথম ধরনের অভিবাসন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধরনের অভিবাসন কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
আপনাদের
মূল্যবান মতামত জানাতে কমেন্ট করুন ↴