বাংড়ি তিতি ও হাউড়ি শেষে
পর্ব - ১২
মিশা ঘোষাল
^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^^
টোটোদের 'নাইয়ূ' পূজার একটি অনুষ্ঠান
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
তারিখ
৬ অক্টোবর ২০১৮। এদিন ছিল টোটোদের পূজার 'নাইয়ু' (Ngoyu Festival of
Totos) অনুষ্ঠানটি । 'অংচু' পূজার পর প্রতিবছরই টোটোদের 'ডেমসাতে' এই আদিম
লোকগান ও টোটো লোকনৃত্যের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। 'ডেমসা' হল টোটোদের
মন্দির বা পূজা-ঘর। টোটোদের এই স্থানটি অত্যন্ত পবিত্র বলে মানা হয়। যখন
তখন ডেমসার চত্বরে প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ !
টোটোপূজার
সময় ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় এই স্থানটি বন্ধ থাকে। 'কাইজী' বা টোটো
পূজারীদের অনুমতি ব্যতিত 'ডেমসা'তে প্রবেশ করার অধিকার থাকে না সবসময়।
অংচুপূজা ও অন্যান্য টোটোপূজার সময় এই মন্দিরের গেট খুলে দেওয়া হয়।
এই
অনুষ্ঠানের প্রথম দিকে মাদল বাজিয়ে পূজারী তথা বয়স্ক টোটোজনেরা (মহিলা ও
পুরুষ উভয়ই) তাদের পৌরাণিক আদলে আদিম টোটো সংলাপ ছন্দে ও নৃত্যে পরিবেশন
করেন। তারপর তারা গোল হয়ে নৃত্যের তালে তালে ঘুরে ঘুরে নাচ ও গানের এই
উৎসবে মেতে ওঠেন। মাদলের তালে ঐতিহ্যবাহী এই টোটো নৃত্য ও গান পরিবেশন করেন
টোটোদের কাইজী সহ অন্যান্য বয়স্ক টোটোজনেরা। টোটোদের এই
পৌরাণিক
ও ঐতিহ্যবাহী (traditional Toto Culture and heritage) লোকগান পরিবেশিত
হয়ে গেলে সময় আসে টোটোদের ইয়ং জেনারেশনের জন্য তাদের লেখা ও সুর দেওয়া
কিছু নতুন গান ও নৃত্য পরিবেশনের জন্য। এদিন সত্যজিৎ টোটো তাঁর নিজের
লেখা গানের ডালি নিয়ে হাজির ছিলেন। গেয়েছিলেন অনেক টোটোগান। বকুল টোটো টোটো
কল্যান সমিতির সম্পাদক। তিনি গীটারে পারদর্শী। গীটার বাজিয়ে এদিন তিনি
আশা বোমজানের (টোটোপাড়া-বল্লালগুড়ির অঞ্চলের প্রধান তিনি)সাথে যৌথভাবে একটি
টোটোগান পরিবেশন করেছিলেন। সঞ্চিতা টোটো, রথীন টোটোও টোটোগান গেয়েছিলেন।
ইন্দ্রজিৎ টোটোর পর টোটোপাড়ার ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ভক্ত টোটো বক্তব্য পেশ
করেছিলেন প্রথম দিকে। এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন সনে টোটো ও অভিষেক টোটো।
'কাইজী'র অনুমতি নিয়ে এদিন আমি 'সুচনা টোটো'র লেখা একটি টোটো গান পরিবেশন
করি ( নীচে উল্লিখিত গানটি)।
ভূটান পাহাড়ের হিমেল
হাওয়ার স্রোত ভেসে আসতে শুরু করে টোটোপাড়ায় এই 'নাইয়ূ' পূজার অনুষ্ঠানের
সময় থেকেই। নদী, অরণ্য, পশুপাখি ও ঝোরার কলকল শব্দে মেতে ওঠার উষ্ণ আবেগ
মিশে যেতে থাকে এই আদিম টোটো লোকসংস্কৃতির সুরে...
টোটোপাড়ায়
কাজ করতে এসে এই অভূতপূর্ব উপহার স্বরূপ খুঁজে পেয়েছিলাম এই আদিম টোটো
লোকসংস্কৃতির সুর ! টোটোদের এই সংস্কৃতি যে অমূল্য সে কথা অনুধাবন করে
বিদ্যালয়েও টোটো লোকসংগীত ও টোটোদের আদিম ভঙ্গিতে লোকনৃত্যের চর্চা বজায়
রেখেছি ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতায়। ভালোবেসে নিজেও রপ্ত করতে চেষ্টা করেছি
ওদের ভাষা ও সংগীত।
শিক্ষার পাশাপাশি এই টোটো
লোকসংস্কৃতির অগ্রগতি ও চর্চা রেখেছিলাম বিদ্যালয়ে, যাতে হারিয়ে যাওয়া
সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার হয়। টোটোদের নিজস্ব জনজীবনের যে মাটির গন্ধ মিশে আছে
এই লোকসংস্কৃতিতে,তা সত্যিই সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এ এক নিখাদ অমূল্য
সংস্কৃতি যা কালক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে সে কথা বুঝতে পেরে টোটো কবিদের এই
সংগীত ও গান লেখালেখির কাজেও উৎসাহিত করেছি।
বিদ্যালয়ের
ছাত্রছাত্রীদেরও টোটো কবিতা বা গান লেখার কাজে এগিয়ে আসতে বলেছি। অনেক
ছাত্রছাত্রীরা এই টোটো সাহিত্যচর্চায় উৎসাহী হয়ে এগিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে
আমার একটি ছাত্রের নাম উল্লেখযোগ্য। সে সনে টোটো। 'টোটো ইয়ং গ্রুপের'
প্রতিষ্ঠা তার হাত ধরেই। প্রথমত সনে টোটো,মদন টোটো, অঞ্জু টোটো এগিয়ে এসেছে
বিদ্যালয়ে এই লোকসংস্কৃতির টিম গঠনে। তারপর একে একে অনেকেই এই
লোকসংস্কৃতির চর্চায় এগিয়ে এসেছে। টোটো কবিদের মধ্যে ধনীরাম টোটো ও
সত্যজিৎ টোটোকেও পেয়েছি বিদ্যালয়ে টোটো সংগীত ও নৃত্যের চর্চায়।
ফিরে আসি আবার সেদিনের অনুষ্ঠানে। সেই রাতে এই 'নাইয়ূ' আনুষ্ঠানে মেতে উঠেছিল টোটোদের ছেলে বুড়ো সবাই।
আমিও
এই অনুষ্ঠানে টোটো ভাষায় একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের বক্তব্য রেখে টোটোভাষার
একটি গান পরিবেশন করি। একে একে বিভিন্ন টোটো কবিদের গানও আমাদের
বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা পরিবেশিত হয়। সমবেতভাবে এই টোটোনৃত্য
পরিবেশিত হয়। টোটো পোষাক পরিধান করে এই নৃত্য ও গীতের মাধুর্য্য অসাধারণ
রূপে ছুঁয়ে যায় মন।
রাত যখন গভীর হতে থাকে আর সেই সঙ্গে তখন 'ইউ' পানও চলতে থাকে এই 'ডেমসায়'।
মন্দির
সংলগ্ন অঞ্চলে ও মন্দিরটিকে ঘিরে চলে 'ইউ'পানের পবিত্র অনুষ্ঠান। এও এক
রীতি টোটোদের। প্রবীণ টোটো অভিভাবকেরা, নারী ও পুরুষ উভয়ই কাঁসার বাটিতে
করে 'ইউ' পান করেন এই অনুষ্ঠানে সমাদৃত হয়ে। বসে থাকেন ঘাসের গালিচার উপরে,
আর নাইয়ূর নাচগানের এই অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে থাকেন পরমানন্দে।
টোটোপূজা উপলক্ষ্যে টোটোদের এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে (Toto's Ngoyu
Festival) যোগদান ও অংশগ্রহণও ছিল প্রতি বছরের মতোই এবারও আমার প্রিয়
ছাত্রছাত্রীদের ডাকে। সেই বছর এই দিনটি ছিল শনিবার। ০৬/১০/১৮ তারিখে হয়েছিল
এই টোটোপূজার অনুষ্ঠানটি। টোটোপাড়ার ডেমসাতে সেই বছর অনেক লোক সমাগম
হয়েছিল। সে বছরের এই টোটো লোকসংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠানে যোগদান ও সহায়তা করতে
এগিয়ে এসেছিলেন 'অনগ্রসর কল্যান বিভাগের' (প.ব.সরকার) আধিকারিকগণ। তাদের
ফটোগ্রাফার এই অনুষ্ঠানের কিছু মহুর্তের ছবিও সেদিন তুলে রেখেছিলেন। সেই
ছবিগুলো পরে ছাত্রছাত্রীরা আমাকে শেয়ার করে ।
ছাত্রছাত্রীদের
সাথে এই টোটো লোকনৃত্যের ছবি,টোটো কবিদের ছবি,টোটোপাড়ার প্রিয়
দর্শকবৃন্দের ছবি ও আমার ভালোলাগার টোটোগান গাওয়ার কিছু মুহুর্তের ছবিগুলো
ছিল এদিন এই অনুষ্ঠানে যোগদানের বিশেষ প্রাপ্তি আমার। সঙ্গে ছিল ভালোলাগাও,
টোটোদের আদিম সুরে সুর মিলিয়ে টোটোগান গাইতে পারার খুশি...
"তেপাওয়া সানি ইয়াংবিহা
তেপাওয়া সানি ইয়াংবিহা
হা হাই কেওয়া ইয়োংকো লোই
তোয়পাওয়া সিনি ইয়াংবিহা
পারাইরো ইয়াংবি লারো হিগা
(মা)হারো স্কুল তা
জিংরো সায়ু দে আ ইয়াংবিহা
মাহা না ইয়াংবি মাপ্রাইনো ইয়াংতি
মোকাইরো (ম)হারে
জিরুং জিপ্নুং লারো পারাইরো ইয়াংতিহা
তোয়পাওয়া সিনি ইয়াংবিহা
তেপাওয়া সানি ইয়াংবিহা
হা হাই কেওয়া ইয়োংকো লোই
তেপাওয়া সানি ইয়াংবিহা...